মুনাফার লোভে দুর্বল শেয়ারের দাপট বাড়ছে
বিদায়ী সপ্তাহে (রোববার থেকে বৃহস্পতিবার) দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সব সূচক পতনে লেনদেন শেষ হয়েছে। সপ্তাহটিতে লেনদেন পরিমাণ কমেছে। কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর উত্থানের চেয়ে পতন দ্বিগুণ। বাজার মূলধন কমেছে চার হাজার কোটি টাকা। মোট লেনদেনের ২৫ শতাংশই টপটেন কোম্পানির দখলে রয়েছে। টপটেনের লেনদেনে ৯০ শতাংশই ‘বি’ ক্যাটাগরি বা দুর্বল কোম্পানির শেয়ার। টপটেনে ওঠে আসা নয়টি দুর্বল কোম্পানির শেয়ারগুলো হলো- ফু-ওয়াং ফুড, খান ব্রাদার্সের, এমারেল্ড অয়েল, খুলনা প্রিন্টিং, বিডি থাই, দেশবন্ধু পলিমার, ইয়াকিন পলিমার, প্যাসিফিক ডেনিমস ও সেন্ট্রাল ফার্মা। এছাড়া টপটেন গেইনারে উঠে এসেছে ৮০ শতাংশই দুর্বল কোম্পানির শেয়ার।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ফ্লোর প্রাইজ আরোপের কারণে কোম্পানিগুলোর শেয়ার একটি জায়গায় আটকে আছে। এতে কোম্পানিগুলোর শেয়ার স্বাভাবিক লেনদেন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু পুঁজিবাজারের নিয়ম, এটি না। এই বাজারকে স্বাভাবিকভভাবে চলতে দিতে হবে। শেয়ারবাজার উত্থান পতন থাকবে। শুধু উত্থান যেমন প্রত্যাশা করা বোকামি, তেমনি পতন ভাল না।
দেশের পুঁজিবাজারের ফ্লোর প্রাইস তুলে দিতে আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি জানিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দেশের পুঁজিবাজারের পতন ঠেকাতে শেয়ারের যে সর্বনিম্ন দাম (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, তা পুঁজিবাজারের সুসময়ে তুলে নেওয়া হবে।
দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দাপট চলছে জানিয়ে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ভাল কোম্পানির শেয়ারগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ ফ্লোরপ্রাইজে আটকে আছে। এই সুযোগে শেয়ারবাজারের কারসাজি চক্র দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলছে। তাদের এই খেলার কারণে দুর্বলসহ বন্ধ থাকা কোম্পানিগুলোর শেয়ার দর হ্রাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই ধারায় গত সপ্তাহে টপটেন লেনদেনে উঠে এসেছে নয় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার। এদের মধ্যে ফু-ওয়াং ফুড, খান ব্রাদার্স, বিডি থাই এবং সেন্ট্রাল ফার্মা সর্বশেষ সমাপ্ত (২০২২-২০২৩) অর্থবছরে লোকসান গুনছে। এতে শেয়ারহোল্ডরদের লভ্যাংশ দিতে পারছে না কোম্পানিগুলো। টপটেনে আসা অন্য কোম্পানি খুলনা প্রিন্টিং এবং প্যাকেজিং আমার জানা মতে, উৎপাদন বন্ধ। ইয়াকিন পলিমারও লোকসান গুণছে। আরও বলেন, নামমাত্র লভ্যাংশ দেবে দেশবন্ধু পলিমার ও প্যাসিফিক ডেনিমস। উৎপাদনে ফিরে বিভিন্ন অজুহাতে একটি শ্রেণি এমারেল্ড অয়েলের শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। গত নয় মাসে শেয়ারটির দর বেড়েছে ৮৬ টাকা। এই বৃদ্ধিতে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
পতন পুঁজিবাজারের ভাল কোম্পানির শেয়ার দর কেনাবেচায় কদর হারিয়েছে জানিয়ে একাধিক সিকিউরিটিজ হাউজের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, পুঁজি হারানোর ভয়ে বর্তমান পুঁজিবাজার প্রতি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অনেকে আবার নিষ্ক্রিয় হয়ে সাইট লাইনে আছে। সাইট লাইনে থেকে বাজারকে অনুসন্ধান করছে। এরই মধ্যে বর্তমান বাজারের নতুন বিনিয়োগকারী বাড়ছে।
কিছু লোক অতি মুনাফার প্রত্যাশায় দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলছে জানিয়ে তারা বলেন, এতে ভাল কোম্পানির শেয়ার দর হারাচ্ছে। আর দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ধরা খাচ্ছে।
তারা বলেন, বর্তমান পুঁজিবাজারে মূলধন সাত লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই সাইজের বাজারের লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু নানা সমস্যায় লেনদেন হচ্ছে চারশ-পাঁচশ কোটি টাকার ঘরে।
দুর্বল কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা প্রসঙ্গে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সম্প্রতি মানহীন কোম্পানির শেয়ারদর কেনাবেচা হচ্ছে। অনেক কোম্পানির শেয়ারদর অস্বাভাবিকহারে বাড়ছে। এদের মধ্যে লভ্যাংশ না দেওয়া ও উৎপাদন বন্ধ কোম্পানি রয়েছে। বিষয়গুলো বিএসইসির নজরে পড়েছে। ইতোমধ্যে অতি গুরুত্বের সাথে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কমিশন খতিয়ে দেখছে। এগুলো কারা কিনছে। কেনার পেছনে অন্যকোন উদ্দেশ্য আছে কিনা, সেটা আমলে নেওয়া হচ্ছে। কেনাবেচার ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম হলে কমিশন ব্যবস্থা নিবে।
স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্র মতে, গেল সপ্তায় ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে দুই হাজার ১৭৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। আগের সপ্তায় লেনদেন হয়েছিল দুই হাজার ৫৯৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এই সময়ের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ৪২২ কোটি ২৯ লাখ টাকা বা ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। ডিএসইতে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে ৪৩৫ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে গড়ে লেনদেন হয়েছিল ৫১৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। গেল সপ্তাহে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৪০৩টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়। এর মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৫০টির, দর কমেছে ১০৩টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২১৩টি কোম্পানির। লেনদেন হয়নি ৩৫টি কোম্পানির শেয়ার।
সপ্তাহে সব ধরনের সূচক পতনে লেনদেন শেষ হয়। এক সপ্তাহে ব্যবধানে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৪ দশমিক ৬৯ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ২৫৭ দশমিক ১৫ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস তিন দশমিক ২২ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৩৫৯ দশমিক ২৮ পয়েন্টে। এছাড়া ডিএসই ৩০ সূচক আট দশমিক ৯০ পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১১৮ দশমিক ৯৪ পয়েন্টে
গত ১০ অক্টোবর পুঁজিবাজারে সরকারি বন্ডের লেনদেন শুরু হয়। এরপর ডিএসইতে ২৫০ বন্ডের লেনদেন হয়। এতে ডিএসইর শেয়ারবাজার মূলধন ২ লাখ ৫২ হাজার ২৬৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা বেড়ে ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৯৩৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছিল। এরপর গত ২৭ অক্টোবর শেয়ারবাজার মূলধন কমে দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার মূলধন দাঁড়ায় সাত লাখ ৭৫ হাজার ২৪২ কোটি ৫১ লাখ টাকায়। এর আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজার মূলধন দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ ৭৯ হাজার ২০৯ কোটি ৬২ লাখ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজার মূলধন কমেছে তিন হাজার ৯৬৭ কোটি ১১ লাখ টাকা বা দশমিক ৫১ পয়েন্ট।
এদিকে গেল সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) ডিএসইর পিই রেশিও অবস্থান করে ১৪ দশমিক ৪৬ পয়েন্টে। আগের সপ্তাহের শেষে (বৃহস্পতিবার) পিই রেশিও দাঁড়িয়েছিল ১৪ দশমিক ৪৯ পয়েন্টে। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুঁজিবাজারে কোনো কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ১৫ পয়েন্ট ছাড়ালেই তা বিনিয়োগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মার্জিন ঋণের যোগ্যতা হিসেবে সর্বোচ্চ ৪০ পিই রেশিও বেঁধে দিয়েছে। এ হিসেবে ৪০ পর্যন্ত পিইধারীর শেয়ার বিনিয়োগের জন্য নিরাপদ বলে জানায় বিএসইসি। সেই হিসেবে গত বৃহস্পতিবার ডিএসইর পিই দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৪৬ পয়েন্টে। পিই রেশিও হিসাবে বিনিয়োগ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।
গেল সপ্তাহে বি ক্যাটাগরির ৯০ শতাংশ এবং এ ক্যাটাগরির ১০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার টপটেন লেনদেনে অবস্থান করেছে। এর আগের সপ্তাহে এ ক্যাটাগরির ৪০ শতাংশ এবং বি ক্যাটাগরির ৬০ শতাংশ কোম্পানির শেয়ার টপটেন লেনদেনে অবস্থান করেছিল। গেল সপ্তাহে মোট লেনদেনের ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার ১০ কোম্পানির দখলে রয়েছে। এই দশ কোম্পানি লেনদেন করেছে ৫৪৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বি ক্যাটাগরির ফু-ওয়াং ফুডের শেয়ারে। কোম্পানিটি একাই মোট শেয়ারের লেনদেন করেছে ৭০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বা ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। কোম্পানিটির শেয়ার দর কমেছে ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ।
এছাড়া খান ব্রাদার্সের (বি ক্যাটাগরি) তিন দশমিক শূন্য সাত শতাংশ, এমারেল্ড অয়েলের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ৯৯ শতাংশ, খুলনা প্রিন্টিংয়ের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ৫২ শতাংশ, জেমিনি সী ফুডের (এ ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ৪৬ শতাংশ, বিডি থাইয়ের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ৪০ শতাংশ, দেশবন্ধু পলিমারের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ২৩ শতাংশ, ইয়াকিন পলিমারের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক ২১ শতাংশ, প্যাসিফিক ডেনিমসের (বি ক্যাটাগরি) দুই দশমিক শূন্য তিন শতাংশ এবং সেন্ট্রাল ফার্মার (বি ক্যাটাগরি) এক দশমিক ৯৮ শতাংশের শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারের এ ক্যাটাগরির শেয়ার বি ও জেড ক্যাটাগরির থেকে তুলনামূলক ভালো কোম্পানি। নিয়ম অনুসারে, যেসব কোম্পানি বছর শেষে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ থেকে তার ঊর্ধ্বে লভ্যাংশ (নগদ বা বোনাস) দেয় তারাই এ ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ার। যেসব কোম্পানি বছর শেষে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের ১০ শতাংশ নিচে থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পাঁচ শতাংশ লভ্যাংশ (নগদ বা বোনাস) দেয় তারা বি ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ার। যেসব কোম্পানি বছর শেষে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের পাঁচ শতাংশ নিচে থেকে শুরু জিরো লভ্যাংশ (নগদ বা বোনাস) দেয় তারাই জেড ক্যাটাগরি কোম্পানির শেয়ার। এছাড়া এন ক্যাটাগরি নতুন কোম্পানির শেয়ার। যেগুলোর পুঁজিবাজারের লেনদেন শুরু হয়েছে কিন্তু বছর পার হয়নি, সেইগুলো এন ক্যাটাগরিতে রয়েছে।