ঘুরে আসুন লাউয়াছড়া
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের কথা সর্বজনবিদিত। ভৌগোলিক ভাবে আমাদের দেশটি ইন্দোবার্মা হট স্পটের অন্তর্গত, অর্থাৎ জীব বৈচিত্র্যের এক দারুণ সমাহার হবার জন্য আমাদের দেশটি আদর্শ। তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আর পরিবেশ দূষণের কারণে আমাদের সেই সম্পদের বেশিরভাগটাই আমরা খুইয়েছি, তারপর ও কিছু অঞ্চল আছে যা এখনো আমাদের সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদের নিদর্শণ বহন করে।সিলেটের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এমন একটি জায়গা। এটি প্রকৃতিপ্রেমী আর ভ্রমণ পিয়াসীদের জন্য আদর্শ এক স্থান বলা চলে। খুব কম খরচে, প্রায় বিনা পরিশ্রমে আপনি এখান থেকে নিতে পারবেন প্রকৃতির অপূর্ব সান্নিধ্য। বাংলাদেশের সুন্দরবন ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে যেসব সামান্য কিছু টুকরা টাকরা বনাঞ্চল অবশিষ্ট আছে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান তার মধ্যে অন্যতম, এটি সবথেকে ভালভাবে সংরক্ষিতও বটে।
লাউয়াছড়া উদ্যানটি বহু পূর্বে আসামের কাছাড়ের জঙ্গলের সাথে সংযুক্ত ছিল। তখন আমাদের দেশের পূর্বাঞ্চল আর ভারতের আসামের কাছাড় জেলা সংলগ্ন এক বিরাট অবিচ্ছিন্ন জঙ্গলের অংশ ছিল এটি। বহু বছরের বন বিনাশ ও অযত্নের ফলে আজ একটি বিচ্ছিন্ন জঙ্গল হিসেবে এটি টিকে আছে। ১৯৯৬ এ একে সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে হয়। জঙ্গলে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে আকাশ ছোয়া সব গাছের সারি, রাস্তার দুপাশে সারি সারি টিলা অথবা খাদ। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এই এলাকায়, ফলে ভীষণ ঘন ঝোপঝাড় ভেদ করে দৃষ্টি বেশিদূর যাবে না, তবে শুনতে পারবেন অসংখ্য পাখির ডাক, মাঝে মাঝে দেখা পাবেন নানা প্রজাতির বানর, ভাগ্য ভাল থাকলে পেয়ে যেতে পারেন বিপন্ন প্রায় উল্লুকের দেখাও। গাছের ফাক দিয়ে চোখে পড়বে বৃষ্টির পানি প্রবাহী নালা, বা স্থানীয় ভাষায় ছড়া। বালি ঢাকা এই ছড়াগুলো বৃষ্টির সময় পানি প্রবাহী হয়, বাকী সময়ে প্রায় শুকিয়ে থাকে।
জঙ্গলের ভিতরে ঢোকার যে প্রবেশপথ, সেখানে পাবেন টিকেট কাউন্টার, টিকেট কেটে প্রবেশ করতে হবে, মূল্য জনপ্রতি ২৫ টাকা, চাইলে এখান থেকে গাইড ও নিতে পারেন, সময় হিসেবে গাইডের পারিশ্রমিক দিতে হবে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা। টিকেট কাউন্টারের পাশ দিয়ে কিছুটা হেটে গেলেই পাবেন বীট অফিস, চা এর দোকান(এখানে বিখ্যাত সাত রঙ্গা চা পাওয়া যায়, গ্লাস প্রতি মূল্য ৭০ টাকা, এছাড়াও পাবেন হাল্কা খাবার), পুলিশ ফাড়ি। আর দেখা পাবেন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথের। ৫০ এর দশকে ‘এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন ৮০ ডেইস’ সিনেমার শুটিং এর কিছু অংশ এখানে হয়েছিল।
রেলপথ পার করে কিছু দূর হাটলে বনের গভীরে যাবার বেশ কিছু ট্রেইলের দেখা পাবেন। এগুলোর যেকোন একটা ধরে হাটা শুরু করুন, কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রবেশ করবেন এক অন্য আদিম জগতে, পাখপাখালির ডাক আর জঙ্গলের নানা শব্দে রোমাঞ্চিত হবেন, দেখা পেতে পারেন জঙ্গলের ভেতরে বসবাস কারী আদিবাসী খাসিয়া, টিপরা অথবা মনিপুরীদের। আরো দেখা পাবেন জঙ্গলের বিচিত্র সব পাখপাখালি আর পশু, যাদের মধ্যে হরেক রকমের বানর অন্যতম।
জীব বৈচিত্র্য
মাত্র ২৭৪০ হেক্টরের আয়তন হলেও জঙ্গলটির জীববৈচিত্র্য বিস্ময়কর রকমের সমৃদ্ধ। এখানে প্রায় ১৫৯ রকমের গাছগাছড়া পাওয়া যায়, পাওয়া যায় ধনেশ, বন মোরগ, হরিয়াল সহ প্রায় ১২০ রকমের পাখি। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে আছে লজ্জাবতী বানর, আসামী বানর, শূকর লেজী বানর সহ ৬ প্রজাতির বানর, কমলা পেট কাঠবেড়ালী, খাটাশ, বন বেড়াল, সোনালী শেয়াল,শূকর, মায়া হরিণ, নানা রকম সরিসৃপ ও সাপ। তবে এখানকার সেরা আকর্ষন হতে পারে উল্লুক, মাত্র ৭০ টির মত আছে এই জঙ্গলে এরা, এবং উপমহাদেশে উল্লুকের সব থেকে বড় জনসংখ্যা এটি। বিপন্ন এই প্রাণিটির দেখা পাওয়া অবশ্য ভাগ্যের ব্যাপার। পূর্বে এই জঙ্গলে বাঘ, চিতাবাঘ, শম্বর হরিণ প্রভৃতি দেখা যেত, ৭০ এর দশকের শুরুতেই এরা সংরক্ষণের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
কিভাবে যাবেন
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৬০ কিলোমিটার, সিলেট শহর থেকে দূরত্ব হবে প্রায় ৬০ কিলোমিটার।
তবে যেতে হলে সবথেকে ভাল মাধ্যম হতে পারে ট্রেন। কমলাপুর স্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেনে উঠে নামবেন শ্রীমঙ্গলে, সময় লাগবে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটারের দূরত্বে এই উদ্যান। সিএনজি অথবা রিকশাতে করে খুব কম সময়ে পৌঁছে যেতে পারবেন।
আর বাসে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে মৌলভীবাজারগামী যেকোন বাসে উঠে পড়লেই হবে, মৌলভীবাজার শহর থেকেও যেতে পারবেন উদ্যানে সি এন জি অথবা লোকাল বাসে চড়ে।
কোথায় থাকবেন
যেহেতু শহরের কাছেই, এক দিনের মধ্যে জঙ্গল দেখে চলে আসতে পারেন, শ্রীমঙ্গল অথবা মৌলভীবাজারেই সস্তায় থাকার জন্য হোটেল পাবেন, ভাড়া রুমপ্রতি পড়বে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা, আর আগে থেকে বন বিভাগের লাউয়াছড়া বিট অফিসে যোগাযোগ করে যেতে পারলে থাকতে পারবেন জঙ্গলের ভিতরে ফরেস্ট রেস্ট হাউসে। এখানে ভাড়া পড়বে বেশী, রাতপ্রতি ১০০০ টাকা। তবে রাতে জঙ্গলে থাকার রোমাঞ্চ উপভোগ করতে এখানে থাকা যেতেই পারে।
যে বিষয়গুলো মনে রাখবেন
১। জঙ্গলে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না, এই উদ্যান আমাদের জাতীয় সম্পত্তি, এর রক্ষণাবেক্ষণ ও আমাদের দায়িত্ব
২। উচ্চস্বরে গান বাজনা করবেন না, কথা বলবেন না। জঙ্গলের পশুপাখিদের নিজস্ব জগত আছে, আপনার সরব উপস্থিতি দিয়ে নিশ্চয় তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা ঠিক হবেনা।
৩। শীতকাল ছাড়া অন্য সময় গেলে খুব সাবধানে থাকবেন, এই জঙ্গলে প্রচণ্ড জোকের উতপাত, জুতা পরে জঙ্গলে ঢোকা শ্রেয়। ঘাড়, হাত, পা এ সতর্ক নজর রাখবেন, বিশেষ করে ছড়ার আশেপাশে জোক বেশি থাকে। জোক কামড়ালে টেনে ছাড়াতে যাবেন না, লবণ সাথে রাখবেন, লবণ ছিটিয়ে দিলেই কাজ হবে। লবণ না থাকলে সিগারেটের তামাকেও কাজ চালাতে পারেন
৪। সাপের ব্যাপারে খেয়াল রাখবেন
৫। জঙ্গলে দুর্বৃত্ত শ্রেণীর কিছু লোক থাকে, এরা বন্য প্রাণি দেখানোর কথা বলে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে যেয়ে ছিনতাই করে, এদের ডাকে সাড়া দেবেন না
৬। জঙ্গলের ভেতরের রেল লাইন ধরে হাঁটাহাঁটি না করাই ভাল, কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন যাতায়াত করে এই রেলপথ দিয়ে, অসতর্ক থাকলে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।