বৃষ্টি ও কক্সবাজার
সবাই বলে শীতকাল বা শুকনো মৌসুম নাকি কক্সবাজার ভ্রমণের আদর্শ সময়। গরমে নাকি সৈকতে যাওয়া যায় না, বালুর উত্তাপে দাঁড়িয়ে থাকা দায়, সমুদ্র উপভোগ তো দূরের কথা! আর বৃষ্টিতে নাকি কক্সবাজারের অফ সিজন!
আমি সব মৌসুমেই কক্সবাজারে গিয়েছি। আমার কাছে শীতে কক্সবাজারকে মনে হয়েছে বস্তি! মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না, একদণ্ড কোথাও চুপচাপ বসা যায় না, মন খুলে ঘুরে বেড়ানো যায় না, চারদিকে মানুষে গিজগিজ করে। শীতকাল তাই কক্সবাজার উপভোগের জন্য কিছুতেই আদর্শ হতে পারে বলে আমার মনে হয়নি কখনো!
আর গরমে কক্সবাজার? সে অন্তত শীতের চেয়ে ভালো! লোকজন কম থাকে, হোটেল-মোটেল আর খাওয়ার খরচও কমে যায় অনেক, নির্দ্বিধায় নির্জনে সমুদ্রকে দেখা যায়, দূর থেকে গর্জন শুনে অনুভব করা যায়, তাই গরমে কক্সবাজারে যাওয়া কিছুতেই নিরুৎসাহিত করার কোনো কারণ হতে পারে বলে মনে হয় না। আর বিচের তপ্ত বালুর কথা ভাবছেন? উত্তপ্ত রোদে কমনীয় ত্বক পুড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত?
খুব ভোরে সৈকতে যান, স্নিগ্ধ সকালের নির্মল বাতাস গায়ে মেখে উপভোগ করুন সমুদ্র, অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাতলামি-পাগলামি, পা ছোঁয়ান নরম আর ভেজা বালুতে, অনুভব করে দেখুন ওর শীতলতা। দেখবেন শিহরণ জাগবে মনে-প্রাণে! মাতাল হবেন, হবেন আকুল এমন আহ্বানে! এরপর আবাসে ফিরে যদি থাকে সুইমিং পুল আপনার হোটেল বা মোটেলে, নিজেকে সঁপে দিন পুলের মায়াবি নীল জলে। আর কান পেতে শুনুন, উপভোগ করুন অদূরে অবিরাম গর্জন তোলা সমুদ্রের সাতকাহন।
তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে হেলেদুলে গনগনে দুপুর কাটিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়ুন সমুদ্রের আশপাশে ছায়াঘেরা নির্জনতায়, অপেক্ষা করুন হেলে পড়া সূর্যের। রোদ কমে নরম হলে আবারও চলে যাওয়া যাবে সমুদ্রের একদম কাছে, ঢেউয়ের ভাষা বুঝতে। উজাড় করে দিন নিজেকে গোধূলির মায়াবি টানে। উপভোগ করুন উত্তাপহীন বিচের কোমলতা আর বর্ণিল সন্ধ্যার কমনীয়তা। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ হেঁটে-বসে বা ভিজে-ভিজে।
এসবের চেয়েও আমার কাছে সমুদ্র দেখা, উপভোগ করা আর মনের মতো করে সমুদ্রকে পাওয়া মনে হয় বৃষ্টিতে, মেঘলা দুপুরে, ঝড় ওঠা বিকেলে, দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নেওয়া সন্ধ্যায়, আকাশ ভেঙে নামা বৃষ্টিতে অথবা অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা নিকষ কালো রাতে। সমুদ্রের এসব সময়ের রূপ আসলেই অপরূপ। রোমাঞ্চকর, গা ছমছমে আর ভয়ঙ্কর সুন্দরের অবিরাম আশীর্বাদ।
কালো হয়ে আসা মেঘের সঙ্গে হালকা বৃষ্টি আর একটু ঝড়ো হাওয়ায় সমুদ্রের যে উত্তাল রূপ, যা শিহরণ জাগায় সমস্ত সত্তায়, শেষ বিকেলের ঝড়ো হাওয়ায় ওর ভয়াল গর্জন মনে ভয় জাগাবে ঠিকই, কিন্তু আপনাকে আটকে রাখবে চুম্বকের মতো। ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাবেন, কিন্তু মন যেতে চাইবে না কিছুতেই ওকে ছেড়ে। ওর অদ্ভুত বীভৎস সুন্দর রূপ দেখে! আর আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা বৃষ্টি দেবে আপনাকে অন্য আনন্দ। হোটেলের বারান্দায় বসে-বসে, গা এলিয়ে দিয়ে, চেয়ে থাকা উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া সমুদ্রের দিকে, কান ফাটানো গর্জনের সঙ্গে দরাজ গলায় গেয়ে ওঠা খুব প্রিয় কোনো গান, নিজের অজান্তেই।
ডান হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ। বাম হাতে প্রিয়জনের নিশ্চিত আর নিখাদ ভালোবাসার হাত। সে হতে পারে ছেলেমেয়ে বন্ধু, প্রিয় কেউ বা প্রেয়সীর সঙ্গে কাটানো অপার্থিব মুহূর্ত, যা সারাজীবন আপনার মনের কোণে জ্বলজ্বল করবে সুখের শুকতারা হয়ে। শত দুঃখ-কষ্ট আর বেদনাতেও হবে না মলিন বা বিলীন এতটুকু!
তাই চলুন শীত বা অসহ্য গরমে নয়, এবার আমরা সমুদ্র উপভোগ করব ঢেকে যাওয়া কালো মেঘে, দমকা হাওয়ায়, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আর রাতভর ঝরতে থাকা অঝোর ধারায় সমুদ্রের অবিরাম গর্জনের কান ফাটানো সৈকতে।
আমার কাছে ঘন কালো মেঘ, রিমঝিম বৃষ্টি ঝরা আর মাতাল বাতাসের কক্সবাজার ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ প্রিয়। দয়া করে আমাদের সেরা পর্যটন সম্পদের কোথাও ময়লা ফেলবেন না।