ঈদে ঘোরাঘুরি
রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি
জমিদারবাড়ি শুনলেই আমাদের কল্পরাজ্যে ভেসে ওঠে মোটা গোঁফওয়ালা প্রতাপশালী কোনো এক জমিদার, তাঁর কুশলী স্ত্রী, রূপবতী মেয়ে, দাপুটে ছেলে, বিশাল এবং অলংকৃত জমিদারবাড়ি, সাজানো-গোছানো ফুলের বাগান ইত্যাদির ছবি। ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় আবার সেই বাদশাহী আমলে, যা এই একবিংশ শতাব্দীতে অসম্ভব। রাজা-বাদশাহদের স্মৃতিবিজড়িত অপূর্ব স্থাপত্য নিদর্শন আর সেই নিদর্শনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস দেখে এবং জেনে আমরা এখন শুধু অতীতকে কল্পনাই করতে পারি। তেমনই এক অপরূপ সৌন্দর্যের নিদর্শন রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি। চাইলেই ঈদের ছুটিতে সপরিবারে অথবা বন্ধুবান্ধবসহ ঘুরে আসতে পারেন এই ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ি থেকে।
রংপুর শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তাজহাটের ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে অবস্থিত এই জমিদারবাড়ি। বর্তমানে ১৫ একর জমির ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৭৬.২০ মিটার দীর্ঘ একটি সুবিশাল ভবন। ভবনটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে সাদা মার্বেল পাথর। বিভিন্ন নকশা ও কারুকাজখচিত ভবনটি নির্মাণ করেন রাজা গোবিন্দলালের ছেলে মহারাজ কুমার গোপাল লাল রায়। তিনি ছিলেন স্বর্ণকার। ধারণা করা হয়, তার আকর্ষণীয় ‘তাজ’ বা রত্নখচিত মুকুটের কারণে এলাকাটির নামকরণ করা হয় ‘তাজহাট’। ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতো ভূমি নকশায় তৈরি প্রাসাদটি। প্রাসাদটির পশ্চিম দিক উন্মুক্ত। এতে মোট ২২টি কক্ষ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে জমিদারবাড়িটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ৫৫ একর জমিসহ আগ্রিকালচার ইনস্টিটিউটকে দেওয়া হয়। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রাসাদটি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৯৫ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্থাপনাটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার এখানে রংপুর জাদুঘর স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০০৫ সাল থেকে এ প্রাসাদের অংশবিশেষ রংপুর জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে শত বছরের পুরোনো, ঐতিহ্যবাহী ও মূল্যবান অনেক নিদর্শন। এখানকার উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় আরবি শিলালিপি, বেলেপাথরের বাংলা শিলালিপি, সাঁওতালদের ব্যবহৃত তীর, বল্লম, পোড়ামাটির পাত্র, পোড়ামাটির ময়ূর, ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাওয়া পিতলের দুর্গা, শিবলিঙ্গ, পাথরের মূর্তি, উল্কাপিণ্ড, ঝাড়বাতি (ধাতব), কালোপাথরের সংস্কৃত শিলালিপি ইত্যাদি।
এ ছাড়া রয়েছে বেগম রোকেয়ার স্বহস্তে লেখা চিঠি, তুলট কাগজে সংস্কৃত হস্তলিপি, ফার্সি কবিতা ইত্যাদি। শুধু জাদুঘর নয়, পিকনিক স্পট হিসেবেও দর্শনার্থীদের অন্যতম পছন্দ তাজহাট জমিদারবাড়ি। এ ছাড়া প্রাসাদের সামনে আছে সুবিশাল শানবাঁধানো তিনটি পুকুর। ভবনের পাশে রয়েছে প্রজাপতি গাছের বাগান।
ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবহন হলো গ্রীন লাইন এবং টি আর ট্রাভেলস। এ ছাড়া এ রুটে আগমনী পরিবহন, এস আর, শ্যামলী, হানিফ, কেয়া ইত্যাদি পরিবহনের সাধারণ বাস চলাচল করে। ঢাকার কল্যাণপুর ও গাবতলী থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ছাড়ে এসব বাস। সড়কপথ ছাড়াও রেলপথে রংপুর যাওয়া-আসা সম্ভব। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য শহর থেকেও রংপুর যাওয়ার জন্য ভালো পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা রয়েছে। শহর থেকে খুব সহজেই রিকশা অথবা অটোতে করে যাওয়া যায় তাজহাট জমিদারবাড়িতে।
জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার। জনপ্রতি টিকিটের দাম ২০ টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যে টিকিটের প্রয়োজন পড়ে না। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশু-কিশোরদের জন্য প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ টাকা। সার্কভুক্ত বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য টিকিট মূল্য ১০০ টাকা এবং অন্যান্য বিদেশি দর্শকদের জন্য টিকিটের মূল্য ২০০ টাকা করে।
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা এবং শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। রোববার সাধারণ ছুটি ও সোমবার বেলা ২টা থেকে খোলা থাকে। এ ছাড়া সরকারি বিশেষ দিবসে জাদুঘর বন্ধ থাকে।
আর থাকার জন্য রংপুর শহরই উত্তম। এখানে অনেক ভালো মানের হোটেল রয়েছে। ভালো হোটেলের মধ্যে রয়েছে হোটেল শাহ আমানত (জাহাজ কোম্পানির মোড়), হোটেল গোল্ডেন টাওয়ার (জাহাজ কোম্পানির মোড়), হোটেল দি পার্ক (জাহাজ কোম্পানির মোড়), হোটেল তিলোত্তমা (থানা রোড), হোটেল বিজয় (জেল রোড), আরডিআরএস (জেল রোড)। এ ছাড়া আরো অনেক হোটেল রয়েছে রংপুরে, আপনি পছন্দমতো সেসবের একটিতে উঠতে পারেন। খরচ খুব বেশি নয়।
রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ। অপরূপ সৌন্দর্য এবং এর মাঝে জড়িয়ে থাকা ইতিহাসে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।