দৃষ্টিপাত
বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি ও প্রতিকারের উপায়
বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় উচ্চশিক্ষার তীর্থস্থান। কারণ, এখানে শুধু জ্ঞান বিতরণই করা হয় না, নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিও করা হয়। যখন এই তীর্থস্থানে জ্ঞান বিতরণের নামে শিক্ষকরা ছাত্রীদের যৌন হয়রানি করেন, তখন শিক্ষক হিসেবে সত্যিই মাথা নিচু হয়ে যায়। যে পিতৃতুল্য শিক্ষকদের কাছ থেকে নীতি-নৈতিকা ও আদর্শ শেখার কথা, তাঁদের কাছ থেকে এ ধরনের জঘন্য আচরণ সত্যিই পীড়াদায়ক। হাইকোর্ট ২০১০ সালে ১৬ ধরনের কর্মকাণ্ডকে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে অশালীন আচরণ, হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি ও মন্তব্য বা ভঙ্গি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা। এ ছাড়া চিঠি, মোবাইল, খুদে বার্তাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কথা লেখা, চরিত্র হননের জন্য স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ করা, প্রেমের প্রস্তাব করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া প্রভৃতি।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক আস্থা ও বিশ্বাসের। এই আস্থা ও বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে যখন কোনো শিক্ষক তাঁরই ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করেন, তখন তাঁকে আর শিক্ষক বলা যায় না। কিছু বিকৃত রুচির শিক্ষকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজের অর্জন আজ ম্লান হতে চলেছে। এসব বিকৃত রুচির শিক্ষক ছাত্রীদের সঙ্গে নানা কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে টিউটোরিয়াল, ইনকোর্স ও অ্যাসাইনমেন্টের নম্বরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রথমে প্রেম। এর পর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের নামে নানাভাবে কালক্ষেপণ করেন। উপায়ন্তর না দেখে অসহায় ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। কখনো বই দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি, নোট করে দেওয়ার কথা বলেও করা হয় যৌন নিপীড়ন।
সম্প্রতি আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ ধরনের যৌন হয়রানির অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ছাত্রীদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁদের সাময়িক বহিষ্কার করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অভিযোগটা খুবই উদ্বেগের, এই একই কারণে তিনি চিটাগাং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। উদ্বেগের বিষয় হলো, এসব যৌন হয়রানির অভিযোগ শুধু অবিবাহিত বা স্বল্প বয়স্ক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নয়, অনেক সিনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ লক্ষ করা যাচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই প্রবীণ অধ্যাপক অবসরে যাওয়ার খুব কাছাকাছি অবস্থানে ছিলেন। সুনির্দিষ্ট যৌন হয়রানির অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। এর মাধ্যমে প্রকারন্তে তাঁদের শাস্তির বদলে পুরস্কৃতই করা হয়েছে। কারণ, অবসরোত্তর সব সুযোগ-সুবিধা তাঁরা পাবেন।
২০১২ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনউইমেনের এক জরিপে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আরো খারাপ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার সবচেয়ে বেশি—৮৭ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে ৭৬ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ এবং মেডিকেল কলেজে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৪ শতাংশ ছাত্রী। জরিপে আরো দেখা যায়, বিভিন্ন অশালীন মন্তব্যের মাধ্যমেই ছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানি করা হয়। এ হার ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া তিন ভাগের এক ভাগ ছাত্রী মুঠোফোনে কল ও খুদে বার্তার মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন, ১৫ শতাংশ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিমার মাধ্যমে, শরীর স্পর্শ করে ১২ শতাংশ, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার কারণে ১১ শতাংশ, নজরদারিতে ৯ শতাংশ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ৬ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ ছাত্রী তাঁদের থাকার জায়গা বা পড়াশোনা করার স্থানে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ছাত্রীদের যৌন হয়রানির চিত্র শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রাইমারি স্কুল, হাই স্কুল, এমনকি কলেজ লেভেলেও শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। যৌন হয়রানির ফলে ছাত্রীদের জীবনে নানা ধরনের জটিলতা নেমে আসে। বিপর্যস্ত হয় শিক্ষাজীবন। অধিকাংশ ছাত্রী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছু ছাত্রী অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে যান, কিছু পড়াশোনায় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। আবার কিছু ছাত্রী হয়রানির শিকার হয়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় লজ্জা, সামাজিক অবস্থানসহ বিভিন্ন কারণে ছাত্রীরা এর প্রতিবাদ করেন না। শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগও অভিনব। ছাত্রীদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, কোনো কোনো শিক্ষক তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের বাসার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ছাত্রীদের বাসায় ডাকেন। কোনো কোনো শিক্ষক ক্লাসে ছাত্রীদের পাখি বলে সম্বোধন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর কমপক্ষে ৫০ ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছেন। পর্নো ভিডিওসহ আপত্তিকর নানা ছবিসহ অভিনব কায়দায় ছাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগও রয়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন ও সে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাড়াচ্ছে যৌন হয়রানি। ২০১০ যৌন হয়রানি বন্ধে আদালত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে নির্দেশ দেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়নি। ছাত্রীদের ভেতর যৌন হয়রানি বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডেও একজন সাইকোলজিস্ট রাখা যেতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে এ ধরনের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অনেক সময় অভ্যন্তরীণ ছাত্র-রাজনীতি ও শিক্ষক-রাজনীতির কারণে কোনো কোনো শিক্ষক যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। বিষয়টি খুবই উদ্বেগের, কোনো নিরপরাধ শিক্ষক যেন রাজনীতিক প্রতিহিংসার শিকার না হন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে অর্জন, তা আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কম নয়। কিন্তু এ ধরনের অবক্ষয়ের জন্য যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন ম্লান না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। অনেক সময় ছাত্রীরাও বেশি নম্বরের আশায় শিক্ষকদের সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের একার পক্ষে এ ধরনের অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব নয়। দরকার আমাদের শিক্ষক ও ছাত্রীদের সচেতনতা এবং মানসিক পরিবর্তন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।