সৌদিপ্রবাসী জোছনা হকের ‘উড়ো চিঠি’
উড়ো চিঠি
কঠিন বাস্তবতার কশাঘাতে জীবনের স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে তুলতে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম সেদিন বসত জমি বিক্রি করে।
স্বজনদের সহস্র ক্রোশ আর অবহেলায় দূর প্রবাসে আমি,
কী নিদারুণ ব্যথা,
কোমল বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল।
মা, আমি তোমার দরিদ্রের সম্রাট বলছি,
কাঁধে সিমেন্টবোঝাই দরিদ্র সম্রাট তোমার ব্যস্ত দালান নির্মাণে,
ভাবনার সিঁড়ি বেয়ে,
মনে পড়ে গেল সুলতান চাচাদের পুকুরের কথা,
একদিন শখের বসে বর্ষায় চাচার ছেলের সাথে পুকুরে মাছ ধরেছিলাম বলে, কী মাইর না আমাকে দিয়েছিল চাচা,
মা, বর্ষা এসেছে,
চাচাদের পুকুরে উজানে কৈ মাছ, শিং মাছ খুব আসে বুঝি।
মা, তুমি বলেছিলে বিদেশ গিয়ে বড় একটা দিঘি বানাতে, সেই দিঘিতে সাত পাড়ার মানুষ এসে যেন মাছ ধরতে পারে।
তা আর হলো কই!
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর দেহটি মিলিয়ে যায় জেলখানার মতো একটি বিছানায়,
খুব ভোরে চোখ মুছতে মুছতে গাড়ির অপেক্ষায়,
এই তো প্রবাস জীবন।
পূর্ববাড়ির বড়দার মেয়ের সাথে কী থেকে কী হয়ে গেল,
মর্মান্তিক একটি দুর্ঘটনা,
বড়দাও সেই শোকে নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে পরপারে চলে গেলেন এই প্রবাসে।
সুখ-দুঃখ বলার মতো বড়দা ছিল আমার কাছের বন্ধু,
উফ, ভাগ্যে...
মা, আমাদের খুকিকে দেখে রাখিও,
দেশের যা অবস্থা,
বাবা তো চলে গেল,
হসপিটালে নেওয়ার পরে কসাই ডাক্তার টাকার জন্য বাবার চিকিৎসা করেনি,
আমি কেমন অপদার্থ সন্তান বলো তো!
আমার চোখের সামনে স্পষ্ট,
আমি তাড়াহুড়া করে টাকা পাঠালাম,
হরতাল, ব্যাংক বন্ধ,
দেশ-বিদেশে যত ক্ষতি আমাদের,
মনকে বোঝাতে পারি না মা,
হসপিটালের সিটে আমার বাবা ছটফট করতে করতে মারা গেল,
আজ যদি বসতজমিটা থাকত,
বাবার জন্য টাকার অভাব হতো না,
এই প্রবাস তো সব কেঁড়ে নিল।
মা, আর ভালো লাগে না,
সুখপাখিটা আমার ধরা হবে না এই প্রবাসে,
মা, অনেক শখ ছিল পাকা একটা বাড়ি, একটা পুকুর, বাবার জন্য একটা ঝুলন্ত চেয়ার, খুকির বিয়ে আর তোমার জন্য একটা লাল টুকটুকে বউ,
তা আর হলো কই!
দরিদ্রতার কশাঘাতে জীবনের ষোলটি বছর,
জীবন সংগ্রামে যুদ্ধ করতে করতে, যুদ্ধ শেষে ঠিকমতো ন্যায্যমূল্য পাই না,
অভাব আমাদের দুয়ারে লেগে থাকে, আমার স্বপ্নের কথা ভাবি না,
আমি ভাবি তোমার কথা, খুকির কথা,
কিন্তু, আমি তো পরাজিত সৈনিকের মতো তোমার সামনে দাঁড়াতে পারি না,
ওয়াদা করেছিলাম।
মাকে ওয়াদা করেছিলাম,
শেষ কবে চিঠি লিখেছিলাম মনে নেই,
লজ্জায় লিখতে পারি না মা,
তুমি বলবে চলে যেতে,
আমি কি তা পারি,
বসতজমি বিক্রি করে প্রবাসে এসেছি,
তা আমাকে পূরণ করে দিতে হবে,
আমি না হয় গরিবের সম্রাট হয়ে থাকব,
তাতে কি!
ভাবনার করিডরে অনেক ব্যথা চেপে রেখে,
উত্তপ্ত দুপুরে কাজের অবসরে,
রাস্তা পারাপারে এক ধাক্কায় ছুড়ে ফেলে দিল দেহখানি,
মাথা ফেটে রক্তে রঞ্জিত হলো মরুপথ,
নিথর দেহটির প্রতি আফসোস ছাড়া পথিক কি দিতে পারে,
এই তো প্রবাস!
পত্রখানা পড়ে আছে তার দেহের নিচে,
আর ডাকযোগে মায়ের কাছে পাঠানো হবে না,
উড়ো চিঠি হয়ে থাকবে মরুর বুকে।