প্রবাসের পত্র
আভিজাত্য আর প্রেমের সৌধ তাজমহল
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম আগ্রার তাজমহল। সম্রাজ্ঞী মমতাজের প্রতি মোগল সম্রাট শাহজাহানের প্রেমের নিদর্শন এটি। ঐতিহাসিকরা বলেন, ২২ বছরের নির্মাণকালে শোষিত শ্রমিকের ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কথিত এই প্রেমসমাধি। ভারতীয় উপমহাদেশের সংগীত-রূপকথারও অংশ তাজমহল। কী আছে ওখানে? তা দেখতে গিয়েছিলাম সেদিন। জানতে চেয়েছি এর মাহাত্ম্য। উপলব্ধি করতে চেয়েছি দুটি কবরের অন্তর্নিহিত আবেদন। রোববার ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই রওনা হলাম দিল্লির হজরত নিজামউদ্দিন রেলওয়ে স্টেশন থেকে। বাংলাদেশের পাঁচজনসহ আমরা ছিলাম মোট ১১ জন; দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি শিক্ষার্থী। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছিল ‘তাজ এক্সপ্রেস’। শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের মাঠ চিরে ছুটে চলা রেলগাড়ির দুদিকে মানুষের বসতি চোখে এলো। দিল্লি পেরিয়ে উত্তর প্রদেশের আগ্রা ছিল আমাদের গন্তব্য। এর মধ্যে মন্দির, মসজিদ, লোকালয় দেখা হলো। দেখা গেল রেললাইনের পাশে নাঙ্গা মানুষ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়। বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলছিল, ওনাদের পূর্বপুরুষ মোগল সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিল। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মতো কোনো কারণে আজ বুঝি তাদের এ দশা!
সকাল ১০টার দিকে আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে আমাদের পৌঁছে দিল ‘তাজ এক্সপ্রেস’। দেড় হাজার রুপি দিয়ে দুটি ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম সারা দিনের জন্য। যদিও পথ মাত্র কয়েক কিলোমিটার। অল্পসংখ্যক লোক হলে অটোরিকশাই যথেষ্ট। আমরা প্রথমেই গেলাম আগ্রা ফোর্ট। সবার জন্য টিকেট নিয়ে প্রবেশ করলাম মোগল হেরেমের অন্দরমহলে। ভারতীয় নাগরিকদের প্রবেশমূল্য ২০ রুপি। অন্য দেশি নাগরিকদের জন্য ৫২০ রুপি। ১০০ রুপির চুক্তিতে একজন গাইড নেওয়া হলো। ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে জেনে নিলাম তাঁর বর্ণনায় খাসমহল, শীষমহল থেকে শুরু করে দেওয়ানে আমসহ অন্যান্য স্থাপনা। দেখলাম, মোগল সম্রাটদের তখত আর হেরেমখানার সব ঐতিহাসিক উপকরণ। গাইড জানালেন, ১৫৬৫ সালে সম্রাট আকবর নির্মাণ করেন এই দুর্গ। আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেব এখানে ছিলেন। আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হয়ে পিতা শাহজাহান ওখানেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৬৫৭ সালে। তিনি আটকের আগেই দুর্গের মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে, যমুনা নদীর অপর তীরে নির্মাণ করেন তাজমহল। দুর্গের ভেতর থেকেই স্পষ্ট চোখে পড়ে সাদা মার্বেল পাথরের ওই বিরাট সৌধ।
ওখান থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া হলো এক রেস্তোরাঁয়। তার পর গেলাম তাজমহলে। তিনটি ফটক দিয়ে প্রবেশ করা যায় তাজমহলে। প্রবেশের আগে সংগ্রহ করতে হয় টিকেট। ভারতীয়দের জন্য ২০ রুপি। সার্ক ও বিমসটেকভুক্ত ১০টি দেশের নাগরিকদের জন্য ৫১০ রুপি করে। আর অন্যদের জন্য ৭৫০ রুপি। উল্লেখ্য, কিছুদিন আগে এক লেখায় দাবি তুলেছিলাম, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ইতিহাস এক; মানুষের গায়ের রং এক। মোগল স্থাপনাগুলোর প্রতি সবার দাবিও সমান। দেশ ভাগ হলেও অতীত ইতিহাস তো ভাগ করা যায়নি। সুতরাং, সার্কভুক্ত সব দেশের মানুষের জন্য তাজমহলসহ প্রত্নস্থানগুলোয় প্রবেশমূল্য সমান করা হোক। যাই হোক, ভারতীয় ও অন্যদের আলাদা আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। যেকোনো একটি ফটকের চেকিং পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় তাজমহলে। তিনটি ফটকই গিয়ে মিশেছে ভেতরের একটি বড় প্রবেশ দরজায়। ওখানে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে সাদা মার্বেল পাথরের ঝকঝকে তাজমহল। দীর্ঘ লাইন আর চেকিং পেরিয়ে, ঘাম ঝরিয়ে এতদূর পৌঁছানোর সব কষ্ট মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যায় সেখানে। শুরু হয় ছবি তোলা, সেলফি, গ্রুপ ছবি। প্রবেশের পর পুরো তাজমহল দেখে বেরিয়ে আসতে সময় লাগে এক ঘণ্টা। আর বাইরে চেকিং ও লাইনে দাঁড়াতে চলে যায় আরো দেড় ঘণ্টা!
মমতাজ ছিলেন সম্রাটের চার স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয় (কারো মতে তৃতীয়)। ১৬১২ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। ১৯ বছরের রাজসংসার শেষ হয় ১৪তম সন্তান জন্মের সময়। ১৬৩১ সালে সম্রাজ্ঞী মারা যান। তার পর ১৬৩২ সালে সম্রাট নির্মাণ শুরু করেন তাজমহল। এটি সমাপ্ত হয় ১৬৫৩ সালে। এই ২১ বছর মমতাজের মৃতদেহ আগ্রা ফোর্টের একটি স্থানে মমি করে রাখা হয়েছিল বলে কথিত আছে। এসবই মোগল হেরেমের প্রেম আর আভিজাত্যের উপাখ্যান। সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি ৭৩ মিটার উঁচু বিরাট এ সৌধের ওপর কালো ও লাল পাথরের অক্ষর আর নানা কারুকাজ বসিয়ে ফুটিয়ে তোলা ক্যালিগ্রাফি দেশি-বিদেশি যেকোনো পর্যটককেই মনে করিয়ে দেবে মোগলদের প্রকৌশল।
২০০৩ সালের হিসাব অনুসারে, তাজমহলের বার্ষিক দর্শনার্থীর সংখ্যা ৩০ লাখ। আর বিরাট সংখ্যক এই দর্শনার্থীর ব্যবস্থাপনা করতে রীতিমতো গলদঘর্ম হয় কর্তৃপক্ষ। এ জন্য ভেতরে ঢুকে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেওয়া হয় না কাউকেই। জুতা পায়ে প্রবেশ করা হয়েছে নিষিদ্ধ। তবে বাইরে ৫/১০ রুপি মূল্যে এক ধরনের কাগজের মোজা পাওয়া যায়। জুতার ওপর ওগুলো জড়িয়ে নিলে চলে। কয়েক বছর আগে তাজমহলের আশপাশের এলাকা ও যমুনা নদীকে দূষণমুক্ত রাখার জন্য দিল্লির বিচার বিভাগ থেকে এক রায় দেওয়া হয়। তার পর থেকে নেওয়া হয়েছে আরো কিছু বিশেষ ব্যবস্থা। মূল বেদির তিন দিকে প্রায় এক মিটারের মতো জায়গা রাখা হয়েছে সংরক্ষিত। আশপাশের বড় কলকারখানাগুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে দূরে। সবকিছু দেখতে দেখতে আমরা ঢুকেছিলাম ভেতরে, যেখানে সম্রাজ্ঞী মমতাজ ও সম্রাট শাহজাহানের কবর রয়েছে। বাইরের আয়তন দেখে যতটা বিমুগ্ধ হয়েছি, আলিশান কবরের দৃশ্য দেখে হয়েছি অনেকটা হতাশ। বেরিয়ে এসে মনে হয়েছে, একটা কবরের জন্য এত কিছু? মনে হয়েছিল, মোগল স্থাপত্যের অপূর্ব কারুকাজ অনেক দীর্ঘস্থায়ী বটে, কিন্তু এর মধ্যে কোনো আবেদন আমি খুঁজে পাইনি। তবুও এটি অমূল্য একটি প্রত্নসম্পদ।