আফগানিস্তানে গোপনে মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন যে শিক্ষক
আফগানিস্তানের এক আবাসিক এলাকায় লুকিয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে মেয়েদের একটি ‘গোপন’ স্কুল। স্কুলটির পরিসর খুব ছোট হলেও একে তালেবানের নীতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধিতা হিসেবে বিবিসির এক প্রতিবেদনে উপস্থাপন করা হয়েছে।
ওই স্কুলে ডজনখানেক কিশোরীকে গণিত ক্লাস করতে দেখা যায়।
বিদ্যালয়টির একমাত্র শিক্ষক বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা জানি পুরো বিষয়টি ঝুঁকিপূর্ণ, এবং আমরা তাদের (শিক্ষার্থীদের) নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু, যেকোনো ঝুঁকির বিনিময়েও মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।’
তালেবান আফগানিস্তানের গুটিকয়েক বাদে সব প্রদেশে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়েছে।
বিবিসি বলছে—গোপনে চালু থাকা মেয়েদের বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, বাস্তব শ্রেণিকক্ষের আদলে নীল-সাদা রঙের ডেস্কের সারি বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যালয়টির নারী শিক্ষিকা বলেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্যমতো এটি গোপন রাখার চেষ্টা করছি। যদি তারা (তালেবান) আমাকে গ্রেপ্তার করে কিংবা মারধরও করে, তাতেও আমার কোনো দুঃখ নেই।’
গত মার্চ মাসে ধারণা করা হয়েছিল, আফগানিস্তানে মেয়েদের স্কুল আবার খুলতে চলেছে। কিন্তু, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে শুরু করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তলেবান কর্তৃপক্ষ তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনে এবং স্কুল বন্ধ করে দেয়। ওই ঘটনার কথা মনে হলে গোপন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ অন্যান্য কিশোরী মেয়েরা এখনও গুমরে কাঁদে।
গোপন বিদ্যালয়ে ক্লাস করা ১৯ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘প্রায় দুমাস হতে চলল, স্কুল এখনও খোলেনি।’
চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘(স্কুল বন্ধ থাকায়) আমার খুব মন খারাপ।’
তবে, তালেবানের সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও জারি রয়েছে।
‘সাহস রাখো। যদি তুমি সাহসী হও, তাহলে কেউ তোমাকে রুখতে পারবে না’—আফগানিস্তানের আর সব মেয়েদের উদ্দেশে এমন বার্তা দিয়েছে ওই গোপন স্কুলের ১৫ বছর বয়সি এক শিক্ষার্থী।
তালেবান মেয়েশিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দিয়েছে। এবং দেশটির গ্রামীণ অঞ্চলে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ার পর এসব স্কুলে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বেড়েছে। কিন্তু, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো কবে খোলা হবে, সে ব্যাপারে তালেবান কিছু জানায়নি।
তালেবান কর্তৃপক্ষ বলছে—প্রথমে শুদ্ধ ‘ইসলামিক পরিবেশ’ সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু, যেসব বিদ্যালয় খোলা রয়েছে, সেখানে ছেলে-মেয়েদের আলাদাভাবেই পাঠদান করা হচ্ছে। তাই, ‘ইসলামিক পরিবেশ’ সৃষ্টি করা বলতে তালেবান কী বোঝাতে চায়, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়।
তালেবান কর্মকর্তারা জনসমক্ষে বারবার বলছেন—তাঁরা মেয়েদের স্কুল খুলে দেবেন। সেইসঙ্গে তাঁরা এও বলছেন যে, নারী শিক্ষা তাঁদের জন্য ‘সংবেদনশীল’ একটি বিষয়। তালেবানের আগের শাসনামলে ১৯৯০-এর দশকে নিরাপত্তার অজুহাতে সব মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।একাধিক সূত্র বিবিসিকে বলেছে—এবারের তালেবান প্রশাসনের কিছু কট্টর ও প্রভাবশালী লোকজন এখনও নারী শিক্ষার বিরোধিতা করছেন।
তবে, ব্যক্তিগতভাবে কিছু তালেবান সদস্য মেয়েদের স্কুল না খোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। মার্চ মাসে তালেবান সরকারের শিক্ষা অধিদপ্তরের স্কুল খোলার পরিকল্পনাটি যখন শীর্ষ নেতারা বাতিল করে দেন, তখন খোদ দপ্তরের লোকজনই অবাক হয়েছিলেন। জানা গেছে, কিছু ঊর্ধ্বতন তালেবান কর্মকর্তা নিজেদের মেয়েদের কাতার কিংবা পাকিস্তানে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
তালেবানদের সঙ্গে সংযুক্ত কয়েক জন আলেম সম্প্রতি নারী শিক্ষার অধিকারের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছেন।
পাকিস্তানের পেশোয়ার সীমান্ত এলাকার প্রভাবশালী আলেম শেখ রাহিমুল্লাহ হাক্কানি তালেবানের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি গত মাসে কাবুলে তালেবান সরকারের ঊর্ধ্বতন নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
শেখ রাহিমুল্লাহ হাক্কানি সরাসরি তালেবানের মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়ে বিবিসিকে বলেন, ‘ইসলামি শরিয়াহ আইনে নারী শিক্ষার বিপক্ষে কোনো কিছু বলা নেই। সব ইসলামি কিতাবে নারী শিক্ষাকে জায়েজ ও বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে শেখ রাহিমুল্লাহ হাক্কানি বলেন, ‘পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো ইসলামি পরিবেশে যদি কোনো নারী অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তখন একজন নারী চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করানোই উত্তম।’
আফগানিস্তানের হেরাত ও পাকতিয়া প্রদেশের আলেমেরাও একই ফতোয়া দিয়েছেন। আফগানিস্তানে রক্ষণশীলদের মধ্যেও যে নারী শিক্ষার প্রতি সমর্থন রয়েছে, এসব থেকে তা বোঝা যাচ্ছে। তবে, এসব ফতোয়ার প্রভাব কতটুকু পড়বে, তা স্পষ্ট নয়।
একাধিক সূত্র বিবিসিকে বলেছে—মেয়েদের জন্য মাধ্যমিকের স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়টি পর্যালোচনার জন্য তালেবান একটি কমিটি গঠন করেছে। তালেবানের কয়েক জন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী মার্চ মাসে মেয়েদের স্কুল খোলাবিষয়ক ওই কমিটিতে ছিলেন। কিন্তু, দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় কান্দাহার শহরভিত্তিক তালেবানের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে স্কুল খোলারর বিরোধিতা করা হয়। ওই কান্দাহারেই থাকেন তালেবানের ‘আমির’ মোল্লা হাইবাতুল্লাহ।
গত বছরের আগস্ট আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর প্রাথমিকভাবে তালেবান নমনীয় মনোভাব দেখালেও সম্প্রতি তারা নারীদের নিকাব-হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করেছে। এবং নারীদের ঘরে থাকতে বলাসহ বিভিন্ন কঠোর নির্দেশ জারি করেছে।
বিবিসি বলছে, এরই মধ্যে তালেবানের নিজেদের মধ্যকার ভিন্নমতের প্রতি পারস্পরিক সহিষ্ণু মনোভাবে ঘাটতি দেখা গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক অনুসারী থাকা এক তালেবান সদস্য মেয়েদের স্কুল বন্ধ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের দাড়ি রাখার বাধ্যবাধকতার নতুন নির্দেশের সমালোচনা করে টুইটারে পোস্ট দেন। সূত্রের বরাতে বিবিসি বলছে—ওই ঘটনার জেরে তালেবান গোয়েন্দা সংস্থা ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। পরে তিনি পোস্টটি মুছে ফেলেন এবং দাড়ি রাখার নির্দেশ নিয়ে মন্তব্য করায় ক্ষমা চান।
আফগানিস্তানের তৃণমূল পর্যায়ে নারী শিক্ষার বিরোধিতা তেমন নেই। তবে, তালেবানের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, মেয়েরা স্কুলে গেলে ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিষয়টিকে নতুন করে এজেন্ট নিয়োগ দেওয়ার ছুতো হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, তালেবানকে শত শত কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা পেতে হলে নারী অধিকার নিশ্চিত করাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
এদিকে, এ প্রজন্মের মেয়েরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, সেজন্য আফগান নারী অধিকারকর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিবিসি জানিয়েছে, আফগানিস্তানের ওই গোপন স্কুলে প্রতিদিন এক বা দুই ঘণ্টা করে গণিত, জীববিজ্ঞান, রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞান পড়ানো হয়।
স্কুলটির দায়িত্বে থাকা শিক্ষকটি জানেন যে, আরও অনেক মেয়েই এখানে পড়তে আসতে চায়। কিন্তু পর্যাপ্ত জায়গা, শিক্ষা উপকরণের অভাব, গোপনীয়তা বজার রাখার বাধ্যবাধকতাসহ নানা কারণে তাঁরা আরও বেশি শিক্ষার্থীকে জায়গা দিতে পারছেন না।
শিগগিরই আফগানিস্তানে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুলবে বলে আশা করেন না স্কুলটির শিক্ষক। তবে, তিনি যেটুকু করতে পারেন, তা করে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ‘একজন শিক্ষিত নারী হিসেবে এটি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ওই শিক্ষক বলেন, ‘শিক্ষাই আমাদের এ অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে।’