লৌহমানবীর দেশে
প্রাক পর্ব : ঢাকা থেকে প্যারিস
প্রতিদিনের চাকরি, ঘর সংসার, লোক-লৌকিকতা আর বাচ্চার পেছনে টম অ্যান্ড জেরি করে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। কাক ডাকা ভোরে ওঠো, বাচ্চাকে রেডি করো, স্বামীর অফিস, নিজে কোনোদিন খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে কমলাপুর স্টেশনে দৌড়ে ট্রেন ধরো। তারপর চার ঘণ্টা জার্নি করে সেই ময়মনসিংহ গিয়ে চাকরি করো। ফেরার পথে বাসের ঝাঁকুনি, শোরগোল, ধুলোবালুময় জীবন। রাতে কোনোমতে বিছানায় মাথা রেখে আবার পরদিন একই রুটিন। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। কতদিন যে খোলা হাওয়ায় হাঁটা হয়নি। ঘরে বসে জানালায় চোখ রেখে বাইরের যে দুনিয়া আমরা দেখি, তার বাইরে আরো একটি বিশাল পৃথিবী রয়েছে। সেটা দেখার ইচ্ছা কার না হয়! আমিও ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতাম। মনের কোণে ভেসে বেড়ায় পাহাড়, ঝরনা, বন-বনানী বা খোলা প্রান্তর। কিন্তু যে মেয়ে জীবনে কক্সবাজার, কুয়াকাটা, জাফলং, ময়নামতি যায়নি তার স্বপ্ন আর কত বড়ই বা হতে পারে! ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপর/একটি শিশির বিন্দু।’
কবিগুরুর এই কথার সঙ্গে আমার দেখার কোনো মিল নেই। ধানের ডগায় শিশিরবিন্দু আমি অনেক দেখেছি। অপেক্ষা ছিল নীল সাগর আর পাহাড়-ঝরনার মিতালী দেখার। ভেবেছিলাম সামনের গ্রীষ্মের ছুটিতে যদি পারি একবার সমুদ্রের তীরে খালি পায়ে হেঁটে আসব, পাহাড়ে চড়ব, ঝরনা আর প্রকৃতির মাঝে কাটাব দুটি সন্ধ্যা। কিন্তু ঘরের বাইরে পা ফেলব বলে যে দেশের বাইরে পা ফেলব সে আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। সে সুযোগই ঘটে গেল কাকতালীয়ভাবে।
চাকরির সুবাদে আমার স্বামীকে পৃথিবীর অনেক দেশেই কাজে বা ট্রেনিংয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমার কখনো দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে সে জানাল ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে টেক্সওয়ার্ল্ড অ্যান্ড এ পার্যাল সোর্সিং ফেয়ারে তাকে প্যারিস যেতে হবে। প্যারিসের নাম শুনেই আমি লাফিয়ে উঠলাম। উফ! আইফেল টাওয়ার, মোনালিসা, শেইন নদী। সুনীলের সেই ছবির দেশ, কবিতার দেশ ফ্রান্স।
কেউ একজন বলেছিলেন, প্রত্যেক শিল্পীরই দুটি মাতৃভূমি থাকে-একটি যেখানে সে জন্মেছে, অন্যটি ফ্রান্স। আমি বলি, শিল্পীর দুটি মাতৃভূমি হতে পারে সত্য তবে যারা শিল্পী নয় তাদের জন্যও ভূ-ভাগের অমরাবতী এই প্যারিস। সুতরাং আমি আবেগতাড়িত হতেই পারি।
তাকে আবদার করে বললাম, এবার কিন্তু তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। সে বলল, ঠিক আছে নেব, তবে বিমান খরচ তোমাকে দিতে হবে। মনে মনে একটু দমে গেলাম। সে তো যাবে সরকারি খরচে, আমি এত টাকা কোথায় পাব? তবুও জানতে চাইলাম কত। সে যা বলল তাতে বুঝলাম যাওয়া অসম্ভব নয়। প্যারিসের ভিসা মানে সেনজেন ভিসা।
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডসহ এক ভিসায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তত ঊনত্রিশ দেশ ঘোরার সুযোগ। টাকা থাকলেও এই ভিসা সহজে পাওয়া যায় না। সুযোগটা হাতছাড়া কেন করি? আমি রাজি হয়ে গেলাম। এরপর শুরু হলো ভিসার জন্য তোড়জোড়। তোড়জোড় বলতে ফ্রান্স এম্বেসির ওয়েবসাইট থেকে ভিসার জন্য একটা আবেদন ফরম ডাউনলোড করে নির্দেশ মোতাবেক পূরণ করলাম। কিন্তু যেসব কাগজপত্র চেয়েছে, সেগুলো জোগাড় করতে কয়েকদিন লেগে গেল।
পাসপোর্টের ফটো কপি, ছবি (তাদের রিকমেন্ড করা স্টুডিও থেকে তোলা), ব্যাংক স্টেটমেন্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, সরকারি কর্মকর্তার সফরসঙ্গী হিসেবে তাঁর পরিবারের সদস্য এই মর্মে মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রদত্ত লেটার অব ইনট্রোডাকশন, আমার চাকরির অথরাইজেশন লেটার, স্টেশন লিভের অনুমতিপত্র, শেষ বেতন স্লিপ, ট্যুর আইটেনারি, হোটেল বুকিং। এগুলো কি কম হ্যাপা?
ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে আমরা ভিসার ফরম ও অন্যান্য কাগজপত্রের ফটোকপিসহ মূলকপি নিয়ে গুলশান ২ নম্বরে ফ্রান্স এম্বেসিতে গেলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার স্বামী, তাঁর আরেকজন সফরসঙ্গী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব মোরশেদা খানম এবং ইপিবির সহকারী পরিচালক রহিমা আক্তার। রিসিপশনে কাগজপত্র জমা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার স্বামী এবং মোরশেদা খানমের ডাক পড়ল। তাঁদের ফরম রেখে ৮ তারিখে ভিসা দেওয়ার কথা বলল। কিন্তু আমাকে বলা হলো যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে হবে। কারণ আমি সবুজ রঙের সাধারণ পাসপোর্টধারী। তাঁরা নীল রঙের সরকারি পাসপোর্টের মালিক। অর্থাৎ আপনি যদি সরকারি চাকরিজীবী হন এবং সরকারের কোনো কাজে বিদেশ যেতে চান, তাহলে কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার দরকার নেই সঙ্গে জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার) এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোট ভারবাল থাকলেই চলবে। কিন্তু আপনি যদি বেসরকারি লোক হন এবং পার্সোনাল কোনো কাজ বা ভ্রমণে যেতে চান তাহলে আপনাকে আগে থেকে অবশ্যই অনলাইনে আবেদন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেতে হবে। আবেদনের প্রেক্ষিতে ফ্রান্স এম্বেসি একটা তারিখ এবং সময় জানিয়ে আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেবে। ঠিক ঠিক সময়মতো হাজির হতে হবে। নির্ধারিত সময়ের পর ১০ মিনিট পর্যন্ত তাঁরা স্যাক্রিফাইস করে। এরপর যানজটের দোহাই, ঝড়বৃষ্টি যাই বলেন কোনোভাবেই তাদের মন টলাতে পারবেন না। আমি এর একজন ভুক্তভোগী। আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ৪ তারিখ সকাল ১০টায়।
আমি ইস্কাটন গার্ডেন থেকে বের হলাম সকাল ৮টায়। বড়জোর আধা ঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু বিধি বাম, প্রচণ্ড যানজটে আটকে পড়লাম। আমি যখন তাদের ইনফর্ম করলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় ১০টা বেজে ১১ মিনিট। ফলাফল এই হলো যে মাত্র এক মিনিটের জন্য আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট তারা বাতিল করল। আমাকে পুনরায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে বলা হলো। এবার বুঝে গেলাম প্যারিস যাওয়া আমার ভাগ্যে নেই। মোটামুটি হাল ছেড়ে দিলাম। ১২ তারিখে আমার স্বামীকে যেতেই হবে। আমাকে যদি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে দেরি করে, তাহলে ভিসার ডেট পিছিয়ে যাবে। তারা ভিসা দিতে কমপক্ষে সাতটি কর্মদিবস সময় নেয়। পরে যদি তারা ভিসা দেয়ও, সে ভিসায় আমার কোনো লাভ নেই। আমার প্যারিস যাওয়ার কাজে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিলেন এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর সহকারী পরিচালক রহিমা আপা। আমার হয়ে তিনি যাবতীয় ফর্মালিটি পূরণ করেন। তাঁর মন আমার থেকেও বেশি খারাপ হলো। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। এবার তিনিই আবার ফোনে ফোনে দৌড়ঝাঁপ করলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় শেষপর্যন্ত পরদিন সকাল সাড়ে ৮টায় পুনরায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। এরপর আর ভুল হয়নি। সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা আগে সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। একেই বলে বাঙালি দেখে নয়, ঠেকে শেখে।
৪ তারিখ ঠিক সাড়ে ৮টায় এম্বেসি আমাকে ডেকে নিল। আমার সব কাগজপত্রসহ ভিসা ফি পাঁচ হাজার টাকা জমা দিলাম। এমনিতে আমি ইংরেজিতে জাহাজ, তার ওপর ফরাসি যে লোকটি ডেস্কে ছিলেন, তাঁর ইংরেজি উচ্চারণ এত জটিল যে বুঝতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। যাই হোক। এম্বেসি ভিসা প্রদানের ডেট দিল ১১ তারিখ বিকেল ৪টায়। এখন বুঝুন, আমার ফ্লাইট কনফার্ম করা ১২ তারিখ সকাল ৭টা। ভিসা দেবে আগেরদিন বিকেল ৪টায়। এই অনিশ্চয়তায় মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। এ সময় প্যারিসের গড় তাপমাত্রা ছিল চার ডিগ্রি সেলসিয়াস, সুতরাং শীতের কাপড় কেনাকাটা করতে হবে। লাগেজ রেডি করার বিষয় রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে লাগেজ রেডি করলাম অথচ ভিসা পেলাম না তখন মনের অবস্থা কী হবে? অন্যদিকে যদি লাগেজ রেডি না করি, ভিসা পেলে একবেলায় সেটা সম্ভব হবে না। নানা চিন্তা করে লাগেজ মোটামুটি রেডি করেই রাখলাম।
১১ তারিখে আমি আর এম্বেসিতে গেলাম না। আমার অথরাইজেশন লেটার নিয়ে আমার স্বামী গিয়েছিলেন। মনে মনে একটু ভাবনা ছিল ভিসা পাব কি পাব না। জীবনে প্রথমবার দেশের বাইরে যাব, তাতে যদি ব্যর্থ হই তাহলে বড়ই আফসোসের বিষয় হবে। কিন্তু না ফ্রান্স এম্বেসি আমাকে নিরাশ করেনি। বিকেল ঠিক ৪টা ৫ মিনিটে আমার স্বামী ফোন করে জানাল যে আমরা পরদিন সকালে প্যারিস যাচ্ছি। ফোন পাওয়ার পরেই ছুটলাম নিউমার্কেটে। এ দেশে কখনো হাতমোজা, ওভারকোট পরিনি কিন্তু ফ্রান্সের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ফিরোজ ভাই বলে দিয়েছিলেন সেখানে প্রচণ্ড শীত। সোয়েটার, টুপি, ওভারকোট ছাড়া প্যারিস শহরে বের হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। ভারী প্যান্ট এবং ইনারও নিয়ে যেতে হবে। এও এক মুশকিল! ১০-১২ দিনের জন্য যাব আর এত খরচ করে এসব কিনলে তো পরে পড়েই থাকবে। আমার ভাতিজি সাফার স্টকে প্রচুর কাপড়চোপড় থাকে। ওর কাছ থেকে তিনটা ওভারকোট-সোয়েটার নিয়ে নিলাম। বাকি হাতমোজা, কানটুপি এসব কিনতেই নিউমার্কেটে। শীত শেষ। বেশির ভাগ দোকান থেকে শীতের কাপড় সরিয়ে ফেলেছে। অনেক খুঁজে যা পেলাম, সেটাই আকাশছোঁয়া দামে কিনে ঘরে ফিরে এলাম।
সে দেশে গিয়ে কী কী লাগতে পারে তার একটা লিস্ট করে নিয়েছিলাম। প্রয়োজনীয় কাপড় ছাড়া দরকারি ওষুধপত্র, কিছু শুকনা খাবার ইত্যাদি। লাগেজ মোটামুটি আগেই রেডি করা ছিল। ঘরে এসে বাকিটুকু সেরে ঘুমুতে রাত ২টা।
যাই হোক, সকাল ৭টায় আমাদের প্লেনের সময়। ভোর সাড়ে ৪টায় ঘর থেকে এয়ারপোর্টের দিকে গাড়ি ছুটল। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। হালকা শীতের আমেজের মধ্যে খুব দ্রুত আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। ভিআইপি লাউঞ্জে একদম ভিড় নেই। ফুলের তোড়া নিয়ে চার-পাঁচজন ভদ্রলোক অপেক্ষা করছেন। তাঁদের আলাপে বুঝলাম সম্ভবত বিদেশ থেকে কোনো মন্ত্রী দেশে ফিরছেন। মনে মনে হাসি এলো, আহা বেচারারা!
ইমিগ্রেশনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন প্লেনে এসে বসলাম, তখনো প্লেন ছাড়তে ২০ মিনিট বাকি। টার্কিশ এয়ারওয়েজের মাঝারি সাইজের প্লেন। অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে তুলনামূলকভাবে ভাড়া কম বলে এই এয়ারওয়েজে আসা। রিটার্ন টিকেটসহ আমার ভাড়া লেগেছিল বাংলাদেশি টাকায় ৬৫ হাজার টাকা। আসলে ভ্রমণের নির্ধারিত তারিখের যত আগে বুকিং করা যায় ভাড়ার পরিমাণ তত কমে আসে। কাছাকাছি ডেটে ভাড়া একটু বেশি।
ইকোনমি ক্লাসের মাঝের দিকে আমার সিট। ভাড়া হিসেবে ব্যবস্থা খারাপ মনে হলো না। যাত্রীদের কিছু বাংলাদেশি কিছু বিদেশি। প্লেন প্রথমে ইস্তাম্বুল যাবে। হিসাব মতে, ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টে নামতে প্রায় নয় ঘণ্টা লেগে যাবে। সেখানে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট। তারপর এই এয়ারওয়েজের অন্য একটি বিমানে প্যারিস। বিমানবালা মোবাইল বন্ধ করার ঘোষণা দিচ্ছেন, সিটবেল্ট আগেই পরে ফেলেছি। ধীরে ধীরে প্লেন তার বিশাল দুই ডানা মেলে আকাশে উড়তে শুরু করেছে। ক্রমে আমার প্রিয় ঢাকা শহরের ঘরবাড়ি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র হয়ে আসছে। অকস্মাৎ ছোট্ট ছেলেটির জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল। নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে, সন্তানকে রেখে এ কোন অজানায় উড়ে চলেছি!
বেশিক্ষণ ভাবার ফুরসৎ পেলাম না। জানালার পাশ দিয়ে সাদা মেঘগুলো পেজা তুলোর মতো উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে বললে ভুল হবে, আসলে আমরাই ওদের গায়ে মেখে উড়ছিলাম। সকালের সোনারোদে চিকচিক করছে ওদের নরম আকার। আমার পাশে মোরশেদা আপা স্ক্রিনে কিছু দেখার জন্য রিমোট কন্ট্রোল নিয়ে বহুক্ষণ ধরে কসরত করছিল। কারণ সেটা কাজ করছে না। আসলে উনি নিজের ভেবে আমার সিটের রিমোট নিয়েছিলেন। অত ভোরে খেয়ে আসিনি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। প্লেন কর্তৃপক্ষ কখন নাশতা দেবে বুঝতে পারছি না। হাতব্যাগে দু-চার প্যাকেট বিস্কুট কেন নিলাম না তা ভেবে নিজেকে বোকা লাগছিল। প্লেনের খাবার গলধঃকরণ করতে পারব কি পারব না সেটা ভাবতে ভাবতে খাবারের ট্রলি চলে এলো। পাস্তা, দই-জাতীয় এক ধরনের ডেজার্ট, একখণ্ড কেক, ব্রেড। সঙ্গে আপেল জুস নিলাম এবং কোক।
ইস্তাম্বুলের মাটি স্পর্শ করার আগে আমাদের প্লেন নয় ঘণ্টা আকাশে থাকবে। ভাবছিলাম সময় কাটাব কীভাবে। সঙ্গে দুটি বই নিয়েছি পড়ার জন্য। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। অনেক দিন ধৈর্য ধরে মুভি দেখা হয় না। ঠিক করলাম এই নয় ঘণ্টায় তিনটি মুভি দেখলে মন্দ হয় না। বেশির ভাগই টার্কিশ অথবা ইংলিশ মুভি। কয়েকটা হিন্দিও রয়েছে। আমি বোম্বে সিনেমা পিকু দিয়ে শুরু করলাম। ফাঁকে ফাঁকে প্লেনের গতিপথ দেখছি। সহযাত্রীদের কেউ গভীর ঘুমে কেউ বা স্ক্রিনে চোখ লাগিয়ে।
বিকেল ৪টা নাগাদ প্লেন মনে হলো কিছুটা নিচু দিয়ে উড়ছে। দূরে নীল সাগর। সে আরো নিচে নামল। ১৫ হাজার মিটার উচ্চতায়। কিছুক্ষণ পরে নিচের ছোট ছোট বাড়ি দেখা যেতে লাগল। ঝকঝকে রোদে দূরে পাহাড়ের মধ্যে ছবির মতো সাজানো রাস্তাঘাট। পেছনে ভূমধ্যসাগরের নীল রঙের অথৈ পানি। কি যে সুন্দর সে দৃশ্য। প্লেন আরেকটু নিচে নামলে দেখলাম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বহুতল ভবন। সবগুলোই দেখতে প্রায় একই রকম। মাথায় সিরামিকের ঢালু ছাদ। এর কিছু বাদে ঘোষণা এলো আমরা ইস্তাম্বুল পৌঁছে গিয়েছি।
ঢাকা এয়ারপোর্টে বোর্ডিং ব্রিজের সুবিধা থাকলেও এখানে সেটি ছিল না। ফলে আমাদের ল্যান্ডিং এরিয়াতেই নামতে হলো। তাতে ভালোই হলো। বাসে দাঁড়িয়ে টার্মিনালে যেতে যেতে বিস্তৃত ইস্তাম্বুল এয়ারপোর্টের কিছু অংশ দেখার সুযোগ পেলাম। চারপাশ ঝকঝকে তকতকে। ইচ্ছে ছিল ঘুরেফিরে একটু দেখব ইউরোপের রুগণ ব্যক্তি খ্যাত তুরস্কের আধুনিক রূপকে। কিন্তু হলো না। আগের প্লেন লেটে ল্যান্ড করাতে আমাদের হাতে আর বেশি সময় ছিল না। অনেকগুলো লেনের মধ্যে আমাদের লেন খুঁজতে কিছুটা সময় চলে গেল। তারপর বোর্ডিং পাসের হ্যাপা। আবারও বাস। দৌড়ে গিয়ে আমরা বাসে উঠলাম। বাস নিয়ে গেল সেই প্লেনে যেটি আমাদের সরাসরি নামিয়ে দেবে প্যারিসে।
এই প্লেনটি আগের মতো অতটা বড় নয়। অনেক সিট ফাঁকা। আমরা ছাড়া এশিয়ার কোনো যাত্রী রয়েছে বলে মনে হলো না। পাশের সিটে একজন ফ্রেঞ্চ মেয়ে। আমার থেকে অন্তত একহাত বেশি লম্বা। বয়স বুঝতে পারছি না। বসার কিছুক্ষণ বাদে সে বিশাল এক বক্স বের করে কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে শুরু করল। খাবারের দিকে তাকিয়ে মনে হলো রাজ্যের ঘাস-লতাপাতা দিয়ে বানানো ব্যঞ্জন। আমি আড়চোখে কাঁচা কলা, আর আলু ছাড়া কোনো সবজি চিনতে পারলাম না। মেয়েটি খাওয়া শেষে ল্যাপটপ খুলে দ্রুতগতিতে ইংরেজিতে টাইপ করছে। ‘প্যান’ সিনেমা দেখার ফাঁকে তার লেখা কিছুটা পড়ে বুঝতে পারলাম জারা এবং সারা নামের দুই মেয়ের হোস্টেল জীবনকে ঘিরে সে গল্প লিখছে। আমি তার কাছে জানতে চাইলাম সে লেখক কি না। জবাবে বলল- অল্প লেখে, তবে তার মূল কাজ নাটক-সিনেমার স্ক্রিপ্ট লেখা। সে আমাকে দেখে ভারতীয় বলে ভুল করল। আমি তার ভুল ভেঙে বাংলাদেশের খানিকটা ইতিহাস শোনালাম। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রেক্ষাপট বললাম। আফসোস সে এসবের কিছুই জানে না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। আমার কাছে শুনে সে বেশ আগ্রহ বোধ করল। র্যাচেল নামের সেই অচেনা মেয়েটির সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের প্লেন প্যারিসের ‘শার্ল দ্য গল’ এয়ারপোর্টের মাটি স্পর্শ করল। আমি একটু রোমাঞ্চিত হলাম। মনে পড়ল এই সেই দেশ যেখানে দেড়শ বছর আগে এসেছিলেন আমার জন্মভূমি সাগরদাঁড়ির জমিদারপুত্র মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। সম্ভবত তাঁর গাঁয়ের প্রথম মেয়ে আমি যে কিনা প্যারিসের মাটিতে সেই মুহূর্তে অবতরণ করলাম।
ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ কিউ। কিন্তু আমাদের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। বাংলাদেশ অ্যামবাসির প্রোটোকল অফিসার আমাদের অপেক্ষায় রয়েছেন। বেটে, খাটো চেহারার ভদ্রলোক অত্যন্ত চটপটে। তিনি আমাদের তিনজনের পাসপোর্ট নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা যা ছিল দ্রুত সেরে ফেললেন। শুধু আঙুলের ছাপ দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো কাজ ছিল না।
বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন ফ্রান্স এম্বেসির কমার্শিয়াল কাউন্সিলর ফিরোজ ভাই। অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। বলা যায় তাঁর আন্তরিকতায় প্যারিসের পুরো সময়টা আমরা একটা উৎসবের মধ্যে কাটিয়ে এসেছি। কখনো তিনি গাইড, কখনো গাড়ির চালক হয়ে আমাদের রাতের প্যারিস দেখিয়েছেন। সে আলাপে পরে আসছি। ফিরোজ ভাইয়ের গাড়িতে বসে যখন আমরা শহরে যাওয়ার রাস্তায় বেরিয়ে এলাম, তখন হালকা কুয়াশায় মোড়া রাত।
গন্তব্য ফিরোজ ভাইয়ের বাসা। যদিও আমরা গাখ-দু-নোখ (Gare du Nord) এলাকায় হোটেল বুকিং দিয়েছিলাম, কিন্তু ফিরোজ ভাইয়ের জোরাজুরিতে সেটি ক্যানসেল করে তাঁর বাসায় থাকব স্থির হয়েছিল। এখানে একটা কথা বলে রাখি। বাঙালিদের জন্য সুবিধা হয় যদি গাখ-দু-নোখ (Gare du Nord) এবং এর আশপাশের এলাকায় হোটেল পাওয়া যায়। কারণ এই জায়গাটায় বাঙালি এবং বাঙালি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রচুর।
প্যারিস অত্যন্ত ব্যয়বহুল শহর। ১২০০ ইউরোর নিচে কোনো রুম পাওয়া যায় না। তাই কেউ কেউ হোটেলের পরিবর্তে হোস্টেল বেছে নেন। হোস্টেলে অন্যের সঙ্গে রুম শেয়ার করতে হয়। রুমমেট পুরুষ নারী যে কেউ হতে পারে। সর্বনিম্ন রেট ১৫ ইউরো। বিভিন্ন সাইট থেকে সস্তায় হোটেল বুকিং দেওয়া যায়। ফ্লাইট কিংবা হোটেল যা-ই বুকিং দেন রাতে দেওয়া ভালো। কারণ অনেক কোম্পানি রাতেই তাদের রেট পরিবর্তন করে থাকে।
যাই হোক, প্যারিসের মসৃণ রাস্তায় চলতে চলতে ভাবছিলাম মানুষের জীবন কি অদ্ভুত! সকালে ছিলাম এখান থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে আমার দেশে। সন্ধ্যায় এলাম শেইন নদীর শহরে।
ফরাবি কবি আলফস দ্য লামারতিনের কবিতার কথা মনে হলো- ‘মানুষের কোনো বন্দর নেই/ সময়ের কোনো তটরেখা নেই/ শুধু বয়ে চলে, আমরাও পার হয়ে যাই।’
আমরাও একের পর এক রাস্তা পার হতে থাকি। কোথাও পাতাঝরা অচেনা গাছের সারি, কোথাও নান্দনিক সব ভাস্কর্য। আলো ঝলমলে প্রতিটি বিল্ডিংয়ের গায়ে নানা ধরনের শিল্পকর্মের ছোঁয়া। যেতে যেতে ফিরোজ ভাই প্যারিসের বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। একটি স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, এটি ‘স্টাডে ডি ফ্রান্স’। গত বছর নভেম্বরে এই স্টেডিয়ামের বাইরে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল। কিছুদূর যেতে একটি উজ্জ্বল গম্বুজে আমার চোখ আটকে গেল। রাতের আলোকিত প্যারিসের মধ্যে এটিকে মনে হচ্ছিল গম্বুজাকৃতির সুবিশাল আলোকপিণ্ড। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম। দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার স্বামী বলল, এটি ‘লা ইনভালিডস’। ১৬৭৯ সালে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং আহত সৈনিকদের হাসপাতাল হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এখানেই স্থান পায় নেপোলিয়ান বোনাপোর্ট-এর সমাধি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে সে আগেও প্যারিস ঘুরে গিয়েছে। যতক্ষণ গাড়ি থেকে দেখা গেল, আমি মুগ্ধ হয়ে সেদিকে চেয়েছিলাম।
বিষয়টা ফিরোজ ভাই হয়তো খেয়াল করেছিলেন। হেসে বললেন, ভাবী সামনে দেখেন। চোখ ফেরাতে পারবেন না। আমি দেখলাম, সত্যি আমি তাকে দেখলাম...প্যারিস শহর থেকে, যে রাস্তাটিতে আমরা ছিলাম সেখান থেকে অনেক উঁচুতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে। নানা রঙের হাজার বাতি শরীরজুড়ে সহস্র তারা হয়ে ঝিকমিক করছে। নীল রঙের সার্চলাইট শহর প্রদক্ষিণ করছে অবিরাম। মনে হলো আমাদেরও তার শহরে স্বাগত জানাল। দূর থেকে প্রথম দর্শনে আমি সেই লৌহমানবীর প্রেমে বুঁদ হয়ে রইলাম আর অপেক্ষায় থাকলাম কখন তাঁকে স্পর্শ করব।