প্যারিস হামলা
স্বপ্ন ও আতঙ্কের রাত জাগল গোটা ফ্রান্স
কাল সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। যতবার চোখের দুটো পাতা এক করার চেষ্টা করেছি, ততবার প্যারিসের ফুটপাতে সারি সারি মৃতদেহর ছবিটা ভেসে উঠেছে৷ বস্তুত, আমার মতোই গোটা ফ্রান্স কাল এক দুঃস্বপ্নের রাত কাটিয়েছে৷ এতদিন প্যারিসে আছি, এই রকম একটা দৃশ্যের মুখোমুখি হব, এটা কখনো কল্পনায় আসেনি। মূকাভিনয় করি। এখন বিভিন্ন দেশে বহু চলচ্চিত্রেও অভিনয় করছি। ফলে বিভিন্ন দেশে বহু মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। বহু সাংবাদিককেও চিনি। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সারা রাত তাঁরা আমায় ফোন করেছেন। তাঁদের মর্মন্তুদ দৃশ্যের বর্ণনা দিতে হয়েছে। ফ্রান্সের সমাজ অনেক উদার ও সহিষ্ণু।
ছয় কোটির এই দেশে ৮০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু বাস করেন। এদের সব অধিকার রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করে। তবু কিছু যুবক বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ফ্রান্সের সীমান্তও বরাবর উন্মুক্ত। সেনঝেন ভিসাভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সীমানার বেড়াজাল নেই। উত্তরে বেলজিয়াম সীমান্ত দিয়ে দেশে জঙ্গি অনুপ্রবেশের কথা কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম। এই মাসের শেষে প্যারিসে জলবায়ু নিয়ে একটি সম্মেলনে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের আসার কথা। শুনছিলাম এই কারণে নাকি সীমান্তে কড়াকড়ি হচ্ছিল। এর মধ্যেই ঘটে গেল এই ভয়ংকর ঘটনা।
জানুয়ারি মাসে শার্লি এবদোর দপ্তরে জঙ্গি হামলার পর দেশের একটি অংশ থেকে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছিল। কিন্তু এখানকার উদার চিন্তাধারা সেই সব ব্যবস্থার পথে অন্তরায় হয়। এরা প্রত্যেককেই সংশোধনের সুযোগ দিতে চায়। সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, সিরিয়া, ইরাক, লেবাননে ফ্রান্স যেভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছে, তারই পরিণাম হিসেবে এই সন্ত্রাসবাদী হামলা। এর শিকার হতে হলো নিরীহ ফরাসিদের, যাঁরা প্রত্যেকে খুব উদার মনোভাবের।
দেশে কাল রাত থেকে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতির কখনো মুখোমুখি আমরা হইনি। রাস্তাঘাট সুনসান। খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আজ কেউ বেরোয়নি। জানি না এই পরিস্থিতি কতদিন চলবে। টেলিভিশনে বারবার বলা হচ্ছে কেউ যেন রাস্তায় না বেরোয়। আমি প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলিতে থাকি। রাস্তায় সেনা ও আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা টহল দিচ্ছেন। চারদিকে একটা আতঙ্কের পরিবেশ। কাল রাতে যখন ফ্রান্স দ্য স্টেডিয়ামে বিস্ফোরণটি হয়, তার দুই কিলোমিটারের মধ্যে আমার মেয়ে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছিল। ওরা তো প্রথমে ভেবেছিল খেলার মাঠে বাজি পোড়ানো হয়েছে। পরে জঙ্গি হামলার খবর রটতেই দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে।
এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ছেলেমেয়েরা বাড়ি থেকে বেরোলেই না ফেরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকতে হবে। দেশে সমস্ত বড় ধরনের জমায়েত, খেলা, গান-বাজনার আসর আপাতত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু প্যারিস এগুলো ছাড়া বাঁচতে পারে না। দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেরানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে আবেদন জানানো হচ্ছে। বিভিন্ন ধর্মীয় নেতারাও শান্তিরক্ষার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছি সোমবার দেশের সর্বত্র মানুষ রাস্তায় মিছিল করে শুক্রবার রাতের ঘটনার প্রতিবাদ জানাবেন। মানুষ ফের রাস্তায় নামলে হয়তো প্যারিসও তার চেনা ছন্দে ফিরতে পারবে।
লেখক : ফ্রান্সপ্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাংলাদেশি মূকাভিনেতা ও অভিনয়শিল্পী। লেখাটি ১৫ নভেম্বর লেখা তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া হয়েছে।