সোজা কথা
নীরবরা কি নীরবেই চলে যাবে শুধু?
বুড়িগঙ্গা থেকে যখন ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা তাকে কোলে নিয়ে পাড়ে এলো, দেখে মনে হচ্ছিল ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। চোখগুলো আধো খোলা, মুখটা সামান্য হাঁ করা।মুখ দিয়ে তখন ফেনা আসছিল।
ওর সারা শরীর যেন ক্লান্ত, বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে শিশুটি। তার জীবনমৃত্যু যে ডাক্তাররা নিশ্চিত করেছেন তাদের ভাষ্য অনুযায়ী ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশি সময় তাকে কষ্ট করতে হয়নি, যে বিষাক্ত নোংরা পানিতে সে পড়েছিল তাতে একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষই বেশিক্ষণ নিশ্বাস প্রশ্বাস চালাতে পারে না। এমনকি যে উদ্ধারকর্মীরা তাকে খুঁজতে পানিতে নেমেছিল তারাও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কি ভয়ঙ্কর!কি কষ্টকর!যারা সেদিন টেলিভিশনে সরাসরি দেখছিলেন শ্যামপুরের ম্যানহোলে পড়ে যাওয়া পাঁচ বছরের শিশু নীরবের উদ্ধার তৎপরতা, তাঁরা নিঃসন্দেহে সেই রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেননি। সবার মনই নিশ্চয়ই বারবার কেঁদে উঠেছিল, আহারে বাচ্চাটা কত কষ্ট পেয়েছে। নীরবের বয়সী শিশু যার ঘরে আছে সেই মা অজানা আশঙ্কায় নাড়িছেড়া প্রিয় সন্তানটিকে আরো বেশি আকড়ে ছিলেন।
শ্যামপুর ঢাকা সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত নয়। একটি ঘনবসতি ইউনিয়ন। নীরবরা যেখানে ভাড়া থাকত সেই বাড়িটি রেললাইনের খুব কাছেই। পাকা রাস্তা দূরে থাক, মাটির যে সরু রাস্তা সেটাও আবার আবর্জনায় ভরা। বাড়ির পাশে খাল।যদিও সে খাল ভরাট হয়ে গেছে আবর্জনায়।ইউনিয়ন পরিষদেরও আবর্জনা ফেলার জন্য নির্দিষ্ট ডাস্টবিন থাকার কথা, বর্জ্য অপসারণের জন্য কর্মী বাহিনীও আছে কাগজ-কলমে যদিও তার কোনো সুফল কখনোই পান না ইউনিয়নবাসী।আর রাজধানীর লাগোয়া এই ইউনিয়নটিতে প্রচুর সংখ্যক শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় স্বাভাবিকভাবে ঘনবসতি হয়ে উঠেছে এলাকাটি।শিল্পকারখানাগুলো তাদের বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য কোনো রকম প্রক্রিয়াজাত না করেই সরাসরি নদীতে ফেলত।মাত্র ৩-৪ বছর আগে এখানকার শিল্প মালিক সমিতি ইউনিয়ন পরিষদের অনুমতি নিয়ে পাইপলাইন বসিয়ে শিল্প বর্জ্য নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করে। যদিও তারা শিল্পবর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলতে পারে না, কারণ এটা নদীর পানিকে দূষণ করছে কিন্তু কে শোনে কার কথা আর তাদের ধরবেই বা কে!যাই হোক, এভাবে শ্যামপুরের বিশাল এলাকাজুড়ে পাইপলাইন বসানো হয়েছে কিন্তু পাইপলাইনগুলোতে ঢাকনা নেই দীর্ঘদিন। যেমন নীরবদের বাসার সামনে যে পাইপলাইন তা খোলা ছিল দীর্ঘদিন থেকে। এখানে স্থানীয়রা ময়লা ফেলে জায়গাটি ঢেকে ফেলেছে।আর যেসব ঢাকনা বসানো হয়েছে সেগুলোও কিছুদিন পরপর ভেঙে যায়।স্থানীয়রা বারবার ইউনয়ন পরিষদে অভিযোগ জানিয়েও কোনো ফল পায়নি।ইউনিয়ন পরিষদ দায় চাপিয়েছে শিল্প মালিক সমিতির ওপর। এ ক্ষেত্রে শিল্প মালিক সমিতির এসব পাইপলাইন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকলেও তাদের ধরা স্থানীয়দের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় কারণ তারা হলো প্রভাবশালী মহল, তাদের কথাতে ইউনিয়ন পরিষদও ওঠে-বসে। এই সুযোগে ইউনিয়ন পরিষদও গাঁ বাঁচিয়ে চলে। শ্যামপুরে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে, বর্ষাকালে এলাকার ভোগান্তি তো সীমা ছাড়িয়ে যায়। রাস্তায় নেই কোনো ল্যাম্পপোস্ট। ভাঙা ম্যানহোলে ভরা এই এলাকায় নিম্নআয়ের মানুষরা কতটা মানবেতর জীবন কাটায়, ওই এলাকায় না গেলে তা বুঝতে পারবে না কেউ। অথচ এলাকার সেবক হিসেবে কিন্তু আছেন অনেক গণমান্য ব্যক্তি। আছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, আছেন চেয়ারম্যান, মেম্বার আরো কত কী। এলাকার অভিভাবকরা ব্যস্ত তাদের নিজেদের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আর এলাকার সমস্যার কথা তাঁদের জিজ্ঞেস করলেই এক বয়ান, ফান্ড দেয় না সরকার, কীভাবে এলাকার উন্নয়ন করব!
নীরব যে ম্যানহোলে পড়ে গিয়েছিল সেখানে আগেও একজন পড়ে মারা গেছে। তবে নীরবের দুর্ঘটনাটি মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় অন্ধকারের শ্যামপুরের ক্ষতচিহ্ন প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে।আবার কোনো বড় ঘটনার নিচে এই দুর্ঘটনা চাপা পড়ে যাওয়ার আগেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে শিল্প মালিক সমিতিকে, স্থানীয় প্রশাসনকে।তাদের দায়িত্বহীনতার কারণেই আজ নীরবের মা সন্তানহারা। শুধু এখানেই তাদের অপরাধ শেষ হয়ে যায় না।প্রতিনিয়ত তারা টনকে টন বিষাক্ত নোংরা শিল্প বর্জ্য ফেলছে বুড়িগঙ্গা নদীতে।তাদের এই অন্যায়ের দায়ভার পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তর যাদের ছাড়পত্র ছাড়া এত বিশাল পরিমাণ শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলা সম্ভব নয়। এর দায়ভার এড়াতে পারে না শিল্প মন্ত্রণালয়ও।সবাই যদি যারা যার জায়গায় তাদের দায়িত্বটুকুও সঠিকভাবে পালন করত তাহলে আজ এই দুর্ঘটনা ঘটত না।শ্যামপুরের মানুষের মনে আজ যে ক্ষোভ আর হতাশা জমেছে তার বহিঃপ্রকাশ যেকোনোদিন, যেকোনোভাবেই হতে পারে।
আর মাত্র কয়েকদিন পরই আসছে নতুন বছর। নীরবের এবারে স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। নতুন জামা জুতো পায়ে নতুন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নীরব স্কুলে যেত। নতুন বছর আসবে, সময় থেমে থাকবে না।
শুধু নীরবের হতভাগ্য মা বাবার কাছে চিরদিনের মতো থমকে গেছে সময়। নীরবের মা বাবা তাদের ছেলের এই অপমৃত্যুর জন্য বিচার চায় না। কারণ তারা জানে বিচার চাওয়ার অপরাধে তাদেরই ভুগতে হবে।এটাকি নিছকই তাদের অভিমানের কথা? না, তাদের সামনে জলজ্যান্ত প্রমাণ আছে। গত বছরের ঠিক এই মাসের ২৬ ডিসেম্বর শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনির মৈত্রী সংঘ মাঠের কাছে পরিত্যক্ত পানির পাইপের ভেতরে পড়ে গিয়েছিল জিহাদ নামের ছো্ট্ট একটি শিশু।৬-৭ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে ফায়ার সার্ভিস কাজ অসমাপ্ত রেখেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে স্বউদ্যোগে নিজেদের মেধা খাটিয়ে কিছু হৃদয়বান তরুণ জিহাদকে বের করে এনেছিল। ২৩ ঘণ্টার জিহাদের নিথর দেহ দেখে সেদিনও কেউ চোখের পানি সামলাতে পারেনি। কিন্তু এখানেই কি শেষ হয়েছিল জিহাদের মা-বাবার কষ্ট? না, বরং সেদিন জিহাদের বাবাকে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা থানায় নিয়ে গিয়ে আটকে হুমকি দিয়েছিল-ছেলেকে কোথায় লুকিয়ে রেখে পাইপে পড়ে যাওয়ার নাটক করছে সে এই অভিযোগে! একে ছেলেকে জীবিত ফিরে পাবে কি না তার আশঙ্কায় যখন হতভাগ্য বাবা দিশেহারা, সেই সময় কি না তার ওপরই ছেলে লুকানো অভিযোগ!অবশেষে ছোট্ট জিহাদ তার বাবাকে বাঁচাতেই যেন নিথর হয়ে পাইপ দিয়ে ওপরে ফিরে আসে। যদিও পরে আর জানা হয়নি সেই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এবং যাদের নির্দেশে তারা জিহাদের বাবাকে কষ্ট দিয়েছিল তারা কি মাফ চেয়েছিলেন? জিহাদের বাবার পরিণতিই নীরবের বাবাকে ছেলে হত্যার বিচার চাওয়া থেকে বিরত রেখেছে।এভাবেই হয়তো একসময় বিচার বিভাগের ওপর চাপ কমে যাবে, থানাগুলোতেও মামলার স্তূপ জমবে না। কারণ, যাঁরা অন্যায়ের শিকার হবেন তাঁরা সব মুখ বুজেই সহ্য করবেন, বিচার চাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাবেন না। সেদিন মনে হয় আর বেশি দূরে নেই যেদিন সরকার ঘোষণা দিতে পারবেন দেশে কোথাও কোনো অন্যায় অত্যাচার হচ্ছে না কারণ কেউ আর বিচার চায় না।
একবছর পর জিহাদ যেখানে মারা গিয়েছিল সেই জায়গায় গিয়েছিলাম। একই রকম পড়ে আছে, কোথাও কিছু বদলায়নি। শুধু জিহাদ যে পাইপে পড়ে গিয়েছিল সেটার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এলাকাবাসী অবশ্য ক্ষোভ ঝাড়লেন, এলাকার বেশির ভাগ ম্যানহোলে ঢাকনা নেই, ড্রেনেজ লাইনগুলো বিপজ্জনকভাবে ভেঙে গেছে। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।তাদের ক্ষোভ, জিহাদের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিলে আজ নীরবকে চলে যেতে হতো না।
জিহাদ-নীরবের দুর্ঘটনায় দুটো জিনিস খুব বেশি চোখে পড়েছে। একটা হলো ওয়াসা সিটি করপোরেশনের মতো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এর ফলে একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বেড়ায়। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীদের মধ্যেও পরিস্থিতি বুঝে চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো তৎপরতা এখনো গড়ে ওঠেনি। এজন্য অবশ্য তাদের পর্যাপ্ত মহড়া না হওয়াটা একটা বড় কারণ।
তারা যে শহরে কাজ করছে তার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান থাকতে হবে।তাদের সহযোগিতা করার মতো মানসিকতা অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলোরও থাকা প্রয়োজন।
আরেকটা বড় জিনিস যা খুব চোখে পড়ে সেটা হলো অহেতুক উৎসুক জনতার ভিড়।আমাদের মধ্যে এই সচেতনতাটাই নেই যখন উদ্ধারকারি বাহিনী কাজ করছে তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া দরকার। জিহাদ ও নীরবের দুটো ঘটনাতেই আমরা দেখি উৎসুক জনতার চাপে উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলে কাজ করতে হিমশিম খাচ্ছে, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স বের হতে কতটা বেগ পেতে হয়েছে। এ ব্যপারে আমাদের মধ্যে সচেতনতা প্রয়োজন। সেই সাথে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকেও সতর্ক হতে হবে, যাতে ঘটনাস্থল যতটা সম্ভব কর্ডন দিয়ে রাখা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশে ঘটনাস্থলের এত কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই।
জানি না, এত বড় দুর্ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষ চুপ করে বসে থাকবে, না কি সারা শহরের ভাঙা ম্যানহোলগুলো ঢাকনা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে? আর নীরবের ঘাতক হিসেবে শিল্প মালিক সমিতি, ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ