রূপসার তীর থেকে
খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা ও সমাধানের উপায়
খুলনা দক্ষিণবঙ্গের একটি পুরাতন জেলা। ১৮৮২ সালে খুলনা জেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। এই জেলার বর্তমান আয়তন ৪ হাজার ৩৯৪.৪৬ বর্গকিলোমিটার। খুলনা বিভাগ গঠিত হয় ১৯৬০ সালে। খুলনা পৌরসভা ঘোষণা করা হয় ১২ ডিসেম্বর ১৮৮৪ সালে এবং এবং মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত করা হয় ১২ ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালে। ৬ আগস্ট ১৯৯০ সালে খুলনাকে সিটি করপোরেশন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরমধ্যে খুলনা মহানগরীর আয়তন ৪৫.৬৫ বর্গকিলোমিটার। সিটি করপোরেশনের হিসেবে খুলনা মহানগরীর লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ৭টি থানা ও ৩১টি ওয়ার্ড নিয়ে খুলনা সিটি গঠিত। খুলনা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে এ শহর অবস্থিত। উত্তরে রাজশাহী বিভাগ, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ঢাকা ও বরিশাল বিভাগ, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলার দক্ষিণাংশজুড়ে সুন্দরবন বিস্তৃত। খুলনা সিটির সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৫৬.৬৪ কিলোমিটার এবং ড্রেনের মোট দৈর্ঘ্য ৬৪২.১৮ কিলোমিটার। খুলনা শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৬৭,৯৯৪ জন। (সুত্র : বাংলা পিডিয়া)
এশহরের সবথেকে বড় সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। বর্ষাকালে অল্প বৃষ্টিতেই শহরের সবজাগায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। শহরে ড্রেনের মোট দৈর্ঘ্য ৬৪২.১৮ কিলোমিটার অন্যান্য শহর থেকে এ শহরের প্রধান পার্থক্য হলো খোলা ড্রেন। মোট দৈর্ঘ্যর অধিকাংশ ড্রেনই হলো খোলা এবং কাঁচা। প্রতিটি ড্রেনই কাদায় সবসময় ভরে থাকে। প্রতিদিন বসত বাড়ির ও কলকারখানার ব্যবহার্য বর্জ্য, নিষিদ্ধ পলিথিন, পণ্যসামগ্রীর মোড়ক ইত্যাদির মিশ্রণের ফলে ড্রেনের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শহরের অধিকাংশ খাল ও পুকুর দখল ও ভরাট করার ফলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। যত্রতত্র ড্রেনের ওপর সিটি করপোরেশনের অনুমতি ছাড়া দোকান ও বাজার তৈরিও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।
সিটি করপোরেশন একটি নিদিষ্ট সময় পরপর পেরিকাদা পরিষ্কার করলেও কিছুদিন পর আবার ড্রেনগুলো কাদায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সিটি করপোরেশনের হিসাব মতে, এ শহরে প্রতিদিন প্রায় ৪৫০ মেট্রিকটন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ বিপুল বর্জ্যর অধিকাংশই নগরবাসী এই খোলা ড্রেনে নিক্ষেপের ফলে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মহানগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভালো না থাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস করছে নগরীর বেশিরভাগ জনপদ। বর্ষায় জলাবদ্ধতা আর শুষ্ক মওসুমের দুর্গন্ধ দুর্বিষহ করে তুলেছে শহরের জনজীবন। শহরের ময়লা-আবর্জনা আশপাশের ড্রেন দিয়ে এসে ময়ূর নদী ও হাতিয়া খাল ভরাট করে ফেলায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। অল্প বৃষ্টিতেই নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে যায়, জলাবদ্ধতার কারণে স্থবির হয়ে পরে নাগরিক জীবন। ময়ূর নদী ও হাতিয়া খাল ভরাট হওয়ার কারণে পানি দ্রুত নিষ্কাসন হয় না ফলে জন ভোগান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়। শহরের বর্জ্যে খালগুলো ছোট ড্রেনে পরিণত হয়েছে। বর্ষায় পানি বের হওয়ার সুযোগ থাকে কম। ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
তৃতীয় বৃহত্তম শহর হিসেবে খুলনা শহরের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর এজেলার পাশেই অবস্থিত। পদ্মা সেতু তৈরি হওয়ার ফলে এ শহরের অর্থনীতিক চাহিদা দিনদিন বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন বিভাগের অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এশ হরে। প্রতিদিন কয়েক হাজার রিক্সা, ইজি বাইক, প্রাইভেট কার, বাস, ট্রাক ও কয়েক লাখ লোক চলাফেরা করে এশহরে। খুলনা কে অতীতে শিল্প নগরী হিসেবে ডাকা হতো। এখানে ছিল কয়েকশ পাটকল, ছিল নিউজপ্রিন্ট মিল ও হার্ডবোর্ড মিল। কিন্তু আস্তে আস্তে শিল্পগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে হারাতে বসেছে শিল্প নগরীর তকমা। সাদা সোনা চিংড়ি ও সাধা মাছ চাষের ফলে খুলনাতে গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক মাছ কোম্পানি। এসব শিল্প কলকারখানায় হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
তবে গত শতকের ৮০'র দশকে সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানের কবলে পড়তে থাকে। তবে শিল্প নগরী খুলনা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি জুটমিলসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান। খুলনা শিপইয়ার্ড লোকসান কাটিয়ে উঠে এখন লাভ করছে। ইতিমধ্যে এখানকার তৈরি যুদ্ধ জাহাজ বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া জাহাজ রপ্তানির জন্য বিদেশের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে খুলনা শিপইয়ার্ড। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। জলাবদ্ধতা যেন খুলনা শহরের উন্নয়নের অন্তরায় না হয়। জলাবদ্ধতা শুধু বর্ষা কালের সমস্যা নয় সারা বছরই কম বেশি এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নগরবাসীকে।
লন্ডন শহরের মতো টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম (sustainable drainage system) চালু করা হলে পানি নিষ্কাশন সহজেই করা সম্ভব। শহরে সাধারণত ইট,পাথর দিয়ে উপরিতল ঢাকা থাকে তাই বৃষ্টি হলে সহজেই পানি নিচে যেতে পারে না। আরবান ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট একটি প্রাকৃতিক উপায় যেখানে বৃষ্টির পানিগুলো সহজেই রাস্তার নিচে নিয়ে গিয়ে নিষ্কাশনের মাধ্যমে নদী বা খালে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা। লন্ডন সিটিতে দুই পদ্ধতিতে পানি নিষ্কাশন করা হয় এক সম্মিলিত পদ্ধতিতে দুই পৃথক পদ্ধতিতে। পৃথক পদ্ধতির মাধ্যমে বৃষ্টির পানি রাস্থার পাশের নালা দিয়ে একটি কাছাকাছি জলপথ থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্মিলিত পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি রাস্তার পাশের নালা দিয়ে এক বা একাধিক পয়ঃনিষ্কাশন শোধনাগারে নেওয়া হয় এরপর নিষ্কাশন করে পানি নদীতে পাইপের সাহায্যে ফেলে দেওয়া হয়। লন্ডনে প্রতি সপ্তাহে একবার করে পয়ঃনিষ্কাশন করা হয়ে থাকে। জলাবদ্ধতা নিরসনে লন্ডন সিটির পদ্ধতি খুলনা সিটি করপোরেশন গ্রহণ করতে পারে।
পরিকল্পিতভাবে খুলনাকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্নরূপে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের প্রিয় এই নগরীকে ঘিরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুলনাকে সুন্দর পরিচ্ছন্ন বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করাই হবে আসল লক্ষ্য। নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে ময়ূর নদীসহ অন্যান্য খাল খনন এবং নতুন ড্রেন নির্মাণ করতে হবে। জলাবদ্ধতা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গ্রহণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সড়ক উন্নয়ন, গণপরিসর তৈরি ও উম্মুক্ত স্থান সংরক্ষণ, ময়ূর নদী সংরক্ষণ ও ভরাট হওয়া খাল পুনরুদ্ধার ও খনন। সর্বোপরি লন্ডন সিটির মতো টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম চালু করা। খুলনার জলাবদ্ধতা নিরসনে দরকার খুলনা সিটি করপোরেশন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও নগরবাসীর সচেতনতা এবং দরকার সরকারের আন্তরিকতা।
সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।