দক্ষিণ আফ্রিকার বৃষ্টি-দুর্ভাগ্য
অনেক প্রথমের আসর ছিল ১৯৯২ বিশ্বকাপ। রঙিন পোশাক, সাদা বল, ফ্লাডলাইট, ফিল্ডিং সীমাবদ্ধতা নতুন মাত্রা দিয়েছিল ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতাকে। সেই বিশ্বকাপ প্রথম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যও। ২২ বছর নিষিদ্ধ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরার পর প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে যায় নেলসন ম্যান্ডেলার দেশ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করে নিলেও শেষ হাসি হাসতে পারেনি প্রোটিয়ারা। বরং মর্মান্তিক এক ‘ট্র্যাজেডি’র শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছিল তারা।
১৯৯২ বিশ্বকাপে নতুন আরেকটি বিষয় ছিল বৃষ্টিসংক্রান্ত আইন। ওই টুর্নামেন্টের জন্য নিয়ম করা হয়েছিল, খেলার দ্বিতীয় ভাগে বৃষ্টি এলে প্রথমে বোলিং করা দলের সবচেয়ে কম রান দেওয়া ওভারগুলোর রানসংখ্যা কমানো হবে। ধরা যাক বৃষ্টির কারণে খেলার দৈর্ঘ্য পাঁচ ওভার কমে গেল। তখন হিসাব করা হবে প্রথমে বোলিং করা দল কোন পাঁচ ওভারে সবচেয়ে কম রান দিয়েছে। সেই কম রান দেওয়া ওভারগুলোতে যত রান হয়েছে তত রান বাদ দিয়ে নির্ধারণ করা হবে নতুন টার্গেট। টেলিভিশন সম্প্রচারের সময়সীমা যেন বেড়ে না যায়, সে জন্যই এমন ‘অদ্ভুতুড়ে’ নিয়ম করা হয়েছিল।
সেই বিশ্বকাপে বেশ কয়েকটি ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল বৃষ্টি। যেমন লিগ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়েও বৃষ্টিতে খেলা পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ায় একটি পয়েন্ট পেয়ে যায় পাকিস্তান। এবং শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নও হয় ইমরান খানের দল। কিন্তু বৃষ্টির জলে যে দারুণ ছন্দে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ স্বপ্ন ধুয়ে যাবে, তা বোধহয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
দুর্দান্ত একটা দল নিয়ে ১৯৯২ বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। অধিনায়ক কেপলার ওয়েলস, অ্যালান ডোনাল্ড, হান্সি ক্রনিয়ে, জন্টি রোডসদের অসাধারণ পারফরম্যান্স মুগ্ধ করে দিয়েছিল ক্রিকেটবিশ্বকে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ‘উড়ন্ত’ জন্টি রোডস যেভাবে ইনজামাম-উল-হককে রান আউট করেছিলেন তা এখনো অনেক ক্রিকেটভক্তের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।
প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে সহজেই নয় উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, ভারতকে হারিয়ে উঠে যায় সেমিফাইনালে।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল শুরু হওয়ার আগেই হানা দেয় বৃষ্টি, খেলার দৈর্ঘ্য কমে আসে ৪৫ ওভারে। গ্রায়েম হিকের ৯০ বলে ৮৩ রানের চমৎকার ইনিংসের ওপরে ভর করে ছয় উইকেটে ২৫২ রান করে ইংল্যান্ড।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে অ্যান্ড্রু হাডসন (৪৬), এড্রিয়ান কাইপার (৩৬), জন্টি রোডস (৪৩) আর ক্রনিয়ের (২৪) দায়িত্বশীল ব্যাটিং লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে।
শেষ পাঁচ ওভারে চার উইকেট হাতে নিয়ে প্রয়োজন ছিল ৪৭ রান। সপ্তম উইকেটে ব্রায়ান ম্যাকমিলান ও ডেভ রিচার্ডসন মাত্র তিন ওভারে ২৬ রানের জুটি গড়ে লক্ষ্যকে নিয়ে আসেন হাতের নাগালে।
দুজন যেভাবে ব্যাট করছিলেন তাতে জয়টা মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। ম্যাকমিলান ২১ বলে ২১ রান আর রিচার্ডসন ১০ বলে ১৩ রান নিয়ে ব্যাট করছিলেন। কিন্তু ৪৩তম ওভারের শেষ বলের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম ‘বিশ্বকাপ-ট্র্যাজেডি’র জন্ম দিতেই যেন আবার শুরু হলো বৃষ্টি। জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ১৩ বলে ২২ রান।
সে সময় ১২ মিনিটের বৃষ্টি একটা ‘ক্লাসিক’ ম্যাচকে পরিণত করেছিল বিশ্বকাপের অন্যতম বিতর্কিত ম্যাচে। বৃষ্টি শেষে আম্পায়াররা তাঁদের ‘অদ্ভুত’ হিসেবের খাতা খুলে বসলেন নতুন টার্গেট ঠিক করতে।
প্রথমে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ডে দেখা গেল নতুন টার্গেট লেখা হয়েছে ৭ বলে ২২ রান। কিছুক্ষণ পর সেখানে দেখা গেল নির্মম, হাস্যকর এক টার্গেট-১ বলে ২২ রান। সৌজন্য রক্ষার খাতিরে অসম্ভব এই টার্গেট নিয়ে একমাত্র বলটির মুখোমুখি হতে আবার ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন ম্যাকমিলান ও রিচার্ডসন। ক্রিস লুইসের শেষ বলে একটা রান নিয়ে ক্ষুব্ধভাবে প্যাভিলিয়নের দিকে তাকালেন দুই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যান। গ্যালারি থেকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হলো না বিজয়ী দলকে। বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার আনন্দে মাতলেন না ইংলিশ খেলোয়াড়রাও। এ রকম বিতর্কিত একটা জয় পেয়ে হয়তো কিছুটা বিব্রতই হয়েছিলেন তাঁরা।
বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বৃষ্টি-দুর্ভাগ্যের সেখানেই শেষ নয়। ১১ বছর পর ২০০৩ বিশ্বকাপে সেটা ফিরেছিল নতুন রূপে। ততদিনে অবশ্য ক্রিকেটে এসে গেছে বৃষ্টিসংক্রান্ত যৌক্তিক আইন, ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি। তবু ‘ট্র্যাজেডি’ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা বেরিয়ে আসতে পারেনি।
ওই বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকাই। গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে শ্রীলঙ্কার মুখোমুখি হয়েছিল প্রোটিয়ারা। প্রথমে ব্যাট করে মারভান আতাপাত্তুর ১২৪ ও অরবিন্দ ডি সিলভার ৭৩ রান শ্রীলঙ্কাকে এনে দিয়েছিল নয় উইকেটে ২৬৮ রান।
জবাবে ওপেনার হার্শেল গিবসের ৭৩ রানের সুবাদে ভালো সূচনা পেয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ষষ্ঠ উইকেটে ৬৩ রানের জুটি গড়ে দলকে জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন অধিনায়ক শন পোলক ও মার্ক বাউচার। ৪৩তম ওভারে দলীয় ২১২ রানে পোলকের রান আউটে ভেঙে যায় এই জুটি।
পোলক আউট হওয়ার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। তবু তার মধ্যেই খেলা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দুই আম্পায়ার স্টিভ বাকনর ও শ্রীনিবাস ভেঙ্কটরাঘবন। নতুন ব্যাটসম্যান ল্যান্স ক্লুজনারের আট বলে মাত্র এক রান চাপ বাড়িয়ে দেয় স্বাগতিকদের ওপর। খেলা যে বৃষ্টির জন্য আগেই শেষ হতে যাচ্ছে, সেটা ততক্ষণে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও স্পষ্ট। সাজঘরে শুরু হয়ে যায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতিতে টার্গেটের হিসাব-নিকাশ।
৪৪ ওভার শেষে ব্যাটসম্যানদের কাছে একটা বার্তা আসে সাজঘর থেকে। যেখানে বলা হয় জিততে হলে ৪৫ ওভার শেষে করতে হবে ২২৯ রান। এবং আর কোনো উইকেট হারানো চলবে না। অর্থাৎ ৪৫তম ওভারে দরকার ১৩ রান। বল করতে আসেন সর্বকালের অন্যতম সেরা স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরন। প্রথম তিন বলে এক রান হওয়ার পর চতুর্থ বলে ‘ওয়াইড’ থেকে হয়ে যায় চার রান। অর্থাৎ এক বলেই পাঁচ রান। ওয়াইডের জন্য একটি বলও পেয়ে যায় স্বাগতিক দল।
‘বৈধ’ চতুর্থ বলে এক রান নেন ক্লুজনার। পরের বলে দারুণ এক ছয় মেরে জয়ের উল্লাসে ফেটে পড়েন বাউচার। পাঁচ বলেই ১৩ রানের ‘লক্ষ্যপূরণ’ হয়ে যাওয়ায় শেষ বলে কোনো ঝুঁকি নেননি বাউচার, রক্ষণাত্মক শট খেলে ওভার শেষ করেন তিনি।
বৃষ্টির বেগ বেড়ে যাওয়ায় ৪৫ ওভার শেষে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। তখন দক্ষিণ আফ্রিকা শিবিরে শুরু হয় দ্বিধা-সন্দেহ। কিছুক্ষণ পর যা রূপ নেয় ভয়াবহ হতাশায়। নতুন করে হিসাব করে দেখা যায় ২২৯ রান দরকার ছিল ম্যাচটা ‘টাই’ করার জন্য! জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২৩০ রান। ছোট্ট একটা হিসাবের ভুলে সুপার সিক্সের আগেই গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে আরেকটি ‘ক্রিকেট-ট্র্যাজেডি’র জন্ম দেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।