স্মরণ
মুনির-তপন-জুয়েল : এখনো অবিনশ্বর!
বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগেই সিলেট শহর স্মরণ করছে তিন তরুণকে। যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিল মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ইতিহাসের পাঠ এমনই যে, আদর্শভিত্তিক যেকোনো আত্মত্যাগকেই সে স্মরণ করে কোনো না কোনো সময়ে। মুনির, তপন ও জুয়েলের সে পাঠ ছিল তেমনই। তাই প্রজন্মের বদল হয়েছে কিন্তু চেতনার বিনাশ হয়নি।
১৯৮৮ থেকে ২০১০ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অনেকেই নাম মুখে আনেনি তাদের। অনেকের ছিল প্রাণ হারাবার ভয় আবার অনেকের ছিল ব্যবসা বাণিজ্যে অংশীদরিত্ব হারানোর ভয়। এই ভয় আর স্বার্থ মিলেমিশে একাকার ছিল যাদের তাদের অনেকেই খুনিদের সাথে হাত মিলিয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য দিতে যায়নি অনেকেই; কারণ সেখানেও ছিল প্রাণের ভয়, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ছিল পারিবারিক সম্পর্কের প্রভাব ।
আদালত খুনিদের শাস্তি দিতে পারেননি শুধু প্রমাণের অভাবে। কিন্তু সিলেটের তরুণ প্রজন্মের বিবেক ঠিকই তার সহজাত চেতনায় গর্জে ওঠতে শুরু করেছে। তরুণ প্রগতিশীলদের মুখ ও অন্তর দিয়ে ক্রমে এই প্রতিবাদের স্বর চেতনা জাগানিয়া হয়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে।
কেন স্মরণ করা হচ্ছে সে তিন তরুণকে, কী ঘটেছিল সে দিন সে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৮: সকালেই সিলেটের এমসি কলেজ ক্যাম্পাস দখল হয়ে যায়। ইসলামী ছাত্রশিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস দখল করে শহরের চৌহাট্টার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে এমসি কলেজ পর্যন্ত সশস্ত্র মহড়া দিতে থাকে মোটরসাইকেল ও টেম্পো সহযোগে। শিবিরের এ দখলের কারণে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর কেউই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারছিল না। তখন আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টেম্পোযোগে একদল সশস্ত্র কর্মী নগরীর শাহী ঈদগাহ এলাকায় জড়ো হওয়া জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের ওপর হামলা চালায়।
সে সময় তারা মুনিরকে (মুনির-ই-কিবরিয়া) ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়। মধ্যযুগীয় কায়দায় তপনকে (তপন জ্যোতি দেব) ধরে পাথর দিয়ে তার শরীর থেঁতলে দেয়। মুনির-তপন দুজনকে আহত করে শিবির ক্যাডাররা ফেলে চলে গেলে এলাকাবাসী তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে হাসপাতালে তাদের মৃত্যু হয়।
একই দিন শহরের শিবিরের এক মিছিল থেকে স্কুলছাত্র জুয়েলকে (এনামুল হক জুয়েল) ধাওয়া করে শিবির ক্যাডাররা। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে জুয়েল দৌড়ে একটা মার্কেটের ছাদে উঠে যায়। ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসীরা ছাদে ওঠেও ধাওয়া করে জুয়েলকে। একপর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে যেতে লাফ দেয় সে, পারেনি; ছাদ থেকে নিচে পড়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। জুয়েল স্কুলছাত্র হলেও শিবিরের স্কুল রাজনৈতিক প্রচারণার বিপক্ষে অবস্থানে নেওয়ার কারণে তাঁকে আক্রমণ করা হয়। একই দিন এ তিন হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সিলেট শহরে প্রকৃত ছাত্র হত্যার রাজনীতি শুরু হয়।
দীর্ঘ বিরতির পর ২০১০ থেকে প্রতি বার সিলেটের প্রকৃত প্রগতিশীলরা কোনোরূপ রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছাড়াই একই ব্যানারের পেছনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। এটা প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বাইরে একটা অভূতপূর্ব উদাহরণ হিসেবে জন্ম নিচ্ছে এবং আমাদের বিশ্বাস ক্রমে এ প্রতিবাদ ও গণসচেতনতা কর্মসূচি দিকে দিকে ছড়িয়ে গিয়ে একটি সুসংহত অরাজনৈতিক চেতনাঋদ্ধ সংস্কৃতি বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাবে।
শহীদ মুনির-তপন-জুয়েল রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক দিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন সত্য কিন্তু তাদের চেতনা ছিল অবিনশ্বর একটি চেতনা যা অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করত। স্বভাবত সেখানেই তাদের বিরোধ ছিল মৌলবাদী, ধর্মান্ধ জামায়াত-শিবিরগোষ্ঠীর সাথে।
তখন ছিল স্বৈরাচারের কাল এবং স্বৈরাচারের সাথে সব সময়ই মৌলবাদী ও ধর্মান্ধদের আঁতাত থাকে। এরশাদ শাহীর সাথে মৌলবাদী জামায়াতের সে সময়কার আঁতাতের ফলে বিনা বাধায় অথবা প্রশাসনের কোনোরূপ বাধা ছাড়াই প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেয়। এরপর জাসদ ছাত্রলীগ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সেভাবে সফল হতে পারেনি কারণ প্রশাসনের শ্যেন দৃষ্টি এবং জামায়াত-শিবিরের অস্ত্রশক্তির কাছে তাদের শক্তি ছিল অতিমাত্রায় সীমিত।
ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা, রগ কাটা থেকে শুরু করে যাবতীয় ধর্মবিরোধী কাজের সূচনা হয়ে আসছে আমাদের দেশে। যারা এসবের সাথে জড়িয়ে আছে তারা ধর্মান্ধতার খোলসে আবদ্ধ অনেক আগে থেকেই। মানুষের ধর্মের প্রতি ভালোবাসাকে পুঁজি করে অধর্মের চাষ করে যাচ্ছে নিয়ত। যেখানে ধর্মের কোনো যোগ নেই সেখানে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে ভিন্ন ভিন্ন নামে তাদের বিচরণ হয়ে চলেছে। প্রকৃত ধার্মিকের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই এই অধর্ম পালন ও ধর্মান্ধতাকে লালন করা হচ্ছে দিন দিন। মার খাচ্ছে ধর্মের প্রচলিত ইস্পিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এক ধর্মের সাথে অপ্রত্যক্ষ বিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকেই। এর মূলে রয়েছে দুষ্ট রাজনৈতিক চর্চা ও সাধারণ জনমানুষের আবেগের অতিপ্রকাশ অথবা অপ্রকাশ। এর ফল ঘরে তুলছে জামাত-শিবিরসহ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র।
ধর্মে ধর্মে বিরোধ সৃষ্টি ও ধর্মান্ধকে উসকে দেওয়ার কাজ যারা করছে তারা কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য- উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। অপরপক্ষে যারা অসাম্প্রদায়িকতা ধারণ করে তারা প্রকৃত কারণ বের করার চাইতে কেবল পারস্পরিক তীর নিক্ষেপের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নের পরিবর্তে শত্রু মানসিকতার পারদ তীব্র হয়ে চলছে দিন দিন। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে কারণ ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেনি আগেও এবং এখনো করতে চায় না। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি এই ধ্যান-ধারণাকে লালন করলে এবং এই জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দিকে তাকালেই কেবল আমরা অনুধাবন করতে পারব এই ভূখণ্ডে ধর্মে ধর্মে নিবিড় সহাবস্থান ছিল, ছিল না ধর্মের নামে অধর্ম আর ধর্মান্ধতার চাষ।
মুনির-তপন-জুয়েল একটি চেতনার নাম হিসেবে দেখা দিচ্ছে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন সিলেটবাসীর কাছে। তাই আজ সিলেটের সব প্রগতিশীল মানুষ এই মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবসে সিলেটের রাজপথে নামছে। এখানে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে হাইলাইট করার চেষ্টা হচ্ছে না। সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে দাঁড়িয়ে সব শ্রেণির মানুষের মাঝে মৌলবাদ ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
মুনির-তপন-জুয়েল সিলেটের অসাম্প্রদায়িক চেতনার স্পন্দন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সিলেটের অসাম্প্রাদায়িক চেতনাধারি মানুষেরা তাদের মৃত্যুর তারিখকে (২৪ সেপ্টেম্বর) সিলেটে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস পালন করে আসছে। অনলাইন-অফলাইনে এই আন্দোলনে ছড়িয়ে পড়েছে। কেবল শহর সিলেটই নয় শহর সিলেটের বাইরে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, রংপুর, চট্টগ্রাম ও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রতিবাদ হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। অনলাইন বিশেষ করে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রগতিশীল যারাই শুনছে তারাই এ মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে কথা বলছে। এটা হতে পারে একটা অনন্য অর্জন।
২৪ সেপ্টেম্বর 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস' পালন করছে সিলেটের প্রগতিশীল তরুণরা। সিলেট নাম শুনলে অনেকেই হয়তো নাক সিটকে বলতেও পারে ওখানে মৌলবাদীদের শক্ত ঘাঁটি, হয়তো এটা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হতে পারে। হয়তো জাতীয় নির্বাচনের চিত্র বিশ্লেষণ হতে পারে, হয়তো দেখা যেতে পারে শীর্ষ কোনো যুদ্ধাপরাধী আছে কি না পুরো সিলেটে, তারপর হয়তো অনুসিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। এ দিকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সিলেটে কোনো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর খবর পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। যদিও কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর সন্ধান পাওয়া গেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দল তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে, করছে; অভিযোগ উত্থাপন করেছে, বিচার হয়েছে। এর বাইরে জাতীয় নির্বাচনে মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাফল্যের হার খুব কম। ফলে প্রমাণিত হয় আর যাই হোক সিলেটের মানুষ মৌলবাদী, ধর্মান্ধদের কখনই গ্রহণ করেনি। তবু এখানে মৌলবাদীদের দৌরাত্ম্য আছে, এবং সেটা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতৃত্বের কারণেই সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সিলেটের সাধারণ মানুষ সচেতন তার প্রমাণ বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফল। আর সে কারণে এ সিলেট থেকে জন্ম নেয় মুনির-তপন-জুয়েলের মত তরুণের যারা মৌলবাদকে রুখতে নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছিল, এবং এটাই ছিল সিলেটের প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। মুনির-তপন-জুয়েলের পথ ধরে তাই এ সময়ের তরুণেরাও গত গত বছরে ক্রমাগতভাবে দেখিয়ে যাচ্ছে কোন এক শহর থেকেই মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়া সম্ভব কোনরূপ রাজনৈতিক শক্তির সহায়তা ছাড়াই। এটা হয়ত খুব বেশি দূরের না যখন এই আন্দোলন ও দিবস জাতীয়ভাবে পালিত হবে।
তাই যারাই অসাম্প্রদায়িক ধারণাকে পোষণ করেন, ধারণ ও বিশ্বাস করেন তাদের সবার উচিত এই আন্দোলন ও প্রতিবাদকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। আমরা আশায় বুক বাঁধি একদিন জাতীয়ভাবে এ দিন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মাইলফলক হিসেবেই পরিগণিত হবে। চেতনার ডাকে সাড়া দিচ্ছে যারা তারা সংখ্যায় কত তার চাইতে বড় ব্যাপার হলো তারা অন্তরে লালন করছে কী না অসাম্প্রদায়িকতা! আমরা সে অসাম্প্রদায়িকতাকে লালন করছি।
শহর সিলেটের প্রথম ছাত্র হত্যার শিকার মুনির-তপন-জুয়েল অসাম্প্রদায়িক চেতনার অবিনশ্বর নাম। তাদের এই আত্মত্যাগ একটা মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ বিনির্মাণে সহায়ক হলে তবেই তাদের আত্মদান সার্থক হবে। শহর সিলেট মৌলবাদকে ধারণ করে না, এ শহর মৌলবাদ লালন করে না। এর প্রমাণ দিয়ে গেছে সিলেটের তরুণ প্রজন্মের তিন সূর্যসন্তান মুনির-তপন-জুয়েল এবং সেই প্রজন্মের পর এই প্রজন্মও তার প্রমাণ দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে। এখানে নেই কোনো দ্বন্দ্ব ও বিশ্বাসের অহেতুক প্রাবল্য। আছে চেতনার অবিস্মরণীয় আলোকবর্তিকা। যে চেতনার বহ্নিশিখায় মুক্তির পথ দেখাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে নিজের রক্ত দিয়ে হলেও রুখতে হবে এ ছিল মুনির-তপন-জুয়েলের প্রদীপ্ত শপথ। তাদের শপথে তারা অটল থেকেছে। দিয়েছে নিজেদের প্রাণ। তাদের সে আত্মত্যাগ আজকের তরুণ প্রজন্ম ধারণ করেছে এটা অশেষ প্রাপ্তি।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম।