কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক চিকিৎসা দেবে মালয়েশিয়া
আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য এখন অনেকেই দেশের বাইরে যান। সামর্থ্যের শেষটুকু দিয়ে হলেও চেষ্টা করেন প্রিয়জনকে সুস্থ করে তুলতে। দেশের বাইরে চিকিৎসার কথা ভাবলেই প্রথমে মাথায় আসে ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের নাম। ইদানীং এই নামগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরেক দেশ মালয়েশিয়া। যার অন্যতম কারণ, তুলনামূলক কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা।
মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিলের (এমএইচটিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছর মালয়েশিয়ায় চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন প্রায় ১২ লাখ বিদেশি, যার মধ্যে বাংলাদেশি রয়েছেন ৫০ হাজার।
সম্প্রতি এমএইচটিসির আমন্ত্রণে দেশটির স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি দেখতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেরেন আজলি জানান, চলতি বছরের মে পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ার কারণ এখানকার দক্ষ চিকিৎসক ও উন্নত প্রযুক্তি।
শেরেন আজলি আরো বলেন, ‘হৃদরোগ ও ফার্টিলিটি চিকিৎসায় এশিয়ার সেরা হাব হতে চায় মালয়েশিয়া। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি এবং ২০২০ সালকে আমরা স্বাস্থ্যসেবা ভ্রমণের বছর হিসেবে পালন করব।’
দেশটির রাজধানী কুয়ালালামপুরের গ্লেনেগেলস, থমসন, সান ওয়ে, কেপিজে আমপাং পুত্রেই ও কেপিজে দামানসারা বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো ঘুরে দেখা যায়, আধুনিক ও উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হাসপাতালগুলোতে বেশ পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছিল চোখে পড়ার মতো।
কেপিজে আমপাং পুত্রেই বিশেষায়িত হাসপাতালের কার্ডিওলজিস্ট ডা. ইকা ফায়জুরা জানান, গত দুই বছরে হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সব যন্ত্রপাতি বদলানো হয়েছে। নতুন নতুন যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগীদের আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
ডা. ইকা ফায়জুরা বলেন, ‘আগে আমাদের রোগীদের এক থেকে তিন মাস পরপর ফলোআপে আসতে হতো। এখন আমরা ছয় মাস পর ফলোআপ করি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এটি সম্ভব হচ্ছে।’
থমসন হাসপাতাল গ্রুপের সিইও নাদিয়া ওয়ান জানান, গত কয়েক বছরে থমসন হাসপাতালে রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসার অনেক নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। নাহিদা ওয়ান আরো জানান, তাঁদের ফার্টিলিটি সেন্টার আন্তর্জাতিক মানের এবং অনেক নিঃসন্তান দম্পতি এখানে এসে সমাধান পাচ্ছেন।
‘থমসন সিঙ্গাপুরভিত্তিক একটি গ্রুপ। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের হাসপাতাল রয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি। যেহেতু সিঙ্গাপুরের তুলনায় মালয়েশিয়ার মুদ্রার মান কম, এখানে চিকিৎসাসেবা তুলনামূলক কম। আর মুসলিম দেশ হওয়ায় অন্যান্য মুসলিম দেশের জন্য মালয়েশিয়া বেশি স্বস্তিদায়ক,’ বলেন নাদিয়া ওয়ান।
পেশেন্ট বিয়ন্ড বর্ডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা যায়, হার্টের বাইপাস সার্জারিতে সিঙ্গাপুরে যেখানে ৫৪ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়, সেখানে মালয়েশিয়ায় খরচ পড়ে মাত্র ২০ হাজার মার্কিন ডলার। থাইল্যান্ডের তুলনায়ও যা ১৩ হাজার মার্কিন ডলার কম। ভালভ প্রতিস্থাপনে সিঙ্গাপুরের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কম খরচ পড়ে মালয়েশিয়ায়। সিঙ্গাপুরে যেখানে এর জন্য খরচ করতে হয় ৪৬ হাজার মার্কিন ডলার, সেখানে মালয়েশিয়ায় তা ১৫ হাজার। আর থাইল্যান্ডে এই খরচ ১৯ হাজার মার্কিন ডলার।
আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি নিতে আগ্রহীদেরও কম খরচ পড়বে মালয়েশিয়ায়। ওষুধ খরচ ছাড়া আইভিএফের একটি সাইকেলে সেখানে খরচ পড়বে চার হাজার ২০০ ডলার, যা সিঙ্গাপুরের অর্ধেক।
গ্লোবাল মার্কেট রিপোর্ট ২০১৮ অনুযায়ী, উন্নত চিকিৎসা দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে খরচ বিবেচনায় মালয়েশিয়ার অবস্থান অষ্টম। যেখানে বেশি খরচের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। তালিকায় মালয়েশিয়ার ওপরে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ভারত ও থাইল্যান্ড।
গ্লেনেগেলস হসপিটালের আন্তর্জাতিক বিপণন বিভাগের ম্যানেজার ফজল আজওয়ানদি বিন আবু বকর জানান, এখানে হাসপাতালগুলোর রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, সরকার থেকে চিকিৎসার একটি সর্বোচ্চ খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বেশি আদায় করলে রোগী স্বাস্থ্য বিভাগে অভিযোগ করতে পারেন এবং এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ান সরকার খুব কঠোর।
সব রোগীকেই সর্বোচ্চ সেবা দিতে বদ্ধপরিকর উল্লেখ করে কেপিজে আমপাং পুত্রেই হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এন্ড্রু উইলিয়াম বার বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের রোগীদের ব্যাপারে আমরা আরো অধিক সচেতন।’
‘এরই মধ্যে বাংলাদেশে কেপিজে-শেখ ফজিলাতুন্নেছা হাসপাতাল করেছি। আশা করি, মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবার সম্পর্ক আরো নিবিড় হবে,’ যোগ করেন এন্ড্রু বার।
মূলত মালয়েশিয়ার সরকারি হাসপাতালগুলো শুধু সে দেশের নাগরিকদেরই চিকিৎসা দিয়ে থাকে। তবে অন্তত ৪০ শতাংশ মালয়েশীয় নাগরিক বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসার জন্য আগত পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকারিভাবেই পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে। চিকিৎসায় এশিয়ার হাব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপ বা পিপিপির আওতায় মালয়েশিয়া হেলথকেয়ারের অধীনে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় মালয়েশিয়া হেলথকেয়ার ট্রাভেল কাউন্সিল। যারা বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবার তদারক করছে এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্যসেবার নতুন দিগন্ত।
স্বাস্থ্যসেবায় মালয়েশিয়ার অগ্রগতির স্বীকৃতি দিয়েছে বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাও। ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে গ্লোবাল রিটায়ারমেন্ট ইনডেক্সের ‘বেস্ট কান্ট্রি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ফর হেলথকেয়ার’ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে দেশটি। ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল ট্রাভেল জার্নাল ২০১৫ সাল থেকে টানা তিন বছর মালয়েশিয়াকে দিয়েছে মেডিকেল ট্রাভেল অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবায় অবদানের জন্য গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক অনেক স্বীকৃতি ও অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে মালয়েশিয়া।
মালয়েশিয়া হেলথ ট্রাভেল কাউন্সিলের সিইও শেরেন আজলি বলেন, ‘এখানে অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। মালয়েশিয়া অনেকের সেকেন্ড হোম। এখানকার রান্না-খাওয়া সবকিছুই হালাল। কাজেই মুসলিম দেশ হিসেবে মালয়েশিয়া নিজের দেশের মতই মনে করতে পারেন বাংলাদেশ থেকে আগত রোগীরা। বাংলাদেশে আমাদের এজেন্সির মাধ্যমে সহজেই রোগীরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ও ভিসা করাতে পারবেন।’
‘আর আমরা বিমানবন্দরে রোগীদের জন্য আলাদা লাউঞ্জ রেখেছি। চিকিৎসার জন্য আসা পর্যটকরা বিমানবন্দরে পৌঁছালেই সেখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং হাসপাতাল পৌঁছানো থেকে শুরু করে বাকি কাজটুকু এমএইচটিসি করে থাকে,’ যোগ করেন শেরেন আজলি।