কাশ্মীর
টিউলিপের বাগানে একদিন
একটা বাগানে প্রায় দুই মিলিয়ন টিউলিপ ফুটেছে। টকটকে লাল টিউলিপ যেন রক্ত ঝরা। নির্মল সাদা, গাড়ো বাদামি-খয়েরি, ঘন কালো, হালকা গোলাপি, উজ্জ্বল হলুদ, মিশ্র বর্ণের হরেক রকমের টিউলিপ ফুটেছে। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচুতে ফুটন্ত টিউলিপের দল দোল খাচ্ছে মৃদু বাতাসের সঙ্গে। ১২ হেক্টর জমিতে প্রায় ৬০ প্রজাতির টিউলিপের বাগানটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম। জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরের ওই টিউলিপ গার্ডেনে কাটিয়ে এলাম গেল শুক্রবার। দীর্ঘ শীতের ধূসরতা কাটিয়ে কেবলই বসন্ত এল কাশ্মীরে। ন্যাড়া গাছগুলোতে গজাতে শুরু করেছে সবুজ পাতা, লাল-নীল-সাদা বাহারি ফুল। হাড় কাঁপানো, তুষার পড়া শীতের তীব্রতা কমে দিনের বেলায় তাপমাত্রা এখন গড়ে ১৬-১৭ ডিগ্রি। যেন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গোটা প্রকৃতি।
এপ্রিল-মে মাসের এই সময়টিই ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য শ্রেষ্ঠ সময় কাশ্মীর ঘুরে দেখার। এ সময়ই শ্রীনগরের দর্শনীয় স্থানগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে পর্যটকদের পদচারণায়। শহরের অদূরেই মধ্য হিমালয়ের জবরবান পর্বতমালার পাদদেশে আছে ডাল লেক। তার আশপাশেই রয়েছে অন্তত ১০টি জায়গা দেখার মতো। সতের শতকে মুঘল বাদশাহরা তাঁদের গ্রীষ্মকালীন বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে সাজিয়েছিলেন মোগল গার্ডেন, শালিমার গার্ডেন, নিশাত গার্ডেন, পরিমহলসহ এসব স্থান। বাদশাহ জাহাঙ্গীরই কাশ্মীরের নাম দিয়েছিলেন ভূ-স্বর্গ। এখানে প্রায় প্রতিটি পর্বতের চূড়ায়ই রয়েছে একেকটি দর্শনীয় স্থান। সেখানেই নতুন সংযোজন ইন্ধিরা গান্ধী স্মৃতি টিউলিপ গার্ডেন।
পর্যটকদের নতুন আকর্ষণ হিসেবে ২০০৭ সালে গড়ে তোলা হয় এটি। এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ফুটতে থাকে টিউলিপরা। দর্শনার্থীদের জন্য তখনই উন্মুক্ত করা হয় বাগান। প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রতিজন দর্শকের জন্য ৫০ রূপি আর শিশু-কিশোরদের জন্য ২০ রূপি করে টিকিট সংগ্রহ করতে হয় প্রবেশ দ্বার থেকে। দ্বিপ্রহর গড়ানোর আগেই আমরা তিনজন ঢুকলাম বাগানে। ফটক পেরিয়ে সামনে এগোতেই থমকে দাঁড়াতে হলো। রঙিন-বর্ণিল টিউলিপের মাদুরে দৃষ্টি দিয়ে আমরা যেন বিমুগ্ধ! এক-দেড় ফুট দীর্ঘ টিউলিপের একেকটি গাছ। কয়েকটি সবুজ পাতা। আর তার মাথায় জ্বলজ্বল করছে একটা ফুটন্ত টিউলিপ। এমন একেক রঙের হাজার-হাজার টিউলিপ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রূপ ছড়াচ্ছে। কাছে টানছে দর্শনার্থীদের। কিন্তু সেখানে শক্ত নির্দেশনা রয়েছে- টিউলিপ ছেঁড়া নিষিদ্ধ।
বাগানের শেষ মাথায় দৃষ্টি দিয়েই দেখা গেল, যেখানে টিউলিপের সারি শেষ, সেখান থেকে আকাশের দিকে উঠে গেছে বিশাল পর্বতের কালো দেয়াল। তার গায়ে ঘন ঝাউগাছের জঙ্গল। আরো উপরে তাকিয়ে দেখলাম, পর্বতের গায়ে ঝাউগাছ নেই। রোদে ঝকমক করছে ধূসর পাথুরে দেয়াল। গোটা বাগানটি অনেক মাঝারি প্লটে ভাগ করা। প্রতিটি প্লটের চারপাশে নাইলনের দড়ি টানিয়ে দেওয়া আছে সীমানা। মাঝখানে হাটার জন্য কংক্রিটের রাস্তা। প্রবেশ পথ থেকে পর্বতের কোলের দিকে কিছুদূর এগোতেই সিঁড়ির মতো ভাঁজ। সেটা টপকে উপরে উঠতেই দেখলাম আরেক সারি টিউলিপ। মনে হলো যেন আরো ঘন, আরো উজ্জ্বল, জমকালো। মাঝে মাঝে বসানো রয়েছে বেঞ্চ। দ-একটা পাহাড়ি মাঝারি ঝাউগাছের রোদ-ছায়া। এর মধ্যে পাহাড়ি ঝরনার পানি বেরিয়ে আসছে একটি ফোয়ারা থেকে।
একটা খাবারের দোকান আছে চা-কফি, ফাস্ট ফুড পাওয়া যায়। সেখানে কাশ্মীরি নুন চায় (লবণ চা) অথবা কেহওয়া পান করে চাঙ্গা হয়ে নিতে পারেন অনেকে। অনেকে টিউলিপের সামনে ছবি তোলেন নিজেদের ক্যামেরায়। কাশ্মীরি নকশাদার ফেরেন (ঢোলা-লম্বা কোর্তা) আর পাগড়ি মেলে ভাড়ায়। প্রায় সব পর্যটন কেন্দ্রেই কাশ্মীরি সংস্কৃতির এই উপকরণগুলো পাওয়া যায়। বেড়াতে আসা লোকেরা সেসব গায়ে পরেন। ফটোগ্রাফি করে রাখেন স্মৃতি হিসেবে। বাগানের শেষ ধাপে উঠে দেখলাম, মৌসুমের শুরুর দিকে ফোটা ফুলগুলো কিছুটা নিস্তেজ হয়ে আসছে। সেখানে ফুলের ঘনত্ব কিছুটা কমও মনে হলো। চারপাশের নাইলনের দড়িও ছিল না। দর্শনার্থীদের ফুল ধরা এবং বাগানের মধ্যে ঢোকার সুযোগ মিলবে ওখানে। তবে, কোনো ফুল ছেঁড়ার সুযোগ নেই। ফুল ছিঁড়তে হলে আপনাকে গুনতে হবে ৫০০ রূপি জরিমানা। অপূর্ব সৌন্দর্যের পাশাপাশি তাদের পরিচ্ছন্নতা, শৃঙ্খলা আর লাভজনক ব্যবস্থাপনা মুগ্ধ হওয়ার মতো।