নিরাপত্তা
বাংলাদেশ তো পাকিস্তান নয়!
ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া অবশেষে ঘোষণা দিয়ে দিল-- তাদের ক্রিকেট দল দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে বাংলাদেশে আসছে না। না আসার কারণটা গত কয়েকদিন ধরেই বেশ আলোচিত হচ্ছে- বাংলাদেশ নাকি তাদের চোখে নিরাপদ নয়।
২.
এই লেখার গভীরে ও মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, শুরুতেই একটা মজার বিষয় খেয়াল করিয়ে দেই। এই লেখার মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলে তা নিতান্তই কাকতালীয়!
কনসেপ্টচুয়াল পশ্চিম যখন মধ্যপ্রাচ্য-দক্ষিণ এশিয়ার ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোকে তর্জনীর দুলুনিতে জঙ্গিরাষ্ট্র-সন্ত্রাসীরাষ্ট্র বানিয়ে ফেলছে, তখন সৌদি আরব দারুণ রকম ব্যতিক্রম। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব পশ্চিমের মিত্র, পশ্চিমের চোখে পবিত্র। পশ্চিম প্রায় সব ইসলামিক রাষ্ট্রকে তার এজেন্ডা-প্রপাগাণ্ডা ব্যবহার করে 'সাধারণ' বানিয়ে দিয়েছে। অথচ, সেই পশ্চিমের আশীর্বাদেই ‘অসাধারণে’র কাতারে সৌদি আরব!
তাই দেখি, ইরান যখন মিনায় মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনায় তদন্ত দাবি করেছে, তখন সৌদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবায়ের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির পাশে দাঁড়িয়ে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে ‘রাজনীতি’ বন্ধ করার হুংকার দিচ্ছেন। তবুও তিনি দায় নিবেন না! পশ্চিমা রাজনীতি মিত্র যার, তার সবচেয়ে বড় সত্য মিথ্যাচার; তার তো দায় নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তার সব অপরাধ মাফ!
অন্যদিকে, পশ্চিমা রাজনীতি যে দেশকে পছন্দ করে না, সে দেশ শুধু একটা 'পায়ুবায়ু' ছাড়লেই বিশ্ব রাজনীতির মোড়লরা ‘দুর্গন্ধ... দুর্গন্ধ...’ বলা শুরু করে দেয়!
কোনো দেশ নিজস্বতা ও স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবেই। তাই, অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশকে ‘নিরাপদ নয়’ বলার পর পরই দেখলাম কয়েকটি ঘটনা চোখের পলকে, অতিদ্রুত ঘটে গেল। জাতীয়তাবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়েও, আবেগের ধার না ধেরে, কিছুটা চাঁছাছোলা ক্রিটিক্যাল অবস্থান থেকেও কি সংশয় প্রকাশ যায় না যে, বাংলাদেশকে নিয়ে পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র চলছে?
৩.
এই লেখার শিরোনামে পাকিস্তানকে টানা হয়েছে। নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থা পাকিস্তানের চেয়েও ভয়ঙ্কর। চাইলে তাই, সিরিয়া-ইরাক কিংবা পাকিস্তান লাগোয়া আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশের নামও লেখা যেত। সিরিয়ার সাম্প্রতিক যে ঘটনাবলী, তাতে তার নাম লিখলে হয়তো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হতো।
তিন বছরের সিরিয়ান শিশু আয়লান কুর্দির সলিল সমাধি ও সমুদ্রে ভাসমান নিথর দেহ পুরো বিশ্বকেই আবেগাক্রান্ত করেছে। সিরিয়া নিরাপত্তা ইস্যুতে পুরো বিশ্বের চোখেই এখন ‘হট কেক’। সিরিয়াতে আইএসের দখলদারত্বের কারণে ইউরোপে শরণার্থী যাচ্ছে লাখে লাখে। সেই স্রোত থামেনি। আধুনিক যুদ্ধবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সেই স্রোত থামবে না। প্রতিটি আর্ত আজ যেন এক একজন উদ্বাস্তু!
তবুও, সিরিয়ার নাম না লিখে পাকিস্তানের নাম লিখতে হলো। কারণ, বিষয়টা ক্রিকেট। নিরাপত্তা নেই বলে পাকিস্তানে যায় না বাকি ক্রিকেটবিশ্ব। ২০০৩ সাল থেকে গত এক যুগে পাকিস্তানে ৫০ হাজারের অধিক মানুষ সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছে! পাকিস্তান আসলেই নিরাপদ নয়! নিরাপদ নয়- এই প্রথম এমন অভিযোগে কোন দেশ বাংলাদেশ সফর বাতিল করল। পাকিস্তানকে তাই টানতেই হলো!
৪.
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর (২৬/১১) মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলা পুরো ভারতকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল। চার দিন ধরে চলা এই সন্ত্রাসী হামলা এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, ১৬৮ মানুষ নিহত ও ছয়শতাধিক মানুষ আহত হয়। ইতিহাস জানাচ্ছে, এই হামলার কারণেই সে সময় ক্রিকেট বিশ্বের চারটি দেশের ক্রীড়াসূচি উলটপালট হয়ে যায়।
ইংল্যান্ড তখন ভারতে সাত ওয়ানডে ও দুই টেস্টের সফর করছিল। সন্ধ্যা রাতে হামলাটা যখন হয়, তখন কটকে চলছিল দিবারাত্রির পঞ্চম ওয়ানডে। ওই ম্যাচটা খেলেই এবং ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরে ভীতসন্ত্রস্ত ইংলিশরা বাড়ি চলে যায়। শেষ দুই ওয়ানডে বাতিল ও দুই টেস্ট স্থগিত হয়ে যায়। ডিসেম্বরে পরিস্থিতি শান্ত-স্বাভাবিক হলে ইংলিশরা আবারও ভারতে আসে এবং দুটি টেস্টে অংশ নেয়। তবে, পূর্বনির্ধারিত আহমেদাবাদ ও মুম্বাই থেকে টেস্ট দুটি সরিয়ে নেওয়া হয় যথাক্রমে চেন্নাই ও মোহালিতে।
মুম্বাইয়ে মাত্র ১০ জন নিয়ে হামলাটা করে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তোইয়্যবা। সেই হামলার পর ধরা পড়া লস্করের একমাত্র বেঁচে থাকা আক্রমণকারী আজমল কাসাব স্বীকার করেন, তাঁদের এই হামলায় সহযোগিতা করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই।
২০০৯ সালের শুরুতেই ভারতের পাকিস্তানের মাটিতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে যাওয়ার কথা ছিল। কাসাবের স্বীকারোক্তির পর পরই ভারত সেই সফর বাতিল করে ফেলে। আজও পর্যন্ত ভারত সেই ক্ষোভ পুষে রেখেছে। আর তার মাশুল গুনতে হচ্ছে পাকিস্তান ক্রিকেটকে!
ভারত যাবে না বলে পাকিস্তান আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেল শ্রীলঙ্কাকে। তিন ওয়ানডে, দুই টেস্টের সফর। কিন্তু সফরের শেষ ম্যাচে অর্থাৎ শেষ টেস্টে ঘটল বিপদ। তৃতীয় দিনের খেলা শুরু হওয়ার আগে হোটেল থেকে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলো লঙ্কানদের টিমবাস। সফর বাতিল হলো। কী নির্মম পরিহাস, পাকিস্তানিদের আর্থিক ক্ষতি পূরণে সেখানে খেলতে গেল যে শ্রীলঙ্কা, তারাই কি না হলো সন্ত্রাসের শিকার!
ইতিহাস দেখাচ্ছে, এর আগে, ২০০২ সালের মে মাসে করাচিতে নিজেদের হোটেলের সামনে বোমা হামলায় ১২ জন নিহত হলে সফর বাতিল করে নিউজিল্যান্ড। অথচ, নিউজিল্যান্ডের আগেই ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের মাটিতে নিরাপত্তার কারণে খেলতে অস্বীকৃতি জানায় ওয়েস্টইন্ডিজ। পরিবর্তে তারা প্রস্তাব দেয়, পূর্বনির্ধারিত সময়সূচিতে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাতে খেলতে সম্মত আছে। পাকিস্তান আমিরাতেই খেলতে রাজি হয়। অথচ নিউজিল্যান্ড পাকিস্তানের ডাকে সাড়া দিয়ে খেলতে গিয়ে হয় আক্রান্ত! ওই বছরের আগস্টে প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের মতো ‘ভুল করেনি’ অস্ট্রেলিয়া। নিরাপত্তা ইস্যুতে তিন টেস্টের পাকিস্তান সফর বাতিল করে তারা।
২০০৮ সালের এপ্রিলেও তিনটি টেস্ট ও পাঁচটি ওয়ানডে খেলতে পাকিস্তান যায়নি অস্ট্রেলিয়ানরা। পরে ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নেয় আপাতত ওয়ানডে সিরিজটা হবে আরব আমিরাতে। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছয় দিন পরই শ্রীলঙ্কার টিমবাসে হামলা হয়!
২০০৯ সালের ৩ মার্চে ওই সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তানে আর কখনো টেস্ট খেলা হয়নি। সেদিন ছয়জন নিরাপত্তা রক্ষী নিহত এবং ছয়জন লঙ্কান ক্রিকেটার আহত হয়েছিলেন! সেই ভয়েই বিশ্বের প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশ পাকিস্তান সফর করতে নারাজ।
তবে, এই দলগুলো পাকিস্তানের ‘দ্বিতীয় হোম’ আরব আমিরাতে খেলতে রাজি আছে। আমিরাত সদাউত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হওয়ার পরও কোনো প্রতিপক্ষেরই সমস্যা নেই! আশ্চর্য বটে! এখানেই মনে হয়, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থের পরও পশ্চিমাদের চোখে অভিন্ন মিত্র! নিরাপত্তাহীনতার কোনো আশঙ্কা তাই মিত্রের মাটিতে নেই!
পাকিস্তানের মাটিতে খেলার ব্যাপারে একমাত্র ব্যতিক্রম জিম্বাবুয়ে। এই বছরের মে মাসে তারা ছয় বছরের মধ্যে প্রথম দল হিসেবে পাকিস্তানে খেলতে গিয়েছিল। টেস্ট খেলতে নয়, তিনটি ওয়ানডে-দুটি টি-টোয়েন্টি খেলতে। প্রতিটি খেলাই হয়েছিল লাহোরের সেই গাদ্দাফি স্টেডিয়ামেই, যেখানে শেষ করেছিল শ্রীলঙ্কা!
নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যেও জিম্বাবুয়ে আসলে বাধ্য হয়ে গেছে। অর্থের কষ্ট বড় কষ্ট এই অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভুবনে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সেই সংকটকাল চলছে। সেটা পোষাতেই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পাকিস্তানে গেছে। এমনকি শেষ ওয়ানডের আগের দিন গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের বাইরেই আত্মঘাতী বোমা হামলায় দুজন নিহত হওয়ার পরও জিম্বাবুয়ে খেলতে পিছুপা হয়নি। ঝুঁকিই যখন নিয়েছি তখন আর ভয় কেন!
জিম্বাবুয়ে আসলেই একটা ব্যতিক্রমধর্মী দায়িত্ব নিয়েছিল। এই দায়িত্বটা অন্য কোনো দেশের পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এমনকি পাকিস্তান যদি আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ড-নেদারল্যান্ডসের মতো আইসিসির সহযোগী দলগুলোকেও আমন্ত্রণ জানায় খেলতে, তারাও যাবে না। তাদের তো আর জিম্বাবুয়ের মতো অর্থকষ্ট নেই! টেস্ট খেলুড়ে বাকি দলগুলোর কথা তো বাদই থাকল!
তবে, জিম্বাবুয়ের ব্যতিক্রমধর্মী এই দায়িত্বটা সবার আগে পালন করতে সম্মত হয়েছিল কোন দেশ জানেন? বাংলাদেশ! ২০১২ সালে। পরে মহামান্য হাইকোর্টের একটি রিটের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অনিরাপদ পাকিস্তানে দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। সেই 'প্রায়শ্চিত্ত' করতেই এবং আসন্ন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিনিময় হিসেবে বাংলাদেশ নারী দলকে জনবিরুদ্ধতার পরও পাকিস্তানে পাঠায় বিসিবি। অথচ, আজকে কী নির্মম পরিহাস, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসছে না সেই নিরাপত্তাহীনতার কারণ দেখিয়েই!
৫.
গত ২৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার অস্ট্রেলিয়া সরকারের পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য অধিদপ্তর (ডিএফএটি) বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়ান নাগরিকদের ‘নিরাপত্তা ঝুঁকি’র আশঙ্কা করে তাদের চলাফেরার ব্যাপারে সতর্ক সংকেত জারি করে। বাংলাদেশে ‘জঙ্গি’ হামলার আশঙ্কাও নাকি করা হয় তাদের প্রেরিত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বরাবর প্রতিবেদনে। ঠিক এসব কারণেই, তারা তাদের ক্রিকেট দলকে বাংলাদেশ আসার মাত্র একদিন আগে সফর করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়। সরকারি সতর্কতা- স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেট অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের গত ২৮ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত দিনে না পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা শন ক্যারলসহ তিনজন বাংলাদেশে দুইদিনের সফরে আসে। দুই দিনে তারা ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনার, বিসিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে। ২৮ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তাজনিত সমস্যা না থাকলেও অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলকে বাংলাদেশ সফরে ভিভিআইপি নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
শন ক্যারলের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক দল নাকি বলেছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের দেশগুলোতে যারা অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক আছে, তাদের সবাইকেই চলাফেরার ব্যাপারে সাবধান থাকার পরামর্শ দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ান সরকার। তার পরও, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২৮ সেপ্টেম্বরের বৈঠকের পর ক্যারলরা বেশ আশ্বস্তও হয়েছিলেন বলে শোনা যায়।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মতোই ওদিকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াও আশাবাদী ছিল যে বিলম্বে হলেও সফরটা হবে। ২৯ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান সময় রাতে তো ক্রিকেটারদের জন্য টিকিটও বুকিং দিয়ে রাখা হয়েছিল। ঈদের আগে অসি ক্রিকেটারদের খেলার সরঞ্জাম পৌঁছে গিয়েছিল। তার মানে আশায় বুক বাঁধতে কোনো দোষ ছিল না।
হঠাৎ, ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় দৃশ্যপট বদলে যায়। গুলশানের কূটনৈতিক অঞ্চলে খুন হন ইতালিয়ান নাগরিক সিজার তাভেলা। পরের দিন মঙ্গলবার এই হত্যার দায় স্বীকার করে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিবৃতি দেয় বলে বিভিন্ন মিডিয়ায় খবর আসে। সোমবার এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই বাংলাদেশে জঙ্গি নেই, নিরাপত্তাহীনতার কোনো আশঙ্কা নেই বলে গণমাধ্যমে বক্তব্য দেন র্যাবের মহাপরিচালক। ঘণ্টা পার হতে না হতেই ঘটল তাভেলা হত্যাকাণ্ড!
দুর্বৃত্তরা আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ছিদ্রটা যেন হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়ে গেল। অস্ট্রেলিয়ানদের আশঙ্কার পরও আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য দিয়ে গেছেন। সবকিছু উড়িয়ে দিয়েছেন। সম্ভবত আমরা সবকিছু হালকা ও স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার মাশুল গুনলাম। আমাদের ব্যর্থতা ও 'কাজের চেয়ে কথা বেশি বলা'র সংস্কৃতিরই জয় হলো। আর, তাদের আশঙ্কাটাই সত্য হয়ে গেল। তাভেলা যেন আমাদের মাথার ওপরে আশঙ্কার কালো মেঘ ধরিয়ে দিয়ে গেলেন! তাভেলা একটা সংশয়ও ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন- হত্যাকাণ্ডের পর তার পরিচয় কীভাবে 'আমেরিকান' হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র, এটা এখনো রহস্যজনক লাগছে।
তাভেলা হত্যাকাণ্ডের পর পরই নিজেদের বাংলাদেশে অবস্থানরত নাগরিকদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়ে বিবৃতি দিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বিশ্ব মিডিয়ায় নেতিবাচকভাবে খবর হলো বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট উঁকি দিয়ে ডাকছে বাংলাদেশকে।
ধারণা করা যায়, ক্যারলদের প্রতিবেদনের তখন আর কোন গুরুত্বই নেই! সোমবারই অস্ট্রেলিয়া ফেরার কথা ছিল শন ক্যারলের। আর থেকে যাওয়ার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজার গ্যাভিড ডোভি ও নিরাপত্তা ম্যানেজার ফ্র্যাঙ্ক ডিমাসির, যাতে তাঁরা পরের দিন টিম অস্ট্রেলিয়া রওনা দিয়ে ঢাকা পৌঁছালে দলের সঙ্গেই যোগ দিতে পারেন। কিন্তু, তাভেলা হত্যাকাণ্ডের পর তিনজনকেই দেশে ডেকে পাঠায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া।
এর পর তো আর দোলাচলে থাকার কোনো কারণ ছিল না। নিজেদের ক্রিকেটারদের রাজ্য দলে ফেরত পাঠিয়ে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। তারা আসছে না, এটা আরো নিশ্চিত হয়ে যায়। দুইদিন সময় নিয়ে বৃহস্পিতবার ১ অক্টোবর ইমেইলে বিসিবিকে তারা জানিয়ে দিল, তারা দুঃখিত, ব্যথিত, হতাশ যে, বাংলাদেশে আপাতত তাদের আসা হচ্ছে না!
৬.
গত বছরের একদম শেষ দিকে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটি ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। ভারত তখন অস্ট্রেলিয়া সফরে। টেস্ট সিরিজ চলছিল। দুই দলের পরের টেস্টটা ছিল সিডনিতেই। সিডনির ওই ঘটনার পর তারা খেলতে ভয় পাচ্ছে কিংবা খেলবে না- এমন কোনো কথা শোনা যায়নি! ক্রিকেট-মিত্র বলে কথা!
আমাদের জন্য বেদনার ও অস্ট্রেলিয়ার জন্য লজ্জার কথা হলো, যেদিন নিরাপত্তার অজুহাতে তারা বাংলাদেশ সফর বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাল, ঠিক তার পরের দিনই, গত শুক্রবার (২ অক্টোবর) অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় মহানগর সিডনিতে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য পুলিশের সদর দপ্তরের বাইরে গোলাগুলিতে দুজন নিহত হয়েছেন! কী সেলুকাস তাই না!
অস্ট্রেলিয়ার এই সফর বাতিলের আরো ব্যাপকতর সমালোচনা হতে পারে অতীত ইতিহাস টেনে। অসিদের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে-- ২০০৫ সালের ৭ জুলাই (৭/৭) লন্ডনের আশেপাশে যখন সিরিজ বোমা হামলা হলো, তখন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ন্যাটওয়েস্ট চ্যালেঞ্জের প্রথম ওয়ানডেটা শুরু হতে কয়েক ঘন্টা। লিডসের ওই ম্যাচটা তো বাতিল হয়ইনি, উল্টো অস্ট্রেলিয়া তিন ম্যাচ সিরিজের শেষ দুটো ওয়ানডে খেলে লন্ডনের দুই বিখ্যাত স্টেডিয়াম লর্ডস ও ওভালে। প্রথম ম্যাচটা হারার পর এই দুটো ম্যাচ জিতে সিরিজও জিতে নেয় অস্ট্রেলয়া!
শুধু তাই নয়, ২১ জুলাই লন্ডনের পাতাল ট্রেনে আরেকটি বোমা হামলা হয়। সেদিনই আবার লর্ডসে শুরু হয় সেই অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট। ওই টেস্ট তো হয়েছেই, একটা টেস্টের সময়সূচি এদিক-ওদিক হয়নি। উল্টো খেলা দেখে বুঝার উপায় ছিল না যে, খেলোয়াড়রা আতঙ্কে আছেন! ইংল্যান্ড সিরিজটা ২-১ ব্যবধানে জিতলেও, উভয় দলের ক্রিকেটাররা ওই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে এমন খেলা উপহার দিয়েছিলেন যে, ২০০৫ সালের সিরিজটা ‘ইতিহাসের সেরা অ্যাশেজে’র মর্যাদা পায়! কীভাবে সম্ভব!
তাহলে তো বলতেই হয়, অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড অন্য দেশের মাটিতে সিরিজ বাতিলের রংঢং করে, অথচ নিজেদের বেলায় সবই ঠিক আছে! ইংল্যান্ডই আবার ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর দেশে ফিরলেও, কিছু দিনের মধ্যে দুটি টেস্ট খেলতে ঠিকই ভারতে যায়। অন্য কোন দেশ হলে ইংলিশরা কি যেত?
অস্ট্রেলিয়া সম্প্রতি যে 'টেরর অ্যালার্ট ইনডেক্স' প্রকাশ করেছে, তাতে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আছে ২৩তম অবস্থানে। ভারত আছে ৬-এ। বাংলাদেশের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আছে ২৫-এ। তাহলে কি এসব দেশে সফর বাতিল করতে হবে?
পশ্চিমী রাজনীতির গডফাদার যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগনে গত বৃহস্পতিবারই একটি কলেজে ঢুকে গুলি চালিয়ে অন্তত ৯ জনকে হত্যার পর পুলিশের গুলিতে নিজেও নিহত হয়েছে এক বন্দুকধারী। যুক্তরাষ্ট্রে হরহামেশাই এমনটা ঘটছে। সেটারই যেন সরল স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় অসহায় প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মুখে--'আমরাই বোধহয় পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যেখানে কিছুদিন পরপর গুলি করে গণহারে মানুষ মারা হয়।' এসব ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় কঠোর আইনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার যে বিধান আছে, তা যুক্তরাষ্ট্রে প্রণয়ন করার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। যুক্তরাজ্য-অস্ট্রেলিয়ায় আইন কঠোর, তবুও এমনটা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র নিজের সমস্যায় জেরবার। অথচ, এই দেশগুলোই বাংলাদেশের ঘটনায় প্রায় সময়ই উদ্বিগ্ন হয়। একের পর এক বিবৃতি দেয়। কী সেলুকাস!
উপরের প্রায় সব উদাহরণই ভয়াবহ। সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশে কিন্তু এ রকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তবুও অস্ট্রেলিয়ার এই সফর বাতিল করাটা আসলে অশোভন ও বাড়াবাড়িই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত খারাপ হয়ে যায়নি যে, এখানে পাকিস্তানের মতো ক্রিকেট খেলা যাবে না।
আসলে অস্ট্রেলিয়ানদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিকভাবে নাক উঁচু স্বভাবটাই এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বিসিবি সভাপতিও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কথাই বললেন শুনলাম। তার কাছে নাকি মনে হয়েছে, এই সফর স্থগিতের সিদ্ধান্ত অস্ট্রেলিয়া সরকারের, ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার না। সিদ্ধান্তটা যে রাজনৈতিক এটাই সত্য।
নিরাপত্তা ও ক্রিকেটকে মিলিয়ে ইতিহাসগুলো ঘাটলে দেখা যাবে, এত ঠুনকো নিরাপত্তাইস্যুতে এর আগে কখনই কোনো দেশ তাদের সফর বাতিল করেনি।
৭.
অস্ট্রেলিয়ার এই না-আসাটা খুব ভালো সংকেত নয়। অতীতেও, ২০১৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। ভারত দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে গড়িমসি করেছিল। কিন্তু, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে খেলা ঠিকই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। এ বছরই পাকিস্তান, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা নির্বিঘ্নে খেলে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা পেসার ডেল স্টেইন তো বৃষ্টিতে ফুটবল খেলার লোভ সামলাতে না পেরে নিরাপত্তার বেড়াজাল ছিন্ন করে শিশুদের সঙ্গে মাঠে নেমে শিরোনামও হয়েছিলেন! বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের আচরণের কারণে ভারতের বিপক্ষে বিশাল জনরোষ ছিল এ দেশে। কই কোন দুর্ঘটনা তো ঘটেনি! ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া নিজেও অতীতের নিরাপত্তার ব্যাপারে বাংলাদেশকে বাহবা দিয়েছে। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে সেগুলো ছিল 'জুতা মারার আগে গরু দান!'
অস্ট্রেলিয়া না এসে যে নজির গড়ল সেটা বাংলাদেশকে ভোগাবে না তার গ্যারান্টি কোথায়? আগামী মাসে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) আছে। অস্ট্রেলিয়ার এই আচরণ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের বিপিএলের সময় বাংলাদেশে আসতে না চাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? নভেম্বরে ফুটবল বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলতে আসার কথা অস্ট্রেলিয়ারই ফুটবল দলের।আগামী বছরের শুরুর দিকে আছে অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এসব ইভেন্ট অনিশ্চিত হয়নি, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
পাকিস্তান থেকে ক্রিকেটকে তো আন্তর্জাতিকভাবে এক প্রকার নির্বাসিত করাই গেছে। সঙ্গত কারণও আছে তাতে। তবুও তাদের আরব আমিরাত আছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সুকৌশলে এমন কিছু করা হলে, আমরা কোথায় যাব! ক্রিকেট বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা। ক্রিকেট আমাদের সংস্কৃতির অংশ। আমাদের ক্রিকেট তো উদ্বাস্তু হবে! আজকের যুগে মানুষ উদ্বাস্তু হলে, তার সংস্কৃতিও উদ্বাস্তু হয়!
৮.
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া শ্রীলঙ্কায় খেলতে যায়নি নিরাপত্তার অজুহাতে। সেই শ্রীলঙ্কাই ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিয়েছিল লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে। জবাবটা ছিল সমুচিত। বাংলাদেশকে এখন সেই সমুচিত জবাবটা দেওয়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তার আগে দেখতে হবে, পশ্চিম বাংলাদেশকে ‘জঙ্গির দেশ’ বানিয়ে পাকিস্তানের মতোই সবকিছু স্থবির করে ফেলে কি না! অথচ, কোনোভাবেই কিন্তু বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়; পাকিস্তানের মতো হওয়ার আশঙ্কা এত দ্রুত করাও ঠিক নয়। বরং, আশাবাদী হওয়া যায়, প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক শক্তি বাংলাদেশকে সেই পথে যেতে দিবে না। আমাদের বড় দুই দলের দোষারোপের খেলা হয়তো থামবে না, যেমনটা আমরা সাম্প্রতিক ইস্যুতেও দেখলাম; তবুও কারও সিঁধকাটা দেখার অপেক্ষায় তো বাংলাদেশ বসে নেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নিশ্চয়ই পথ হারাতে পারে না।
৯.
অস্ট্রেলিয়া সরকার নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা করেছে তাভেলা-হত্যাকাণ্ডের তিনদিন আগে। তিনদিন পরই এমন একটা দুর্ঘটনা। পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক বিবৃতি। তার পরের দিন আবার আইএসের স্বীকারোক্তি। সবকিছুকেই মনে হচ্ছে যেন একটা সাজানো পাণ্ডুলিপি! বাংলাদেশকে নিয়ে যেন ষড়যন্ত্রের পাণ্ডুলিপি সাজিয়ে রেখেছে পশ্চিমী রাজনীতির মোড়লরা! অস্ট্রেলিয়ানদের রাজনীতি তার থেকে ভিন্ন কিছু কি?
লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী ।