আফগানিস্তানে হামলা ছিল মার্কিন ভাঁওতা
জন পিলগার, সাংবাদিকতা ও প্রমাণ্যচিত্র নির্মাণ- দুই ক্ষেত্রেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্দাই এলাকায় বেড়ে উঠা হাইস্কুলে থাকার সময়ই সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। মাত্র ২০ বছর বয়সে সাংবাতিকতার জন্য ব্রিটেনের সবচেয়ে মর্যাদাশালী পুরস্কার জেতেন; তাও দুবার। রয়টার্স, ডেইলি মিররের হয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন। কম্বোডিয়ার পলপট-জামানার চিত্র থেকে শুরু করে নিজ দেশের আদিবাসীদের জীবনকথা উঠে এসেছে তাঁর লেখনি আর প্রামাণ্যচিত্রে। আমেরিকার দরিদ্র মানুষের কথা শুনতে তিনি সত্তরের দশকে আমেরিকায় আলাবামা থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত ছুটেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন। জীবনের একটা বড় সময় মুক্তসাংবাদিকতা করে কাটিয়েছেন। স্বীকৃতিস্বরূপ জন পিলগার জীবনে প্রচুর সম্মান পেয়েছেন।
জন পিলগার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া নিয়েও বিস্তর কাজ করেছেন। আফগানিস্তান, ইরান তার মধ্যে অন্যতম। তালেবান কাবুল দখলে নেওয়ার পর পিলগার অস্ট্রেলিয়ার ইন্ডিপেন্ডেট পত্রিকায় ‘হাউ দা ইউএস আর্মি রোয়িন্ড আফগানিস্তান প্লেয়িং গ্রেট গেম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। সেটির অনুবাদই এখানে তুলে ধরা হয়েছে। অনুবাদ করেছেন, চন্দন সাহা রায়।)
পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের কুম্ভিরাশ্রু সুনামির মতো আফগানিস্তানের ইতিহাসকে গ্রাস করে নিয়েছে। এক প্রজন্মেরও বেশি সময় আগে আফগানিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করেছিল; কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন ও তাদের ‘অক্ষশক্তি’ সেই স্বাধীনতাকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে।
১৯৭৮ সাল, তখন বাদশা জহিরের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ দাউদের স্বৈরাচারী শাসন চলছে আফগানিস্তানে। সে সময় পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ) এর নেতৃত্বে দাউদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সরকার গঠন করে। এটি ছিল ব্যাপক জনপ্রিয় একটি বিপ্লব। এই বিপ্লব আমেরিকা ও ব্রিটেনকে অবাক করে দিয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস তখন এক নিবন্ধে বলেছিল, কাবুলের বিদেশি সাংবাদিকরাও অবাক হয়েছিলেন। কারণ, তারা যেসব আফগান সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, প্রত্যেকেই বলেছেন, তারা এই অভ্যূত্থানে খুবই খুশি। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, কাবুলে অন্তত দেড় লাখ মানুষ নতুন পতাকাকে সন্মান জানিয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছে। সত্যিকার অর্থেই উৎসাহ নিয়ে তারা মিছিলে হেঁটেছেন।
ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছিল, নতুন সরকার নিয়ে সাধারণ আফগানদের মধ্যে প্রশ্ন খুব কম। কারণ, এই সরকার ধর্মনিরপেক্ষ, আধুনিক এবং যথেষ্ট পরিমাণে স্যোসালিস্ট। সরকার সার্বিক সংস্কারের জন্য একটি দূরদর্শী কর্মসূচি ঘোষণা করে। সেখানে বিশেষত নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার মতো বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে। রাজনৈতিক কারাবন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেওয়া হয় এবং সমস্ত মামলার নথি জনতা পুড়িয়ে ফেলে।
রাজতন্ত্রের কালে, মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৩৫ বছর! প্রতি তিনটি শিশুর একটি শৈশবেই মারা যেত। শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ নিরক্ষর ছিল। নতুন সরকার এসেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা খাতের ওপর গুরুত্ব দেয় আর সারা দেশজুড়ে গণস্বাক্ষরতা অভিযান চালু করে দেয়। নারীদের জন্য সেখানে কোনোকিছুই ছিল না। আর আশির দশকের শেষে এসে আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অর্ধেকেই নারী, চিকিৎসকদের ৪০ ভাগ, শিক্ষকদের ৭০ ভাগ এবং সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে ৩০ ভাগ নারী ছিল।
এই ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন অনেক মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছিল, তারা সত্যিকার অর্থেই উপকৃত হয়েছিলেন। সেসব দিনের স্মৃতি এখনও সেইসব উপকারভোগী মানুষের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। তাদের মধ্যে সায়রা নুরানি একজন। তিনি একজন সিভিল সার্জন ছিলেন। ২০০১ সালে আফগানিস্তান ছেড়ে যান এই নারী। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিটি নারীরই সেই সময় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার অধিকার ছিল। আমরা তখন যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারতাম। আমরা নিজেদের পছন্দমতোই পোশাক পরতাম। আমার মনে আছে, প্রতি শুক্রবারেই আমি নতুন আসা হিন্দি সিনেমা দেখতে যেতাম, ক্যাফেতে যেতাম। কিন্তু সবকিছুই পাল্টে যেতে শুরু করে যখন মুজাহিদিনরা দখল নিতে শুরু করল। সেসব মানুষ পশ্চিমাদের সমর্থনপুষ্ট ছিল।’
আফগানিস্তানের নতুন সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা ছিল। কারণ, তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থিত ছিল। পশ্চিমারা এই সরকারকে ‘পাপেট’ বলে উপহাস করত। আমেরিকা ও ব্রিটিশ মিডিয়ার অভিযোগ ছিল, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই অভ্যূত্থানে সোভিয়েত-সমর্থন ছিল।
যদিও পরে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রশাসনের পররাষ্ট্র সচিব সাইরাস ভেঞ্চ আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পেছনে সোভিয়েত সমর্থনের কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে ছিল না।’
একই প্রশাসনে কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন পোলিশ বংশোদ্ভূত জেবিগনিউ ব্রজেনেস্কি। উগ্রচিন্তার এই মানুষটি ছিলেন পাঁড় কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী। যার একটা স্থায়ী প্রভাব কার্টারের ওপর ছিল; এবং সেটি ২০১৭ সালের কার্টারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে।
‘অপারেশন সাইক্লোন’
আমেরিকার জনগণ ও কংগ্রেসকে না জানিয়ে ১৯৭৯ সালের ৩ জুলাই প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার আফগানিস্তানের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল সরকারকে উৎখাতের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ অনুমোদন দেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এই ‘গোপন কর্মসূচির’ একটা কোড নাম দিয়েছিল- ‘অপারেশন সাইক্লোন’।
৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কেনা হয়েছে, ঘুষ দেওয়া হয়েছে আর মুজাহিদিন নামে পরিচিত কিছু উপজাতীয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সশস্ত্র করা হয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদক বব উডওয়ার্ড লিখেছেন, সিআইএ তখন শুধু ঘুষের পেছনেই ৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
‘গ্যারি’ নামে একজন সিআইএ এজেন্টের সঙ্গে আমনিয়াত মিল্লি নামে একজন মুজাহিদিনের ঘুষ লেনদেনের একটি বৈঠকের কথাও উল্লেখ করেছেন বব উডওয়ার্ড। তিনি লিখেছেন, ‘গ্যারি’ একটা টেবিলে পাঁচ লাখ ডলার রাখল। এর আগে তারা এমন ক্ষেত্রে দুই লাখ ডলারেই রফা করত। কিন্তু ‘গ্যারি’ এক লাফে ঘুষ এতটা বাড়িয়ে দিলেন। তিনি এটাই হয়তো বলতে চেয়েছিলেন যে, তারা সেখানে আছেন, ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস আর মুজাহিদিনদেরও টাকা দরকার।’
‘গ্যারি’ পরে সিআইএ সদর দপ্তরের কাছে ১০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন।
সারা মুসলিম বিশ্ব থেকেই এই যুদ্ধের জন্য লোক সংগ্রহ করা হয়েছিল। মার্কিন সিক্রেট আর্মি তাদের প্রশিক্ষণ দিত। এর ক্যাম্প করা হয়েছিল পাকিস্তানে। আর সেই ক্যাম্প চালাত পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, সিআইএ এবং ব্রিটেনের এম সিক্সটিন। নাইন-ইলেভেনে জঙ্গি হামলায় বিধ্বস্ত টুইন টাওয়ারের পাশের, নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের ইসলামিক কলেজ থেকেও নিয়োগ করা হয়েছিল। সৌদি প্রকৌশলী ওসামা বিন লাদেনও সেই রিক্রুটমেন্টের একজন ছিলেন।
এর লক্ষ্য ছিল- গোটা মধ্য এশিয়াতে উগ্রবাদী মতাদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি করা; যার চূড়ান্ত ফল হবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করা।
১৯৭৯ সালের আগস্টে কাবুলের মার্কিন রাষ্ট্রদূত বার্তায় লিখেন, পিডিপিএ সরকারের ধ্বংসই এখন আমেরিকার বৃহত্তর স্বার্থ। এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যতের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার করা। এ থেকে বোঝা যায়, আফগানিস্তানের পিডিপিএ সরকারের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কতোটা বিদ্বেষপূর্ণ ছিল।
এর ঠিক ছয় মাসের মাথায় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দোরগড়ায় আমেরিকার তৈরি জিহাদিদের হুমকি টের পেতে শুরু করল। এর প্রতিক্রিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নও গুরুতর পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। আমেরিকা জিহাদিদের স্ট্রিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে তুলে; আর ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচারের কাছ থেকে তারা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পদবি পেয়ে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত মুজাহিদিনরা সোভিয়েত রেড আর্মিকে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত করে ছাড়ে।
মুজাহিদিনরা নিজেদের নর্দান অ্যালায়েন্সের লোক হিসেবে পরিচয় দিত। সেখানকার মাদক, হেরোইন ব্যবসা এদের নিয়ন্ত্রণে। গ্রামীণ নারীদের ওপর নির্যাতন চালাত এরা। বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর যুদ্ধবাজদের প্রভাব ছিল এসব মুজাহিদিনদের ওপর। কেতাবি ইসলামের অতিপ্রয়োগকারী তালেবান নেতারা কালো পোশাক পরত আর চুরি, ধর্ষণ, রাহাজানি, হত্যার বিচার করে বেড়াত। নারীদেরকে সামাজিক জীবন থেকে তারা বিতাড়িত করে ছেড়েছিল।
আশির দশকে, রেভ্যুলেশনারি অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য উইমেন অব আফগানিস্তানের (রাওয়া) সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছিল। সংগঠনটির নেত্রীরা আফগান নারীদের দুর্দশার কথা সারা বিশ্বকে জানানোর চেষ্টা করছিলেন।
সংগঠনটির একজন নেত্রী মেরিনা জানাচ্ছিলেন, তালেবানের সময়ে তার সংগঠনের অনেকে বোরকার নীচে ক্যামেরা নিয়ে পশ্চিমা-সমর্থনপুষ্ট মুজাহিদিনদের হাতে নারীদের ওপর নির্যাতনের দৃশ্য প্রমাণস্বরূপ হিসেবে ধারণ করে। আর এর মধ্য দিয়ে নারীদের ওপর বর্বরতার বিষয়টিও উঠে আসে। কিন্তু সেসব প্রমাণ নিয়ে সব প্রধান মিডিয়া হাউসগুলোতে গেলেও কেউ তা চেয়েও দেখেনি।
সবশেষ ১৯৯৬ সালে পিডিপিএ সরকারের পতন ঘটে। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নজিবুল্লাহ কাবুলের জাতিসংঘ কার্যালয়ে জীবন বাঁচানোর আবেদন নিয়ে যান। কিন্তু ফেরার পথে তাকে ধরে মুজাহিদিনরা ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়।
আজ থেকে শত বছর আগে ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড কার্জন বলেছিলেন, ‘আমি স্বীকার করছি যে (দেশগুলো) দাবার ছকের মতো টুকরো টুকরো ছড়িয়ে আছে এবং সেখানকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এক দুর্দান্ত খেলা চলছে।’
কার্জন যে কথা ইন্ডিয়ার স্বাধীনতার ব্যাপারে বলেছিলেন, একই কথা এখন আফগানিস্তানের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত!
‘বিমান থেকে শুধু বোমা না, খাদ্যও ফেলা হবে’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, শত বছর পরে লর্ড কার্জনের কথাটাই সামান্য একটু ঘুরিয়ে বলেছেন। নাইন-ইলেভেন পরবর্তী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ব্লেয়ার বলছেন, ‘দখলে নেওয়ার এই তো সময়। ক্যালাইডোস্কোপ কেঁপে উঠছে। টুকরোগুলো যেন ফুটছে। তারা আবার গেঁড়ে বসতে পারে। যেন তারা গেঁড়ে বসতে না পারে তার আগেই চলুন, এই পৃথিবীকে আমরা আবার বিন্যস্থ করি।’
তখন আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ব্রিটিশ এই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যে দারিদ্র্য আফগানদের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে এভাবে ফেলে রেখে আমরা দূরে চলে যাব না। এটা নিশ্চিত।’
(নাইন-ইলেভেনের ঘটনা পরিস্থিতিকে আবার পাল্টে দেয়। আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের খোঁজে ইঙ্গ-মার্কিন আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রচুর বেসামিরক মানুষকে ক্লাস্টার বোমার আঘাতে প্রাণ দিতে হয়। জীবনের তরে পঙ্গু হয়ে যায় অনেক মানুষ।) তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ওভাল অফিস থেকে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানের নীপিড়িত জনতা বুঝতে পারবে মার্কিন উদারতা কি জিনিস।… মার্কিন বোমারু বিমানগুলো থেকে এখন শত্রুর লক্ষ্যে আঘাত হানার পাশাপাশি খাদ্য, ওষুধও ফেলা হবে।’
কিন্তু কে না জানে, এর প্রায় প্রতিটি শব্দই ছিল মিথ্যা।
২০০১ সালে মার্কিন হামলার পর আফগানিস্তান ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটিতে খরার কারণে তখন ভয়াবহ অবস্থা চলছিল। পাকিস্তান থেকে প্রচুর ত্রাণ যেত। কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেই সাপ্লাই চেইন বন্ধ হয়ে যায়। প্রচুর মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। সাংবাদিক জোনাথন স্টিল এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, এই হামলার কারণে পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ হাজার মানষের প্রাণহানী হয়েছিল।
‘এক জীবনের দাম দুই ডলার’
১৮ মাস পরে, আফগানিস্তানের একটি গ্রাম, মরু বিবির একটি কবরখানায় আমার সঙ্গে ওরিফার দেখা হয়। তিনি কার্পেট বিছিয়ে স্বামীর কবরের সামনে নতজানু বসেছিলেন। তিনি জানান, একই কবরে স্বামীর সঙ্গে তার ছয় সন্তানও আছে; যারা ক্লাস্টার বোমায় প্রাণ হারিয়েছে। আমেরিকান এফ-সিক্সটিন বিমান থেকে ৫০০ পাউন্ডের বোমার ফেলা হয়েছিল ওরিফার বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না, কাজের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে শুধু স্বামী-সন্তানদের হাড়গোড় পেয়েছেন।
এর এক মাস পর কাবুল থেকে কিছু আমেরিকান লোক ওরিফার কাছে আসে এবং তার হাতে একটি খামে ১৫টি নোট ধরিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে ১৫ ডলার। ওরিফা বলছিলেন, ‘পরিবারের প্রতি মানুষের জীবনের দাম দুই ডলার।’
নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে মার্কিন আক্রমণ একটি ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। তালেবান তখন ওসামা বিন লাদেন থেকে দূরত্ব রেখেই চলতে চেয়েছিল। এর পেছনে কারণও ছিল। তখন মার্কিন তেল কোম্পানির নেতৃত্বে আফগানিস্তানের ওপর দিয়ে তিন বিলিয়ন ডলারের কাঙ্ক্ষিত গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল; যেটিতে বিল ক্লিনটন প্রশাসনের আমলেই সায় মিলেছিল।
সেসময় গভীর গোপনীয়তার মধ্যে, তালেবান নেতাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমন্ত্রণ জানায়। তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি ইউনোকলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তাদেরকে টেক্সাসে নিজের কার্যালয়ে আপ্যায়িত করেন। তারা তখন সিআইএ-এর ভার্জিনিয়ার সদর দপ্তরও ঘুরে আসেন। এই সমস্ত প্রক্রিয়াটি যাদের আগ্রহে হয়েছিল তাদের অন্যতম ছিলেন ডিক চিনি; যিনি পরবর্তীতে জর্জ বুশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন।
‘অনুশোচনা! কিসের অনুশোচনা?’
২০১০ সালে আমি আমেরিকাতে ছিলাম। তখন আমি আফগানিস্তানের এই দুর্ভোগের জনক জেবিগনিউ ব্রজেনেস্কির সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করি। আমি তাকে তাঁর আত্মজীবনী থেকে ধার করে বলি যে, সেসময় তিনি আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যে বিশাল পরিকল্পনা এঁটেছিলেন তা সেখানকার ‘কিছু সংখ্যক মুসলিমকে ব্যাপকভাবে উত্তেজিত করেছিল’।
আমি তাকে প্রশ্ন করি, আপনার কি এ নিয়ে কোনো অনুশোচনা আছে?
জেবিগনিউ ব্রজেনেস্কি উত্তরে বললেন, ‘অনুশোচনা! অনুশোচনা! কিসের অনুশোচনা?’
বর্তমানে আমরা যখন কাবুল বিমানবন্দরের আতঙ্কিত অবস্থা দেখি এবং টিভি পর্দায় ‘নিরাপত্তা’ (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়া) তুলে নেওয়ায় সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের আহাজারি শুনি- তখন কি আমাদের অতীতের সত্যের প্রতি মনযোগ দেওয়া উচিত না? যাতে এইসব দুর্দশা আর কখনো না ঘটে?