সমবেদনা নয়, রাঙানো ফেসবুক-প্রোফাইল ভয়াবহতার প্রতীক
২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ মারা যায়। তবে কে বা কারা এই হামলা করেছিল তার কোনো হদিস মেলেনি। কিন্তু কর্তা-রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনভাবে ঢাক-ঢোল পেটাতে থাকে যে, হামলার পুরো দায় এসে পড়ে তালেবান জঙ্গিদের ওপর। আর এই জঙ্গি কারা? মুসলমান। কর্তারাষ্ট্রের এই ঢাক-ঢোল পেটানো সার্থকতা পায় তখনই, যখন সারা পৃথিবীর মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয় জঙ্গি বলতে শুধুই মুসলমান। আর সেই মুসলমানরা কত ভয়াবহ, নির্মম; পৃথিবীর জন্য কত বড় হুমকির।
গত ১৩ নভেম্বর শুক্রবার ফ্রান্সের প্যারিস ও আশপাশের ছয়টি স্থানে হামলা করে সন্ত্রাসীরা। এই সন্ত্রাসী হামলায় আনুমানিক ১২৯ নিহত ও তিন শতাধিক মানুষ আহত হয়। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার ফলে মুসলমান সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, ফ্রান্সের প্যারিসে সেই ধারণায়নেরই পুনরাবৃত্তি করে। অর্থাৎ মুসলমানরা যে কত ভয়াবহ, নৃশংস তা আবারও উঠে আসে। ফেসবুকে ফ্রান্সের পতাকার রঙে নিজেদের রাঙালে সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্যকে আরো বদ্ধমূল করে। কারণ ফেসবুকে ফ্রান্সের পতাকার রং যতটা না সমবেদনার অর্থ বহন করে, তার চেয়ে বেশি করে মুসলমানদের ভয়াবহতা-নৃশংসতার। তাই হয়তো ফ্রান্সের পতাকার রঙে ফেসবুক প্রোফাইল রাঙানোর মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই।
বিষয়টি আরো একটু পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। বর্তমান সময়ে কোনো একটা ঘটনা ঘটলেই ফেসবুক তাকে কোনো একটা রং দিয়ে বিশেষায়িত করতে চায়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে সমকামীদের বিবাহের বৈধতা দিলে ফেসবুক রংধনু সাত রং দিয়ে তার ব্যবহারকারীদের প্রোফাইল রাঙানোর ব্যবস্থা করে দেয়। অর্থাৎ রংধনুর সাত রং সমকামীদের জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, এটা কী অর্থ তৈরি করে? হয়তো বলতে হবে, সমকামীদের যে আমাদের সমাজে ‘ভিন্ন’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় সেই ভিন্নতাকেই আরো বদ্ধমূল করে। তা নাহলে তাদের জন্য আলাদা রং লাগবে কেন?
ঠিক একই ঘটনা ঘটে প্যারিসের সেই হামলার ঘটনার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ফ্রান্সের পতাকার রাঙানো কোনো ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রোফাইল দেখলে হামলায় নিহতদের প্রতি যেমন সমবেদনার চেয়ে মুসলিমরা যে কত ‘ভয়ংকর’ সেটাই আপনাকে বারবার মনে করিয়ে দেবে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ফেসবুক এই ভয়ংকর দায়িত্ব কেন নিতে যাবে? আমাদের মনে রাখতে হবে, ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতার একজন ও বর্তমান প্রধান হলেন মালিক মার্ক জুকারবার্গ। তিনি যেমন একজন পুঁজিপতি তেমনই ফেসবুকও একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি ফেসবুকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী যার আয় যার ১২.৪৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তা ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গণমাধ্যম যে কয়েকটি রয়েছে তার মধ্যে ফেসবুক অন্যতম। এই ফেসবুক ব্যবহার করে যদি কৌশলে পুঁজিপতিদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে পুঁজিপতি মার্ক জুকারবার্গ সেই সুযোগটি ছাড়া করবেন কেন? তাই ফেসবুকে ফ্রান্সের পতাকার রঙে প্রোফাইল রাঙিয়ে পুঁজিপতিদের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছেন মার্ক জুকারবার্গ বা ফেসবুক।
এখন পুঁজিপতিদের ফায়দার জায়গাটা নিয়ে দুটি কথা বলা যাক। যে সন্ত্রাসীরা ওই দিন প্যারিসে হামলা করেছিল তারা নাকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, ওই সন্ত্রাসীদের হাতে যে অস্ত্রগুলো পাওয়া গেছে সেগুলো এলো কোথা থেকে? এখানে এসে বিষয়টি নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে যায়, পশ্চিমের পুঁজিপতি যে কয়েকটি রাষ্ট্র অস্ত্র ব্যবসা করে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ধরে রেখেছে তাদের সঙ্গে ওই সন্ত্রাসীদের আতাত রয়েছে।
এখানে আরেকটা বিষয় সংক্ষেপের অবতারণা করেই শেষ করব। কোনো কিছু যখন ভয়াবহ-নৃশংস হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, তখন তাকে নির্বিচারে হত্যা করলে, নির্যাতন করলে কারো মনে কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তাই এই সন্ত্রাসী হামলার পর ফ্রান্সের এক মুসলিম শরণার্থী শিবিরে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে প্রায় ৪০টি মুসলিম শরণার্থীর ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা পশ্চিমা গণমাধ্যমকে খুব বেশি আলোড়িত করতে পারেনি। হয়নি তেমন কোনো সমালোচনা। অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রে আরো কিছুদিন পশ্চিমারা লুটপাট, গণহত্যা চালালেও তা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন উঠবে না। এটা অনেকটাই স্পষ্ট। আর এই সামাজিক সম্মতি উৎপাদনে পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের অংশ হিসেবেই কাজ করছে ফ্রান্সের পতাকার রঙে রাঙানো ফেসবুক-প্রোফাইল।
লেখক : সাংবাদিক