হামলার প্রতিক্রিয়া
সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ১৫টি মন্দির ও সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একটি ছবি আপলোডকে কেন্দ্র করে এই হামলা চালানো হয়। এর কদিনের মাথায় নতুন করে ১১টি বাড়িতে গভীর রাতে দেওয়া হয় আগুন। সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন দেশের প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও তরুণ লেখকরা। তাঁদের কয়েকজনের প্রতিক্রিয়া নিচে দেওয়া হলো।
নির্মলেন্দু গুণ
কবি
পাকবাহিনীও তাদের স্থানীয় দোসরদের অত্যাচারে জন্মভূমিতে টিকতে না পেরে, ১৯৭১ সালে তো আমরা মালাউনরা ভারতেই চলে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম- কিছুটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য, কিছুটা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য।
ভারত আমাদের খুব বেশিদিন থাকতে দিল না। নয় মাসের মাথায়, ১৬ ডিসম্বরে পাকি মুচুয়ার দল মিত্রবাহিনীর কাছে ( মতান্তরে ভারতের কাছে) রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করে বসল।
আর সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারত ভদ্রভাবে আমাদের সদ্যোজাত বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিল। মানে push back করল।
সবাই যে ধাক্কা খাইয়া দেশত ফিইরা আইল, তা কিন্তু না। অনেকেই আমার মতো, আপনের মতো মহানন্দে নাচতে নাচতে ফিইরা আইল তার সাত পুরুষ ( মতান্তরে সাতশ' পুরুষ)-এর জন্মভিটায়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগও অন্তত মুখে মানা করল না। বলল- ‘আয়, আয়। ভোটের সুময় তোরারে কামে লাগব। তয় দেহিস আবার ইলেকশনে দাঁড়াইচ না কুনু। তোরা দরকার পড়লে ভোট দিবি, আর মাঝেমইধ্যে আমলীগের পক্ষে মিছিল করবি, কবিতা, গান, নাটক এসব লেখবি। আয়। আইয়া পড়।’
আমরা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’তে হাসতে হাসতে, লাফাইতে লাফাইতে ফিইরা আইলাম।
এর পরের কাহিনী, যে কাহিনীর শেষ নাই, তা আপনে বলেন। আমারে একটু লুকায়া-লুকায়া কাঁদতে দেন।
আমি চাই না কবির চোখের জল সাধারণ মানুষে দেখুক।
আমাকে স্মরণ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
জাকির তালুকদার
কথা সাহিত্যিক
নাসিরনগরের ঘটনা এই দেশে প্রথম নয়। আবার এটাই যে শেষ ঘটনা হবে, এমনটি মনে করা সবচাইতে নির্বোধ আশাবাদীর পক্ষেও সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই রকম অপঘটনা ঘটে চলেছে বহুদিন ধরে।
কিন্তু এসব বন্ধ হয় না কেন?
বন্ধ হয় না, কারণ আমাদের অপরাজনীতি এবং লুটপাটের অর্থনীতি এসব ঘটনার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। আর ‘এই দেশের সাধারণ মানুষ পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক’- এই দাবি নিয়ে আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাই না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকীকরণ প্রক্রিয়ার দীর্ঘ সক্রিয়তা আমাদের সাধারণ মানুষের মননকেও বিষাক্ত করে তুলেছে।
গণতন্ত্র বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা না জেনেই আমরা গণতন্ত্রের নামে দেশের সবকিছুকে তুলে দিয়েছি কিছু রাজনীতিবিদের হাতে। আর চোখের সামনে তো দেখতেই পাচ্ছি যে, ক্ষমতা-সংশ্লিষ্ট শাসক দলগুলোর রাজনীতিতে ন্যূনতম রুচিশীলতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, মানবিকতার বিন্দুমাত্র জায়গা আর অবশিষ্ট নেই। যে মানুষগুলো রাজনীতিকে মানবকল্যাণের সাথে এক করে দেখতে অভ্যস্ত, তারা হয় এসব দল থেকে অপসারিত, অথবা কোণঠাসা।
সাহিত্য-সংস্কৃতি যে মানুষের মনে শুভবোধ সৃষ্টি করবে, তারও কোনো অবকাশ নেই। কারণ সত্যিকারের সাহিত্য এবং সংস্কৃতি যাতে মানুষের কাছে পৌঁছুতে না পারে, তার সার্বিক ব্যবস্থা রাষ্ট্র সম্পন্ন করেছে।
তাই আমাদের পক্ষ থেকে শুধু ঘৃণা প্রকাশই যথেষ্ট নয়। বরং জনপ্রতিরোধের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার কাজটি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সাখাওয়াত টিপু
কবি
সম্প্রতি নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিন্দনীয়। আগেও রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর নির্মম হামলা হয়েছে। বাংলাদেশ বহু জাতিগোষ্ঠী আর বহুভাষিক জনগণের রাষ্ট্র। সর্ব ধর্মের মানুষের রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের সংবিধানে সর্ব ধর্মের মানুষের অধিকারের কথা বলা আছে। তারপরও কেন সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো ঘটছে? নানাবিধ কারণ থাকলে কিছু সংকটকে চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকা। দলীয় লুটপাততন্ত্র আর ক্ষমতাকেন্দ্রীক সুবিধাবাদীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, দেশে সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রায়ণ নেই। অন্তত বুর্জোয়া গণতন্ত্র ব্যক্তি-মানুষের বিকাশের মূল্যবোধকে আমলে নেয়। সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে তার সামাজিক পরাগায়ন ঘটে। এই পরাগায়নে মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশে এই সাংস্কৃতিক সংকট জায়মান।
তৃতীয়ত, নাগরিক অধিকার ভুলণ্ঠিত করে অন্যের সম্পদ আর জমি জবরদস্তি করে ভোগ-দখলের লালসা। ফলে নির্বাচনী ক্ষমতা বদলের রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িক চেহারা প্রকাশ্য হয়। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা, বিচার আর ন্যায় প্রতিষ্ঠা তো গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। সব বর্ণ, সম্প্রদায় আর ভাষিক জনগোষ্ঠীর অধিকারও তাই। দুর্বলের ওপর হামলা-নির্যাতন-লুটপাট করে সবলেরাও সুখে থাকতে পারে না। তাই প্রয়োজন সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে সবার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
স্বকৃত নোমান
কথাসাহিত্যিক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি কি শুধুই যুদ্ধকালের জন্য প্রযোজ্য ছিল? নাকি চিরকালের জন্য? মনে তো হয় না বঙ্গবন্ধুপ্রেমীদের কাছে তাঁর এই বাণীর কোনো গুরুত্ব আছে। ফেইসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের যে ঘটনাটি ঘটল তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যে ছেলেটি ইসলামের ‘অবমাননা’ করেছে তাকে তো গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি অপরাধী হলে আইন মোতাবেক তাঁর বিচার হবে। কিন্তু তাঁর একার ‘অপরাধের’ জন্য এতগুলো বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা কেন? ঘটনার বিচার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে এই হামলা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। ক্ষমতাসীন দলের অনেকে এর সঙ্গে জড়িত। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মান্ধগোষ্ঠী।
আমাদের মনে রাখা দরকার, এই দেশ শুধু মুসলমানের না। কখনো ছিল না। এই দেশ বহু জাতিগোষ্ঠীর। কতিপয় ধর্মোন্মাদ এই সত্যটি স্বীকার করতে চায় না। আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে এদের। স্বীকার করতে যাতে বাধ্য হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তারা কাণ্ডজ্ঞানহীন। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়, সরকারকে সেই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই বহু জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কীভাবে সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা যায়, অবশ্যই সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।