প্রতিক্রিয়া
‘কান ধরে ওঠ-বস করছে বাংলাদেশ’
আমি একজন শিক্ষকের ছেলে। দাদাও ছিলেন একজন স্বনামখ্যাত শিক্ষক। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও এখনো আমার প্রথম পছন্দের পেশা শিক্ষকতা। ফলে ফেসবুকে যখন নারায়ণগঞ্জের এক স্কুলশিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বসের ছবিটা দেখি, তখন ঘৃণায়, লজ্জায়, অপমানে একবার মনে হয়েছিল, ওই শিক্ষকের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে ধরে বলি—মাস্টার মশাই, এই দেশে জন্ম নিয়ে আপনি যেমন পাপ করেছেন, তেমনি পাপ করেছেন আমার দাদা, আমার বাবা এবং আমিও। অতএব আসুন, আমরা এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করি।
ফেসবুকে একটি পোস্টারও চোখে পড়ছে, যেখানে লেখা হয়েছে, ‘ধর্মীয় অবমাননার গুজবের অভিযোগে শুধু একজন শিক্ষক নয়, কান ধরে ওঠ-বস করছে বাংলাদেশ।’ ফলে এখন বোধ হয় বাংলাদেশেরও প্রায়শ্চিত্ত করার সময় হয়েছে।
এই লেখা যাঁরা পড়ছেন, ধারণা করি তাঁদের প্রত্যেকের প্রাইমারি বা মাধ্যমিক স্কুলজীবনে একবার না একবার কান ধরে ওঠ-বস করার অভিজ্ঞতা আছে। অঙ্কে কাঁচা ছিলাম বলে ক্লাস নাইনেও সুলতান স্যার আমাকে কত দিন যে বেঞ্চের ওপর কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, তার হিসাব নেই। নারায়ণগঞ্জের ওই শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করানোর এই মহাযজ্ঞের প্রধান অতিথি সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান সাহেবও নিশ্চয়ই ছোটবেলায় পড়া না পারায় কান ধরে ওঠ-বস করেছেন। এবার হয়তো তিনি সেই ‘অপমানের’ প্রতিশোধ নিলেন।
গণমাধ্যমের খবরে যতটুকু জানা গেছে তা হলো, এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে সাজা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রের মা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ করলে এ বিষয়ে স্কুলে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকের সময় ধর্ম নিয়ে কটূক্তির বিষয়টি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ওই শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়। তারা শিক্ষককে মারধর করে অবরুদ্ধ করে রাখে। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করতে ব্যর্থ হলে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমানকে খবর দেওয়া হয়। তিনি সেখানে গিয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষককে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে বলেন। ওই সময় শিক্ষক প্রকাশ্যে কানে ধরে ওঠ-বস করে ক্ষমা চান। পরে তাঁকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এরই মধ্যে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তের পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
রোববার চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের খবরে ভুক্তভোগী শিক্ষক দাবি করেছেন, ধর্ম নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করার অপবাদ দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল। তিনি এক ছাত্রকে সাজা দিতে গিয়ে মারধর করেন। সে ঘটনাটিও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। স্কুলের পরিচালনা নিয়ে বিরোধের জের ধরে যারা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিল, তারা পুরো ঘটনার পেছনে আছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
ওই স্কুলের একাধিক শিক্ষক সাক্ষ্য দিয়েছেন, ওই প্রধান শিক্ষক কখনোই ইসলাম নিয়ে কোনো ধরনের কটূক্তি করেননি; বরং তাঁরাও মনে করছেন, প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার গুজব ছড়িয়ে স্থানীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে অন্য কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
তার পরও তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া হয় যে ওই শিক্ষক ধর্মীয় কোনো বিষয়ে খারাপ কথা বলেছেন, তার পরও কি একজন শিক্ষককে এভাবে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠ-বস করানোকে বৈধতা দেওয়া যাবে? তাহলে আর দেশে আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা রেখে লাভ কী? নিজের হাতেই আইন তুলে নিয়ে, আমরা দেখলাম স্কুলশিক্ষকের ‘বিচার’ করছেন খোদ সংসদ সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে একজন শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছেন এবং গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, জনরোষের হাত থেকে ওই শিক্ষককে বাঁচাতে এর কোনো বিকল্প ছিল না। তবে আমরা নাগরিকরা এটি ভাবতে পারি, আইনপ্রণেতা হিসেবে তিনি যা করবেন, সেটিই আইন। অতএব, শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। জিডিপি, মাথাপিছু আয় আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা যে ক্রমে একটা বর্বর, অসভ্য, অমানবিক, অন্ধ, দলকানা, হুজুগে, অসহিষ্ণু জাতিতে পরিণত হচ্ছি—সেটি আরো একবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা বরং ওসমান সাহেবকে ধন্যবাদ দিতে পারি।
তা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ উঠলেই তাঁকে মারধর করা, এমনকি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলাও যে দেশে জায়েজ ও অনুমোদিত—সেখানে একজন ‘মালাউনের বাচ্চা’ স্কুলমাস্টারকে কান ধরে ওঠ-বস করানো বড্ড লঘু শাস্তি।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।