প্রতিক্রিয়া
খাদিজার বাড়ি থেকে ফিরে
সিলেট শহর থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক ধরে একটু এগুলেই শহরতলীর আউশা গ্রাম। ক্ষুব্ধ এই গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা এখন আন্দোলন করছে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে নৃশংসতার শিকার খাদিজা আক্তার নার্গিসের ওপর হামলকারীর শাস্তির দাবিতে। বদরুল এখন শ্রীঘরে। খাদিজা আক্তার নার্গিস ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মিডিয়ার কল্যাণে সারা বিশ্বে মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে সংবাদ। স্থিরচিত্র কিংবা ভিডিও চিত্রের মাধ্যমে সবাই অবগত হালনাগাদ তথ্যে। অনেকেই এরই মধ্যে খাদিজার বাড়ির খোঁজ নিতে শুরু করেছে। অনেকেরই জানার আগ্রহ খাদিজার বাড়ির এখন কী অবস্থা?
আউশা গ্রামে খাদিজার বাড়িতে গিয়ে যেটা দেখা যায়। বাড়ির উঠানে বেশ কটা চেয়ার পড়ে আছে। বাড়িতে নেই কোন কোলাহল। অবশ্য বাড়িতে প্রবেশের পূর্বে কৌতূহল কিছু কিশোর-কিশোরীর পাল্লা থেকে মুক্ত পাওয়া কষ্ট। গ্রামের বড় আপু খাদিজার বিস্তারিত জানতে যখন কেউ সেই বাড়িতে যাচ্ছে, তখন তাদের মুখের চাওনি বলে দিচ্ছে ‘আমাগোর খাদিজা আফার খরব কি-তা?’ কেউ কেউ মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করেও বসছে। খাদিজাদের বাড়িটা কই বললেই দেখিয়ে দিচ্ছে ওরা। নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে বাড়িটিকে। একতলা বাড়িটায় নেই কোনো সাড়া শব্দ। মাঝে মাঝে কান্নার আওয়াজ আর কৌতূহলী মানুষের পদচারণা।
বাড়ির ভিতরে ঢুকলেই এক ধরনের অস্থিরতা বেড়ে যায় যেটুকু জানার তা শুনে-বুঝে বেরিয়ে আসার সময় আবার মনটা মোচড় দিয়ে উঠবে। যে বাড়ির প্রতিটি কোণায় খাদিজার ছিল অবাধ পদচারণা সেই বাড়িতে কি খাদিজার ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা আছে? নিজের অজান্তেই নিজেকে এমন একটা প্রশ্ন করতেই হবে। বাড়ির মানুষকে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই। খানিকটা ক্লান্ত সবাই। তবুও জানার আগ্রহ আছে। জানার সেই আগ্রহ থেকেই ঘরের বাসিন্দাদের একটু কষ্ট দেওয়া। এমনিতেই তাদের সবার মন খারাপ। তার ওপর খাদিজার শোয়ার ঘর আর পড়ার টেবিলের দিকে চোখ পড়লে মনটা আরো বিষাদময় হয়ে ওঠে।
যে টেবিলের পড়া থেকে উঠে খাদিজা এমসি কলেজে পরীক্ষা দিতে যায় সে টেবিলটা পড়ে আছে শূন্য। বইগুলে সাজানো গোছানো। কি এক পিনপতন নীরবতা বইগুলোর মধ্যে। পাশে পড়ে আছে একটা ফ্যান। ওটাও কদিন ধরে বন্ধ আছে। সেদিন মাকে ‘আম্মা আমি সিলেট যাইরাম’ বলে বাড়ি থেকে বের হওয়া মেয়েটা আর তার মায়ের কাছে আদৌ ফিরবে কি? না ওই যাওটাই ছিল শেষ যাওয়া!
খাদিজার শখ ছিল সবজি বাগানের। গ্রামে বাড়ির পাশে ছোট জায়গায় চলত তাঁর সবজি চাষ। খুব একটা বাড়ির বাইরে যেতেন না খাদিজা, আশপাশের বাড়ি আর গ্রামের মুরব্বিদের কাছ থেকে সেটা জানা গেল। বাড়ির মানুষগুলোকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল বটে কিন্তু মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনায় এনে সেটা করা সম্ভব হলো না।
এই কদিন আগেই পরিবার পরিজন আর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যার পদচারণা ছিল সেই মেয়েটির বাড়িতে আজ কান্নার আওয়াজ আর আর্তনাদ। মাঝে মাঝে কৌতূহলী মন নিয়ে কিছু মানুষের আনাগোনা। মেয়েটার কী অবস্থা? পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েগুলো এসে উঁকি দিচ্ছে এই বুঝি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলো তাদের প্রিয় ‘খদিজা আফা’। গ্রামের চাচা-চাচি আর প্রতিবেশীরাও আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সব শেষ খবরটা জানতে। মুরব্বিদের দোয়া আমাদের খাদিজা আমাদের মাঝে ফিরে আসুক। এলাকাবাসী সবাই চাইছে কুলাঙ্গার বদরুলের উপযুক্ত শাস্তি হোক। আউশা গ্রাম এখন উত্তাল। সিলেটের মানুষও আন্দোলন করছে তাদের মেয়ে খাদিজার ওপর যা হয়েছে সেটার বিচার পেতে।
খাদিজার বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হলো এ পথ দিয়েই চলাচল করত মেয়েটি। আবারো কি এই পথে ফিরবে খাদিজা?
লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।