হত্যাকাণ্ড
সন্তান হারানো বাবাদের আকুতি
সন্তানহারা এক হতভাগ্য বাবা বললেন, ‘আমার ছেলে খুন হয়েছে কিন্তু কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি কোনো বিচার চাই না’। গত শনিবার বিকেলে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। একই দিনে ওই সময়ে লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বরের প্রকাশ আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ আরো দুজনের ওপর দৃর্বৃত্তদের হামলা হয়। টুটুলদের খবর গণমাধ্যমে দেখার পরপরই ছেলে দীপনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। ফোন বন্ধ থাকায় শঙ্কিত বাবা ছুটে আসেন জাগৃতি প্রকাশনীতে। বাইরে থেকে শাটারে তালা লাগানো দেখে আরো শঙ্কিত হয়ে পড়েন বাবা, হঠাৎ করে কোথায় গেল ছেলে কাউকে কিছু না বলে? দুপুরে বাবার পরীবাগের বাসাতেই বাপ-ছেলে একসঙ্গে ভাত খেয়েছেন। এমন কী জরুরি প্রয়োজন পড়ল ফোন বন্ধ করে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেল ছেলে? পরে যখন প্রকাশনী কার্যালয়েই ছেলেকে পেলেন কোনো কিছু জানতে চাওয়ার আর সুযোগ পেলেন না, নীরব নিথর ছেলের মৃতদেহ নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হলো তাঁকে। পরম মমতায় ছেলেকে আগলে থাকলেন বাবা গত দুদিন। ছেলেকে যত্ন করে কবরে শুইয়ে তারপর তাঁর ছুটি মিলল। ছেলের জন্মের সময়েও নিশ্চয়ই বাবাকে এভাবেই ছুটোছুটি করতে হয়েছে, ছেলে হওয়ার সুসংবাদ আত্মীয়পরিজনদের যেভাবে জানিয়েছিলেন ছোটাছুটির ফাঁকে, ছেলের মৃত্যুর সংবাদটিও তাঁকেই জানাতে হয়েছে কষ্ট বুকে চেপে। শুধু তাঁর মতো সন্তান হারানো বাবাই বুঝতে পারবেন সেই কষ্টের তীব্রতা। আমাদের সেই কষ্ট বোঝার সাধ্য নেই। বৃদ্ধ বাবা তাঁর যুবক ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে হেঁটে স্বস্তি পান অথচ সেই বৃদ্ধ বাবার কমজোরী কাঁধেই ভার নিতে হলো সন্তানের। সেই ভার যে কতটা ভারী, শুধু বাবাই বুঝেছেন।
সদ্য সন্তান হারানো বাবাকে যখন সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি মামলা করবেন কি না-তিনি এর জবাবে বলেছেন, ‘মামলা করার প্রয়োজন বোধ করি না। হয়তো বা নিয়মের কারণে মামলা করতে হবে। কিন্তু কী লাভ? আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা।’ সন্তান হারানো বাবার এই উক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলো। এমনকি তাঁর বিচার না চাওয়াটাকে খুনিদের মতাদর্শের সঙ্গে মিলে যায় বলেও সমালোচনা করতে ছাড়লেন না রাজনীতিবিদরা। কিন্তু জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা তো কোনো সাধারণ লোক নন, তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি কেন বিচার চাওয়াটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তারও ব্যাখ্যা কিন্তু তাঁর বক্তব্যেই দিয়েছেন।
একের পর এক ব্লগার খুন, এরপর সঙ্গে যুক্ত হলো যারা সেই ব্লগারদের লেখা বই আকারে প্রকাশ করেছেন তাঁদের হত্যার পালা। একজন শিক্ষক হয়ে পিতৃস্নেহে অন্ধ না হয়ে তিনি সবার কথাই ভেবেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যারা হামলা করেছে তাদের রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। এ কারণেই এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন, উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন।’ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক একজন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তিনি নিরপেক্ষ রাজনীতি চিন্তা ও তত্ত্বের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর রচনা স্বদেশ ভাবনা ও রাজনৈতিক চিন্তায় ঋদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা মানে সমাজ প্রগতির বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের উসকে দেওয়া। যেহেতু দেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষই ধর্মানুগত, তাই তাদের বিশ্বাসে সরাসরি আঘাত দিলে তাদের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতা হারাতে হয়, সমাজ কুসংস্কার থেকে মানুষকে আলোর পথে আনার কাজ তাতে বাধাগ্রস্ত হয়। তিনি সমাজ সংস্কারের ধারায় ‘চার্বাক মতাবলম্বী’ লোকায়াত নামে একটি মননশীল পত্রিকা ১৯৮২ সাল থেকে সম্পাদনা করছেন।
ছেলের খুনের সঙ্গে কারা জড়িত থাকতে পারে, এই প্রসঙ্গে আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘বিষয়টা অত্যন্ত স্পষ্ট। লালমাটিয়ায় যারা হামলা করেছে, তারাই দীপনকে হত্যা করেছে। দীপনের বন্ধু ছিল অভিজিৎ। ওর বইও দীপন বের করেছে। তবে সে ধর্মের বিরুদ্ধে কখনো লেখেনি। কোনো উসকানিও দেয়নি। কখনো কারো সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করেনি। কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত শত্রুতাও নেই।’
শুধু তাই নয়, দীপনের জাগৃতি প্রকাশনী থেকে অভিজিৎ রায়ের যে বইটি বেরিয়েছে তা একেবারেই বিজ্ঞানের একটি একাডেমিক বই। যার সঙ্গে ধর্ম কিংবা নাস্তিকতার কোনো যোগসূত্র নেই।
দীপনের মৃত্যুতে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের মর্মবেদনা একই সুরে বুকে বেজেছে আরেক হতভাগ্য বাবার, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়। যিনি আট মাস ধরে সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সদস্যদের কাছে ছেলের হত্যাকারীদের ধরার অগ্রগতির খবর নিতে নিতে ক্লান্ত। দীপন শুধু তাঁর ছেলের বন্ধুই নয়, দীপনের বাবা যে তার সহকর্মী। অনুজ সহকর্মীর তাঁর মতোই করুণ পরিণতি দেখে তিনি হতবাক। তিনি শুধু একটা কথাই বলছেন, অভিজিতের যে বই প্রকাশ করেছিল দীপন সেটা তো ধর্ম নিয়ে কিছু লেখা হয়নি, তাহলে দীপনের ওপর এই আঘাত কেন? উত্তরও তিনি নিজেই দিলেন, আসলে মুক্তচিন্তার সব মানুষকে ভয় দেখাতেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এর জন্য অবশ্য তিনি দায়ী করলেন দায়িত্বশীল মহলের উদাসীনতাকেই। ‘একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ববান ব্যক্তি যখন বলেন টার্গেটেড পারসনকে নিরাপত্তা দেওয়া কঠিন, তখন তিনি হত্যাকারীদেরকেই আশকারা দিলেন, নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালাতে কারণ প্রশাসনের মুরোদ নেই টার্গেটেড পারসনকে রক্ষা করার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক অজয় রায় দেশে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পেছনে কাজ করে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ গড়ে তোলেন। তিনি মুক্তান্বেষা নামক একটি পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন, যার লক্ষ্য হচ্ছে সমাজে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং মানবকল্যাণবোধ প্রতিষ্ঠা। তিনি বাংলাদেশের কৃষক-দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত করার পেছনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার সংক্রান্ত গবেষণামূলক বিভিন্ন লেখালেখিও তিনি করেছেন। সম্প্রতি এই দেশে যে প্রথম সুফিবাদী ইসলামের প্রচার হয়েছিল আর বর্তমানে কিছু উগ্রবাদী ইসলামী সংগঠনের লেবাসধারী দুর্বৃত্তরা বাইরে থেকে উগ্রবাদী আমদানির পাঁয়তারা করছে সে বিষয় নিয়ে লেখালেখি করছেন। ইসলাম সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রচার হচ্ছে এই অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে তো বিরুদ্ধ মতের কাউকে হত্যা করার অধিকার দেওয়া হয়নি। কোরআনে জিহাদ সম্পর্কে যা বলা আছে, তার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। এখানে জিহাদ অর্থে বিরুদ্ধ মতবাদে বিশ্বাসীদের আত্মাকে জয় করার কথা বলা হয়েছে, তাকে খুন করা নয়।’
অজয় রায় মনে করেন, দেশে একটি নিষ্ঠুর ও অস্ত্রধারী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। প্রগতিশীল লেখক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ব্লগারদের প্রতি তারা নিষ্ঠুর মনোভাব পোষণ করছে। একের পর এক প্রগতিশীল লেখকদের হত্যা করছে। হত্যাকারীরা মনে করছে তারা ইসলামের সেবা করছে, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ করছে। তারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সারা দুনিয়ার কাছে বাংলাদেশের মতো একটি শান্তিপ্রিয় দেশের বদনাম করছে।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়া অজয় রায় এতকিছুর পরও ভেঙে পড়েননি। রাজনীতিবিদদের নোংরা স্বার্থান্বেষী দ্বন্দ্বে দেশে উগ্রবাদিতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বলে মনে করেন তিনি। ছেলে হারানো এই বাবা মনে করেন, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় পক্ষের জন্যই এই উগ্রবাদিতা নিয়ে ভয়ংকর খেলা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে।
চারপাশে মৃত্যুর মিছিল আর খারাপ কিছুর আশঙ্কায় যখন শুধুই হতাশার দীর্ঘনিশ্বাস, প্রশ্ন করেছিলাম তাহলে কি স্যার কোনোই আশা নেই, কী হবে তাহলে দেশটার? বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও চোখের দীপ্তি এখনো অনেক উজ্জ্বল অজয় রায়ের। তিনি জীবনের সবচেয়ে গর্বের, সবচেয়ে অহংকারের সময় ১৯৭১ সালের কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘দেখো, মুক্তিযুদ্ধের সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর আমি মনে করি সেই শক্তিটাকেই আমাদের দেশের মানুষের এখন কাজে লাগানোর সময় এসেছে। যারা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে দিনভর বুলি কপচায় আমি তাদের কথা বলছি না, যারা এই শক্তিটাকে মনের মধ্যে লালন করে আমি তাদের কথা বলছি, এ দেশের তরুণ প্রজন্মের কথা বলছি। আমাদের সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। আবার প্রতিজ্ঞা করে নতুন করে লড়াইয়ে নামতে হবে। এই লড়াই শুধু সেমিনার, মিটিংয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না, আমাদের রাজপথে নামতে হবে। সংগ্রাম হবে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংগ্রাম। আমরা দেখছি বাংলাদেশের গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। দেশকে সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক করতে হলে আন্দোলন ছাড়া কোনো পথ নেই।’
কত সুন্দর কথা বলেছেন পুত্রশোকে কাতর দুই বাবা। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা শুধু নিজের সন্তানের কথাই ভাবছেন না, তাঁরা ভাবছেন শিক্ষকের মতো করেই তাঁদের অগণিত সন্তানদের কথা। দুই বাবাই বললেন, এই দেশ যখনই কোনো সংকটে পড়েছে, সেই ষাটের দশকের আন্দোলনে ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে শিক্ষকরা পথে নেমে এসেছেন। যদিও এখন অন্য পেশাজীবীদের মতো শিক্ষকরাও রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়ে কামড়াকামড়ি করছেন স্বার্থের দ্বন্দ্বে, তবে এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। সময়ের প্রয়োজনেই সবাইকে আবার এক হতে হবে, দেশটাকে বাঁচাতে হবে।
আমরা সবাই কি পারি না শোকাহত দুই বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।