ক্রিকেট
তোমরা যারা পাকিস্তানের সমর্থক!
রক্তরাঙা ফাগুনে প্রিয় স্বাধীনতার মার্চ মাসটা ছুঁয়ে গেলেই বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে! নিজেকে মনে হয় একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। অনুভবে অনুরণন হয়, যেন ওরা আমার দেশ মাকে খামচে ধরে খুবলে খেয়ে চলেছে আর আমরা সেই রক্ত পিপাসু বর্বর পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করে চলেছি। এমন একটা পরিস্থিতিতে, ২৫ হাজার প্রাণোচ্ছল ও উজ্জীবিত দর্শকে ঠাসা শেরেবাংলার এক টুকরো সুন্দর বাংলাদেশে এই বাংলাভূমির সুবর্ণসন্তান বা ক্রিকেটের বরপুত্র বাঘেদের হাতে যদি পাকিস্তান বধের মহাকাব্য রচিত হয়, তবে আবেগ আতিশয্য কার না তুঙ্গে ওঠে?
সবুজ সুন্দরবন ছাড়িয়ে সাকিব, মুশফিক, সৌম্য, সাব্বির, মাহমুদুল্লাহ, আল আমিন বা মুস্তাফিজের মতো আমাদের দামাল বাঘেরা যখন দুর্দান্ত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার ছত্রছায়ায় থেকে ক্রিকেট পিচের ২২ গজ হয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে গর্বে বুক ভারী হয়ে উঠে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো আমাদের ‘চির উন্নত শির’ যেন হিমালয়েরই শিখর স্পর্শ করে।
আমাদের এই বাঘেরা ২ মার্চের লাল সবুজ পতাকা উত্তোলনের দিনে পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে দিয়ে ২০১৬ এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে তাদের অজেয় জাত চিনিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল মাথা নোয়াবার দিন শেষ হয়েছে সেই কবে! ২০১২ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালের শোকাশ্রু আর নয়, ২০১৬ সালের আনন্দাশ্রু এখন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ হয়েই ঝরবে। হে ক্রিকেটবিশ্ব! তোমাদের সমীহ এভাবেই আছড়ে পড়বে আমাদের ক্রিকেটের দ্বারে।
শাবাস বঙ্গ শার্দুলেরা! তোমাদের বিজয়গাঁথায় বাংলা মানচিত্রে সৃজিত হলো বাঁধনহারা উৎসবের আনন্দ উপাখ্যান। আগামীর ক্রিকেট রূপকথার একচ্ছত্র নায়ক তোমরাই। আমাদের উত্তরাধিকারের হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়বে তোমাদের ক্রিকেট গল্পকথা।
মাশরাফিদের মুখের দিকে চেয়ে এবার তোমরা যারা পাকিস্তান কর, তারা কি কবির সুমনের সুরে ‘প্রথমত, দ্বিতীয়ত, তৃতীয়ত বা শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ বলে বাংলাদেশ করবে না? হায় নতুন দিনের প্রাগ্রসর যুবা তরুণি এখনো কি লজ্জার মাথা খেয়ে বলবে, আফ্রিদি ম্যারি মি! তারচে বরং সোৎসাহে একবার বল না, ডিয়ার মাশরাফি, উই আর অলওয়েজ উইথ ইউ!
আমাদের অমৃত বাংলা ভাষা যারা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, একাত্তরে ৩০ লাখ মুক্তিকামী মানুষের প্রাণসংহারকে যারা ছেলেখেলা ভেবেছিল, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনাশ ছিল যাদের মজ্জাগত জন্মদোষ, সেই পাকিস্তান আমরা কী করে করতে পারি?
এখনো যারা অদ্ভূত গোয়েন্দা তৎপরতা ও জঙ্গি রপ্তানি করে আমার বাংলা মাকে অস্থিতিশীল করতে চায়, আমাদের মানবতাবিরোধীদের বিচারে যাদের দেশজুড়ে ভূকম্পন শুরু হয়, সেই পাকিস্তানকে সমর্থন আমরা কী করে করতে পারি?
যে দেশের রমিজ রাজারা আমাদের ক্রিকেট লিজেন্ড তামিম ইকবালদের নিয়ে মশকরা করে, যে দেশের জিও টিভিওয়ালারা আমাদের নারী ক্রিকেটারদের নিয়ে হাস্যরসের নামে অপমান করে, সেই পাকিস্তানকে আমরা কী করে সমর্থন করি?
৪৪ বছর আগে পরাভব না মেনে যে পাকিস্তানকে আমরা ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছি এবং তাদের চেয়ে আর্থ-সামাজিক সব সূচকে আমরা ওদের চেয়ে যোজন যোজন দূর এগিয়ে গেছি, এখনো গালে পতাকা এঁকে, গায়ে চাঁদ তারা মার্কা জার্সি পরে কী করে আমরা সেই পাকিস্তান করতে পারি?
না! আমরা পাকিস্তান করতে পারি না। আমাদের মাশরাফিরা ক্রিকেটীয় সৌন্দর্যে তাদের সত্যিকারের সামর্থ্য দেখিয়ে দিয়ে নিশ্চিতার্থেই বাংলাদেশের এ কালের তরুণ তরুণিসহ সবার মন জয় করে চলেছে। সব ক্ষেত্রেই মাথা হেট পাকিস্তানের, সমর্থন তবুও কেন করতে যাব আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আমরা?
বাংলার ব্যাঘ্রদের ধারাবাহিক বিজয়ে বিশ্ব ক্রিকেট লিজেন্ডরা এখন বলছেন, “আগামীতে বাংলাদেশকে নিয়ে ‘বিগ ফোর’ করার কথা ভাবতে হবে আইসিসিকে।” বলবেনই না কেন? কী নেই আমাদের? দর্শকের উন্মাদনা, ক্রিকেট ক্রেজ, মুস্তাফিজ বা সাকিবের মতো ক্রিকেট ট্যালেন্ট সব আছে আমাদের। গেল বিশ্বকাপে ভারতীয় শ্রীনিবাসের আইসিসি বাজে কলাকৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্যাকফুটে ফেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করেছিল। কিন্তু আমরা হার না মেনে আমাদের ক্রিকেট দ্যুতিকেই কেবল ছড়িয়ে দেইনি বরং এক বছরেই ষোলকলা চৌষট্টিকলার ক্রিকেট নিপুণতা দিয়ে আমরা বুঝিয়ে দিয়েছি পৃথিবীতে ইংল্যান্ড, ইন্ডিয়া বা অস্ট্রেলিয়া নামের বিগ থ্রি বলে কিছু নেই। আমরাও ক্রিকেটটা খেলতে জানি। ক্রিকেট বিশ্বকে আনন্দের বন্যায় ভাসাতে জানি।
ক্রিকেট রাজনীতি নয়, কিন্তু আমাদের ক্রিকেটীয় বোধ বা চেতনাই বলে দেয়, ভারত ও পাকিস্তান আমাদের কাছে সমান প্রতিপক্ষ, মিত্র নয়। আর প্রতিপক্ষের সাথে রণাঙ্গনে নামা মানেই আমার বিজয়টা সবার আগে। ৬ মার্চের এশিয়া কাপের ফাইনালে মিরপুরে ভারতের বিপক্ষে আমাদের জয় দিয়েই আমাদের অভিলাষী ক্রিকেট দামামা আরেকবার বাজাতে চাই। সেদিনও নিশ্চয় দেশের ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী আমাদের টাইগারদের উৎসাহ দিতে মাঠে থাকবেন। কফোটা চোখের জল ফেলে ক্রিকেটীয় ভালোবাসায় নিজেকে সাজাবেন।
আমাদের রবিঠাকুর সে যাই বলুন, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।’ আমরা বলব, হে বিমুগ্ধ জননী, আমাদের ব্যাঘ্ররূপে জনম দিয়েছ, আমরা পাকিস্তান বা ভারতীয় আগ্রাসনের বদলা নিতে শিখে গেছি। বিশ্বকে এখন আমাদের জাত চেনাতে পারছি।
ক্রিকেট যাত্রাপথের অমসৃণ কাঁটায় রক্ত ঝড়ায়ে মাশরাফি নামের ক্যাপ্টেন নিজের শেষ রক্ত দিয়ে দিন দিন নিজেকে বাঙালির ভালোবাসায় বিলীন করছেন। তাঁর ও তাঁর ক্রিকেট ভাবশিষ্যদের জন্য হলেও আমরা কেবলই বাংলা বন্দনায় মাতব। আর কিছু নয়। জয় আমাদেরই হবে!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন