বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি
সমন্বিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা কতটুকু যৌক্তিক?
সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হয়েছে। মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১০ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। পরীক্ষায় ১০ লাখ ৭ হাজার ৫৩ জন পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন ৭ লাখ ২৭ হাজার ৮০৩ জন (দৈনিক প্রথম আলো)। মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেরিন এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট আসনসংখ্যা ৪৬ হাজার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৪ হাজার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা জোগান থাকা সাপেক্ষে পরিবর্তিত হয়। তা ছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বছরে তিনবার ভর্তি নেওয়ার কারণে তাদের আসনসংখ্যাও নেহাত কম নয়।
শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দ থাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। কেন না অনেক কম খরচে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা যায়। এ বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন না থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন প্রণালি ভিন্ন এবং তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ভিন্ন, কিছু আছে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কিছু আছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। আবার সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদও এক নয় এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগও এক নয়।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বেশির ভাগ অভিযোগই শিক্ষকদের ওপর, আয় কমার ভয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিতে চায় না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ ধরনের সরল অভিযোগ করে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে এগুলোকে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। স্কুল ও কলেজের পড়ালেখা ক্লাসকেন্দ্রিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা গবেষণামূলক, এখানে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা হয় এবং বিতরণ করা হয়।
এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষাকে সমর্থন করতে মূলত তিনটি অভিযোগ তোলা হয়- এক. শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ, দুই. ভর্তি পরীক্ষার ফর্মের টাকার পরিমাণ এবং তিন. মেডিকেল পরীক্ষা সমন্বিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন হবে না? আসুন এই অভিযোগগুলো খণ্ডনের আগে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে আসি। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় উচ্চশিক্ষার তীর্থস্থান। আয়তন প্রায় ৯৮ লাখ ৫৭ হাজার ৩৪৮ বর্গকিলোমিটার। যা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬৫ গুণ বড়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। (সূত্র : উইকিপিডিয়া)। একবার ভেবে দেখুন এই পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ে কি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু আছে? বরং র্যাঙ্ক অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কঠিন থেকে কঠোরতম হয়ে থাকে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উঁচুমানের সিজিপিএ, স্যাট স্কোর, জিম্যাট এবং টোফেল স্কোর থাকতে হয় তারপরও লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়। সুতরাং এ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে হয়, টাকা দিয়ে ফরম কিনতে হয় এবং ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। তাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এবং এমআইটির (আমেরিকা) ভর্তি পদ্ধতি এক নয়। যদিও এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অন্যতম।
ইংল্যান্ডে প্রায় ১০৬টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় আছে (তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া)। আমাদের দেশের মতোই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। সে দেশেও অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতি এক নয়। এমনও দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থী অক্সফোর্ডে ভর্তি হতে পারলেও ক্যামব্রিজে ভর্তি হতে পারে না। এখানেও একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে একেক ধরনের যোগ্যতা লাগে। কোথাও জিআরই, কোথাও জিম্যাট, কোথাও আইএলটিএস-এর স্কোর লাগে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংক অনুযায়ী যোগ্যতার পার্থক্য ভিন্ন হয়। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেই।
একইভাবে অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, কানাডাতেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেও সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হয় না। বেশি দূরে নয় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও প্রায় দশ হাজারের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানেও সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়না। কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারনার সাথে এ ধরনের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কোনো মিল নেই। আমাদের দেশে আজ থেকে তিন দশক আগেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভাগওয়ারি পরীক্ষা পদ্ধতি চালু ছিল। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে মিলে কেননা সাংবাদিকতা পড়তে যে জ্ঞান লাগে, ব্যবস্থাপনা পড়তে অবশ্যই সেই জ্ঞান লাগবে না। কিন্তু বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা অনেক সময় সাপেক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের অনেক বিষয়ের ওপর পরীক্ষা দিতে হয় বিধায় অনুষদভিত্তিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রচলন চালু হয় এবং এই পদ্ধতিই এখন সব বিশ্ববিদ্যালয় অনুসরণ করছে।
আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা এইচএসসি পাস করলে সবাইকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। সবাইকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে মানে এমএ, বিএ, এমকম, বিকম, এমবিএ, বিবিএ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। এ রকম মানসিকতা থাকলে দেশে এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেও আসনসংখ্যা সব সময় কম থাকবে। উচ্চশিক্ষা সবার জন্য নয়। উচ্চশিক্ষা শুধু মেধাবীদের জন্য। কম মেধাবী এবং স্বল্প মেধাবীদের জন্য দরকার কর্মমুখী শিক্ষা। এই কারণেই প্রতিবছর আমাদের দেশে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টাকা ও সময়ের অপচয় করে।
শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগের কথাই যদি ধরা হয়। তাহলে বলা যায় বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটা বিভাগে এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা করুন। তাহলে দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমবে। আর ভর্তি পরীক্ষার টাকার কথা বলছেন। এখনো নামমাত্র মূল্যে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম বিক্রি হয়ে থাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে পারবেন। ধরুন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদে আটটি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। যদি ফর্মের মূল্য এক হাজার টাকাও রাখা হয় (যদিও প্রকৃত মূল্য এর থেকেও কম) তাহলে এই আটটি বিষয়ের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের বিষয় প্রতি খরচ করতে হচ্ছে মাত্র ১২৫ টাকা। এই এক হাজার টাকা আটটি বিষয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। একবার ভাবুন মাত্র ১২৫ টাকায় একটি বিষয়ের ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া যায়।
যে সব বিজ্ঞজন ফরম বিক্রির টাকার কথা বলছেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, ধরুন আসনসংখ্যা অনুযায়ী ছাত্র সংখ্যা কম তাহলে কি বলবেন, একেবারে ফ্রিতে ছাত্র ভর্তি করুন? তাছাড়া ফর্ম বিক্রির টাকা দিয়ে পত্রিকায় ভর্তির বিজ্ঞাপন খরচ, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের খরচ, উত্তর পত্র ছাপানো, শিক্ষকদের ইনভিজিলেশনের খরচ এবং প্রশাসনিক খরচ করার জন্য বিভাগ থেকে ভর্তুকি দেওয়ার প্রয়োজন পরে। অন্যদিকে, মেডিকেলে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে সকল মেডিকেল কলেজে ভর্তি নেওয়া সম্ভব কারণ সেখানে পড়ার বিষয়বস্তু এক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয় এবং অনুষদ এক নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোও এক নয় এবং সব বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও এক নয়।
যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিবিএস কোর্স চালু করে তাহলে নিশ্চই মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা এক হবে না? তার পরেও যদি টাকার কথা বলা হয়, তাহলে সরকার থেকে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ফ্রি করে দিলেই তো হয় অথবা ফরমের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাহলে শিক্ষকরা এই টাকার ভাগ খাওয়ার অভিযোগ থেকে মুক্তি পায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের আর অপমান করবেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা ভিন্ন হবে এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বকীয়তা। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট। সুতারাং শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ এবং ফরম বিক্রির টাকার অভিযোগ তুলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হলে উচ্চ শিক্ষায় দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা, ভর্তি বাণিজ্য এবং সর্বোপরি শিক্ষার মানের অবনতি। সুতারাং গুচ্ছ পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া একটি অবান্তর প্রস্তাব মাত্র যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়