লোকসানে খুলনা প্রিন্টিং, তবুও বাড়ছে শেয়ার দর
লোকসান কারণে গত কয়েক অর্থবছর ধরে লভ্যাংশ পাচ্ছে না খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কোম্পানির বিনিয়োগকারীরা। অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার দর ছুটছে লাগামহীন। গত এক মাসে এর শেয়ার দর বেড়েছে ১৬০ শতাংশ। অভিযোগ বলছে, এর পেছনে রয়েছে কারসাজি। শেয়ার দরের এমন অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) জানায়নি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের কর্তৃপক্ষ। পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের দাবি, এতে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগকারীদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
গত এক মাসে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মোট শেয়ারের মাধ্যমে বাজার মূল্যে বেড়েছে ১১৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অপরদিকে, এই সময়ে ধারণ করা বিনিয়োগকারীদের (সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক) শেয়ারের মাধ্যমে বাজার মূল্যে বেড়েছে ৬৯ কোটি সাত লাখ টাকা। সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির ৬০ দশমিক ২৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে।
ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ২৯ অক্টোবর খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার দর ছিল ৯ টাকা ৮০ পয়সা। আজ রোববার (২৬ নভেম্বর) কোম্পানিটির লেনদেন শুরুর শেয়ার দর ছিল ২৫ টাকা ৫০ পয়সা। এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ১৫ টাকা ৭০ পয়সা বা ১৬০ দশমিক ২০ শতাংশ।
গত ২৯ অক্টোবর মোট শেয়ারের বাজার মূল্যে ছিল ৭১ কোটি ৫৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা। আজ রোববার কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্য হয়েছে ১৮৬ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের বাজার মূল্য বেড়েছে ১১৪ কোটি ৬৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা।
ওয়েবসাইট থেকে আরও জানা যায়, কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ ধারণ করেছে সাধারণ বিনিয়োগকারী। এক দশমিক ১১ শতাংশ ধারণ করেছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। সেই হিসেবে তাদের (সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী) শেয়ারের বাজার মূল্য বেড়েছে ৬৯ কোটি সাত লাখ ৮৮ হাজার ৯৪৭ টাকা।
কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানার জন্য রেগুলেটরদের (বিএসইসি) দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। শেয়ার নিয়ে কারসাজির অভিযোগ করে একাধিক বিনিয়োগকারী বলছেন, অনেকদিন ধরে কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে একটি চক্র কারসাজি করে শেয়ার দর বৃদ্ধি করছে। গত এক মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ১৬০ শতাংশ।
ডিএসই ওয়েবসাইট আরও বলছে, কোম্পানিটির শেয়ার দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার কারণে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংকে গত ৬ নভেম্বর ডিএসই নোটিশ পাঠিয়েছিল। কিন্তু, ডিএসইর দেওয়া সেই নোটিশের কোনো সাড়া দেয়নি কোম্পানিটি। অপরদিকে, কোম্পানিটির শেয়ার দর বৃদ্ধি থামেনি, বরং বেড়েছে। এরই ধারায় ইমেল এবং হার্ড কপির মাধ্যমে ফের গত ২২ নভেম্বর কোম্পানিটির শেয়ার দর বাড়ার কারণ জানতে নোটিশ পাঠায় ডিএসই। সেই নোটিশেরও কোনো সাড়া দেয়নি কোম্পানিটি।
শেয়ার দর বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে কোম্পানির সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে কলটি রিসিভ করেন মিলন খান। মুঠোফোনে তিনি কোম্পানিটির সাবেক সচিব বলে পরিচয় দেন। বলেন, ‘খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং কোম্পানির সচিবের দায়িত্ব পালন করেছি। তবে, এখন সেই দায়িত্বে নেই। চাকুরি ছেড়েছি এক বছর হবে।’ পরে ডিএসইর ওয়েবসাইটে দেওয়া কোম্পানির একাধিক নম্বরে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা সম্ভব হয়নি। কল করেও কাউকে পাওয়া যায়নি।
শেয়ার দর বাড়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে জানিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ার দর বৃদ্ধির বিষয়টি কমিশনের নজরে পড়েছে। শেয়ার দর কেন বাড়ছে, তার প্রকৃত কারণ জানতে এরই মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে। ডিএসইর অনুসন্ধান শেষ হলে, বিএসইসিকে প্রতিবেদন পাঠাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শেয়ারটির দর বাড়ানোর ক্ষেত্রে অনিয়ম পাওয়া গেলে কোম্পানির বা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ডিএসইর প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, একাধিকবার খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের কর্তৃপক্ষের কাছে কোম্পানিটির শেয়ার দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু, তারা এখনও সাড়া দেয়নি।’ দর বাড়ার অনুসন্ধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে বিএসইসি আমাদের কোনো নির্দেশনা দেয়নি।’
ডিএসইর ওয়েবসাইট দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের ২০২১-২০২২ অর্থবছর দ্বিতীয় প্রান্তিক তুলনায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির লোকসান গুনছে। সর্বশেষ দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ছয় পয়সা। আগের অর্থবছর (২০২১-২০২২) একই সময়ে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল এক টাকা ৯৬ পয়সা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছর দুই প্রান্তিকে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১১ পয়সা। আগের ২০২১-২০২২ অর্থবছর একই সময়ে (জুলাই-ডিসেম্বর) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল দুই টাকা ৯৯ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছে নেগেটিভ এক টাকা ৯৮ পয়সা। ওই সময় কোম্পানিটির ক্যাশ ফ্লো ছিল নেগেটিভ ১১ পয়সা।
২০২১-২০২২ অর্থবছর (জুলাই-জুন) কোম্পানিটি লোকসানে পড়ে লভ্যাংশ দিতে পারেনি। ওই অর্থবছরের কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছিল তিন টাকা ১০ পয়সা। আগের ২০২০-২০২১ অর্থবছর একই সময়ে (জুলাই-জুন) শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল ছয় টাকা ১২ পয়সা। ৩০ জুন ২০২১ সালে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য দাঁড়িয়েছিল নেগেটিভ এক টাকা ৮৬ পয়সা। ওই সময় কোম্পানিটির ক্যাশ ফ্লো ছিল নেগেটিভ এক টাকা ১৭ পয়সা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরেও (জুলাই-জুন) কোম্পানিটি লোকসান কারণে লভ্যাংশ দিতে পারেনি।
২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। কোম্পানিটির অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি টাকা। পরিশোধিত মূলধন ৭৩ কোটি চার লাখ টাকা। শেয়ার সংখ্যা সাত কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার। কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকরা ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে। এ ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালক এক দশমিক ১১ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে। রিজার্ভ নেগেটিভ ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ২৩ কোটি ৬১ লাখ ৬০ টাকা এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ৩১ কোটি ৫৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা।