সুইডেন ও ফিনল্যান্ড কেন ন্যাটোতে যোগ দিতে চায়
রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক হামলা শুরু করার পর থেকে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের নিরাপত্তা বিষয়ক হিসাব-নিকাশে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ইউরোপের দেশ দুটি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দীর্ঘদিনের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে আসার পরিকল্পনা করছে দেশ দুটি। নিজেদের নিরাপত্তা নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে তারা। খবর আল-জাজিরার।
চলতি বছরের জানুয়ারিতেও ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন রাজধানী হেলসিঙ্কিতে ঘোষণা দিয়েছিলেন—তাঁর দেশ এখনই ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন করতে চায় না। কিন্তু, ইউক্রেনে রুশ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে সে মত এখন বদলে যাচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের এক হাজার ৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে।
ফিনল্যান্ডের মতো ইউক্রেনেরও রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনের হামলা শুরুর পর ইউক্রেনকে পরোক্ষা ভাবে নানা সহায়তা করেছে ন্যাটো। তবে, ইউক্রেন ন্যাটো জোটভুক্ত না হওয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি মাঠে নামেনি জোটটি।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন—ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ন্যাটো জোটের বাইরে থাকার সমস্যাগুলো সামনে এসেছে। যুক্তরাজ্যের আবেরিস্টইউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় নিরাপত্তাবিষয়ক জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আলিস্টার শেফার্ড বলেন, ‘ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ন্যাটোর পূর্ণ সদস্যপদের জন্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে আবেদন করার কাছাকাছি নিতে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।’
এ ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ‘ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের রাজনৈতিক বক্তব্য ও জনমতে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে’ বলে মনে করেন আবেরিস্টইউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
নানা কারণে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে গত শতকে যুক্তরাষ্ট্র ও তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সময় জোটনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বিশ্লেষকেরা বলছেন—বর্তমানের পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে দেশ দুটি নিরাপত্তা নীতিতে সত্যিকারের ঐতিহাসিক পরিবর্তন আনার পথে হাঁটছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আলিস্টার শেফার্ড আরও বলেন, ‘সুইডেনের নিরপেক্ষতা দেশটির জাতীয়তাবাদের অংশ। তবে, ফিনল্যান্ডের নিরপেক্ষতা অনেকাংশেই ১৯৪৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তার চুক্তির নামে চাপিয়ে দেওয়ার ফল।’
ন্যাটোর সঙ্গে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সম্পর্ক
স্নায়ুযুদ্ধের পর ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে, ১৯৯৪ সালে পার্টনারশিপ ফর পিস (পিএফপি) প্রোগ্রাম এবং ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগদানের পর এ সম্পর্ক আরও বেগবান হয়।
জানা গেছে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্যপদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এদিকে, এ বছরের মাঝামাঝি সুইডেনে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ কারণে ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ফিনল্যান্ডের চেয়ে সুইডেন বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়া নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে জনমতে পরিবর্তন এসেছে।
আলিস্টার শেফার্ড বলেন, ‘ফিনল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ এবং সুইডেনের ৪১ শতাংশ মানুষ ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিল বলে কিছুদিন আগেও জরিপে দেখা যায়। তবে, সাম্প্রতিক জরিপের ফল অনুযায়ী, সুইডেনে ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে জনমত বেড়ে ৫০ শতাংশের বেশি হয়েছে। আর, ফিনল্যান্ডে এ হার বেড়ে এখন ৬৮ শতাংশ।’
এদিকে, আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোতে যোগ না দিলেও অনেক আগে থেকেই জোটটির সঙ্গে কাজ করছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনী। দেশ দুটির সেনাসদস্যেরা আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। দুটি দেশই ২০১৫ সাল থেকে সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
ন্যাটোতে কবে যোগ দিচ্ছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন
সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদান দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রথমটি হলো—ন্যাটোতে যোগদানের আবেদনের আগে দেশ দুটির সরকারকে এ বিষয়ে পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে।
এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারল্যুর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সহকারী অধ্যাপক আলেক্সান্দার লানোসজকা বলেন, ‘মনে হচ্ছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড সরকার এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে।’
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো—ন্যাটোর অনুমোদন। তবে, এরই মধ্যে ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের যোগদানকে সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের মতো অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য দেশগুলো। এখন পর্যন্ত ন্যাটোর কোনো সদস্যদেশ সুইডেন ও ফিনল্যান্ডকে সদস্যপদ দেওয়া নিয়ে বিরোধিতা করেনি। ন্যাটোতে নতুন কোনো সদস্য নিতে হলে ৩০ সদস্যের সবার অনুমোদন প্রয়োজন হয়।
যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ক্যাথারিন এ এম রাইট বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ন্যাটো নিজেদের ঐক্য ও শক্তি প্রদর্শনের জন্য সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জোটে যোগদানের আবেদন শিগগিরই অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি বছরেই এ অনুমোদন দেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন ক্যাথারিন।
রাশিয়ার হুঁশিয়ারি
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহে নাখোশ রাশিয়া। এ নিয়ে মস্কো থেকে নানা হুঁশিয়ারিসহ ন্যাটোর বিরুদ্ধেও হুমকি এসেছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিলে এ অঞ্চলে রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে লক্ষ্য করে সীমান্তে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে রাশিয়া।