দেখে আসুন লোহালিয়া, লাউকাঠি এবং পায়রা নদী
একটি বিখ্যাত প্রবাদ আছে, ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল। সেই বরিশালের একটি জেলা হচ্ছে পটুয়াখালী। ‘সাগরকন্যা’ নামে আরো একটি সুন্দর নাম আছে জেলাটির। জনশ্রুতিতে জেলার নামকরণের ইতিহাসের সঙ্গেও নদী বা খালের সম্পর্ক ছিল। পটুয়াখালী শহরের দক্ষিণে এক গভীর অরণ্য ছিল। এর পাশ দিয়ে বহমান ছিল ছোট একটি নদী। যাকে বলা হতো পাত্তুয়ার খাল। জনশ্রুতি আছে, প্রায় চার হাজার বছর আগে এই খাল দিয়ে প্রায়ই পর্তুগিজ জলদস্যুরা এ এলাকায় হানা দিত। অনেকেই মনে করেন, এই পাত্তুয়ার খাল থেকে পত্তুয়াখালী-পট্রুয়াখালী-পৌট্রাখালী এবং এর পর পটুয়াখালী এসেছে।
পটুয়াখালী জেলা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তিনটি নদী লোহালিয়া, লাউকাঠি ও পায়রা নদী। জেলার পশ্চিমে রয়েছে পায়রা, উত্তরে লাউকাঠি ও পূর্বে লোহালিয়া নদী অবস্থিত। প্রশাসনিকভাবে বলা হয়, পটুয়াখালী লোহালিয়া নদীর তীরে অবস্থিত।
মূলত এই তিনটি নদীকে কেন্দ্র করেই এখানকার মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছে। মাছ আহরণ থেকে শুরু করে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নদীগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। শহরের বিখ্যাত ‘পুরান বাজার’ অবস্থিত এই লোহালিয়া নদীর তীরে। এ ছাড়া লাউকাঠি নদীর তীরে গড়ে উঠেছে নতুন বাজার এলাকা। প্রতিদিন শত শত মানুষ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের পণ্য নিয়ে আসে এই বাজারগুলোতে।
পায়রার ইলিশের খ্যাতি দেশজোড়া। এ ছাড়া কোড়াল, পাঙ্গাশ, কাঁচকি, ভাটা, চিংড়ি ইত্যাদি মাছসহ আরো বিপুল জলজ প্রাণীর আধার এই নদীগুলো। একসময়ে মিঠাপানির কুমির পায়রা নদীতে দেখা গেলেও তা আজ বিলুপ্ত।
প্রকৃতির একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে নদীগুলো। বর্ষায় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে পায়রা নদী। জেলার সবচেয়ে বড় ও খরস্রোতা নদী এটি। প্রবল ঢেউ আর স্রোতে মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে খেয়া পারাপার। তবে নামের মতই ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদল হয় নদীর রূপ। আমার দেখামতে বিকেলে সবচেয়ে সুন্দর রূপ ধারণ করে নদীটি। শহর থেকে ৫-৭ কিলোমিটার দূরে হওয়ায় ঈদ কিংবা ছুটির দিনগুলোতে মানুষজন বেড়াতে আসে পরিবারসহ। জেলা শহর থেকে ১০০ টাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় ৫-৭ জন নিয়ে আপনি আসতে পারেন এই নদীর তীরে। তবে ঈদের সময়ে ভাড়া একটু বেশি থাকে, তখন আপনার খরচ হবে ১৫০ টাকার মতো। তবে আগেই বলে নিচ্ছি, দরদাম করতে হবে চালকের সঙ্গে। একাকী আসতে চাইলে আছে অটোরিকশার ব্যবস্থা। সে ক্ষেত্রে লঞ্চঘাট থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আপনার খরচ হবে ১০ টাকা এবং সেখান থেকে পায়রাকুঞ্জ পর্যন্ত ১৫ টাকা। এ ছাড়া রিকশাতেও আসতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে ৮০ টাকার মতো খরচ হবে আপনার। নদীর পাড়ে এসে আপনার ভ্রমণপিয়াসী মন তৃপ্ত না হলে ট্রলারে চড়ে ঘুরতে পারেন নদীবক্ষে। তবে বর্ষা কিংবা জোয়ারের সময় খেয়াল রাখবেন। সাঁতার না জানলে এ সময় নদীতে না নামাই শ্রেয়। কারণ এই সময়ে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে পায়রা। স্বাভাবিক ছুটির দিনগুলোতে ট্রলার ভাড়া থাকে ২০০ টাকার মতো, তবে সেটা দরদাম করে ঠিক করতে হবে। আর ঈদে কমপক্ষে ৩৫০ টাকা ঘণ্টা। স্বল্প খরচে দ্রুত সময়ে ভ্রমণের জন্য দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে স্থানটি। নিচে বিকেলের আলোয় নয়নাভিরাম পায়রা নদী—
আকারে লোহালিয়া পায়রার থেকে ছোট, স্রোতও তুলনামূলক কম। শহরের ভেতরে অবস্থিত হওয়ায় প্রতিদিন বিকেলে শত শত মানুষের বিনোদনের স্থান হয়ে উঠেছে নদীটি। শহর রক্ষা বাঁধের ওপর দিয়ে আপনি চাইলে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে পারেন প্রিয় মানুষের সঙ্গে। শহর থেকে চাইলে শান্ত-নিবিড় গ্রামীণ পরিবেশে হারিয়ে যেতে পারেন এই বাঁধের পথটি ধরে। এর নদীবক্ষে ভ্রমণ পায়রার থেকে অনেক নিরাপদ, তবে সে ক্ষেত্রেও ট্রলারে গুনতে হবে ঘণ্টাপ্রতি ২০০ টাকার মতো। এ ক্ষেত্রে দরদাম করলে কিছু কমতে পারে। শেষ বিকেলের গোধূলি আলোয় অনাবিল রূপ ধারণ করে লোহালিয়া নদী।
লাউকাঠি নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ব্যবসায়ী স্থাপনা। তাই ভ্রমণের ক্ষেত্রে আপনি নৌকাকেই বেছে নিতে পারেন। ঢাকা-পটুয়াখালী রুটের লঞ্চঘাট এই নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে এলে আপনাকে এখানে এসেই নামতে হবে। প্রতিদিন তিনটি বিলাসবহুল নৌযান ঢাকা থেকে আসে এই ঘাটে।
বর্তমানে ঢাকা থেকে এমভি সুন্দরবন ৯, ১১; কুয়াকাটা ১, সাত্তার খান ১, জামাল ৫, কাজল ৭, সৈকত ১৪, দীপরাজ ২ নামক বিলাসবহুল লঞ্চ সার্ভিস চালু আছে। ঢাকা থেকে সন্ধ্যা ৭টায় ছেড়ে আসে লঞ্চগুলো।
ভাড়া ডেক : জনপ্রতি ২০০ টাকা, কেবিন সিঙ্গেল ১০০০, ডাবল ১৮০০। ফ্যামিলি ২০০০। পরিবারের ৭-৮ জন সদস্য হলে আসতে পারেন ভিআইপি কেবিনে, ভাড়া ৩০০০-৩৫০০ টাকা। সুন্দরবন-১১ লঞ্চটিতে সোফা সার্ভিস আছে, ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৫০০ টাকা। সন্ধ্যায় লঞ্চ ছাড়লে ভোর ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে আপনি পৌঁছে যাবেন পটুয়াখালী।
কেবিনে এলে আগে থেকে বুকিং দেওয়া ভালো।
এ ছাড়া গাবতলী, সায়েদাবাদ থেকে বাসেও আপনি আসতে পারেন এই শহরে। ভাড়া পড়বে নন-এসি ৫০০ টাকা আর এসি ৭০০ টাকা। সময় লাগে স্বাভাবিকভাবে কমপক্ষে ১০ ঘণ্টা। থাকার জন্য শহরে আছে হোটেল হিলটন, সাফারি কিংবা সাউথ কিংয়ের মতো হোটেল। সিঙ্গেল রুম ৮০০ টাকা, তবে দরদাম কমলে এর থেকে কমে পাবেন। ডাবল ১০০০ টাকা। খাবারের জন্য রয়েছে মল্লিকা, হিলটনের মতো চায়নিজ রেস্টুরেন্ট। এ ছাড়া সিরাজের হোটেলের মাংস ভুনা জেলা শহরের বিখ্যাত। শিঙ্গারা পয়েন্টের শিঙ্গারার স্বাদের জন্য কথা দিচ্ছি, আপনাকে আবারো আসতে হবে পটুয়াখালী শহরে।