পুরোনো সেই ঈদের কথা
শৈশবের ঈদ-ই একজন মানুষের জীবনের স্বর্ণালি ঈদ। এরপর কৈশোর-যৌবন আর প্রবীণ বয়সের ঈদগুলো হয়তো তার উজ্জ্বলতা হারাতে থাকে। যেকোনো মানুষের জীবনে শৈশব মানেই তাই সুখময় সময়ের এক অন্তহীন উপাখ্যান। সেই সময়ের ঈদ তার আনন্দলোকের মূল প্রাণশক্তি। শহুরে ক্লান্ত জীবনে খুব বেশি মনে পড়ে টানাপড়েনের সেই ঈদগুলোর কথাই। এখন ঈদকে যাপন করার যথেষ্ট আর্থিক সামর্থ্য আছে আমার, কিন্তু নেই সেই তরতাজা ঈদের অনুভূতি। আহা! সময়, তুমি বড় দ্রুত চলে যাও কেন?
এই নাগরিক জীবনে বেঁচে থাকার প্রয়াসে একটুখানি সুখের আশ্রয় খোঁজার জন্য এখনো আমি বড় বেশি ছুটে যাই সেই শৈশবের ঈদ-স্মৃতির কাছে। সেই স্মৃতির কাছেই যে আমার শত জনমের ঋণ। সেই স্মৃতি রোমন্থন করে জাবর কাটি, অন্য এক জগতে হারাই আমি। এটাই আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা।
সেই শৈশব-কৈশোরে সত্যিকার অর্থেই ঈদ মানে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচুর ভেদাভেদ ভুলে নির্মল আনন্দযজ্ঞে মেতে ওঠার দিন ছিল। ঈদের এই আনন্দের মূল প্রাণশক্তি ছিলাম আমরা শিশুরাই। তাই তো আমরা প্রায়ই বলে থাকি, ঈদ তো শিশুদের জন্য। সত্যিই, এখন আমার বাচ্চারা ঈদ করে, আর আমি ওদের ঈদ উদযাপনের সার্বিক সহযোগিতা করি।
আজ পরিণত বয়সে ঈদের মুহূর্তে বারবার মনে পড়ছে শৈশবের পুরোনো সেই ঈদের দিনগুলোর কথা। আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এক গ্রামে। ঈদের আনন্দের মূল আকর্ষণটাই ছিল নতুন জামাকাপড়। তবে টানাপড়েনের সংসারে জোড়ায় জোড়ায় জামাকাপড় কেনা তখন সম্ভব হতো না। ফলে ঈদের আগমুহূর্তে পুরোনো পাঞ্জাবি-পাজামা, প্যান্ট-শার্ট গোপালপুর বাজারের লন্ড্রিতে দিতাম। সেখানেও থাকত রাজ্যের ভিড়। তখন নিজেরাও কাপড় ধুয়ে পাশের গ্রাম থেকে সাময়িকভাবে বিদ্যুতের তার টানিয়ে লাইন এনে ঈদের আগের রাতে কাপড়গুলো ইস্ত্রি করতাম। সেখানে গ্রামের অন্যরাও কাপড় নিয়ে আসত। সেগুলোও ইস্ত্রি করে দিতাম আমরা কিশোররা। কাপড় ইস্ত্রির সেই মনভোলানো গন্ধ এই শতমাইল দূরের ঢাকা শহরে বসে এখনো যেন টের পাই যেন।
এ বয়সে এসেও আমি আমার চার-পাঁচ বছর বয়সের প্রায় সব ঈদ-স্মৃতিও স্পষ্ট মনে করতে পারি। নানা ঋতুর ঈদ আমি দেখে এসেছি। কখনো গ্রীষ্ম, কখনো বর্ষা, আবার কখনো শীতকালের ঈদ। সব স্মৃতিই মনের কোণে জ্বলজ্বল করছে। সেইসব ঈদ সত্যিকার অর্থেই মহা আনন্দের ছিল।
ঈদ শপিং বলতে তখন আমরা উপজেলা সদর গোপালপুর বাজারে যেতাম। সেখানকার সস্তা শার্ট-প্যান্ট-জুতা পেয়েই যে খুশি হতাম, আজকের ঢাকার বড় বড় শপিংমলের নানা ব্র্যান্ডের কেনাকাটায়ও সেই খুশি খুঁজে পাই না। এ কারণে আমি মূলত ঈদে নিজের জন্য কোনো কেনাকাটাও করি না। এটা এখন অলিখিত একটি নিয়ম আমার। তবে নিজের বাচ্চা-কাচ্চা, আত্মীয়স্বজন, অন্যদের জন্য কেনাকাটা করি।
শৈশবের ঈদের সবচেয়ে মধুর স্মৃতিগুলোর মধ্যে আব্বার সঙ্গে ঈদগাহে যাওয়া। ওই সময় পাশের গ্রাম হাজীপুর এবং তিন গ্রামের ওপারে বাইশকাইল পূর্বপাড়ায় হতো ঈদের জামাত। পূর্বপাড়ার জামাতটি ছিল সবচেয়ে বড়। সেখানে কমপক্ষে ২০-৩০টি গ্রামের মানুষ বিশাল ঈদ জামাতে নামাজ পড়ত। ঈদের দিন সকালবেলাতেই মা গোসল করিয়ে জামাকাপড় পরিয়ে দিতেন। আব্বা আগেই আতর এনে রাখতেন। সেটা মাখতাম। শুরু হয়ে যেত আমার ঈদের সুবাস। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এরপর যাত্রা করতাম ঈদগাহ মাঠের দিকে।
ঈদগাহকে আমরা শুধুই মাঠ বলতাম। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের বাইশকাইল পূর্বপাড়ার সেই মাঠে যখন এই শিশু আমি আব্বার সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে নামাজ পড়তে যেতাম, সে এক স্মৃতিময় সোনালি দিন। পৃথিবীর সব দিনকে এনে দিলেও সেইসব দিনের সমান মূল্য হবে না। আমার মতো অসংখ্য শিশু-ছেলেমেয়ে তাদের বাবাদের হাত ধরে দলে দলে ছুটে আসত মাঠে। বাবাদের এক হাতে জায়নামাজ আরেক হাতে প্রিয়তম শিশুসন্তানের হাতটি ধরা থাকত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ঈদগাহ মাঠের পাশের রাস্তাটায় সারি সারি আমগাছের ছায়ায় বসত হরেক রকমের খাবার আর খেলনার দোকান। আমাদের মতো একেবারে ছোট শিশুদের অনেকেই ঈদ জামাতের মাঠে দাঁড়াতাম না।
এ সময় আমরা শিশুরা তন্ময় হয়ে মাঠে নামাজরত মুসল্লিদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নানা রঙের কাপড় পরা, টুপি মাথায় মুসল্লিরা যখন সারিবদ্ধভাবে রুকু-সিজদায় যেত, তখন তাদের উপুড় হয়ে থাকা বাহারি পিঠগুলো দেখে মনে হতো শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা রঙিন নদীর ঢেউয়ের মতো। আহা! কী সেই দৃশ্য! এখনো এই এত বছর পরও মনে গেঁথে আছে সেগুলো।
নামাজ শেষে আব্বা আসতেন। আমাকে নিয়ে পুতুল, বাঁশি আরো নানা রকমের খেলনা কিনে দিতেন। আম্মার দেওয়া নতুন টাকা খরচ করতাম না। কোনোমতেই না। আব্বার পকেটের টাকা দিয়েই কিনতাম এসব জিনিস। এরপর আবার বাড়ি ফেরার পথে সারি বেঁধে পথচলা। বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মা খেতে দিতেন নিজের হাতে রান্না করা সেমাই, পায়েশ। থাকত মাংস-ভাতের আয়োজনও। খেয়েই বেরিয়ে পড়তাম পাড়াময় ঘুরতে। ঈদি বলতে আব্বা, আম্মা কিংবা নানা-দাদির কাছ থেকে ৫-১০ টাকার সেলামি। সেটাও সেই যুগে ছিল পরম পাওয়া। এভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা-ঘোরাঘুরি-খেলাধুলায় চলে যেত ঈদের দিনটি। পশ্চিম আকাশে ডুবতে থাকত ঈদের দিনের সূর্যটা, আমার মনে রাজ্যের সব বিষাদ আর হাহাকার ভর করতে। আহা! ঈদের দিনটি কেন এত দ্রুত চলে যায়? আবার ঈদ আসতে তো অনেক দিন দেরি।
আজ বহুদূর ফেলে এসেছি পুরোনো সেই সোনালি ঈদের দিনগুলো। সেই ঈদ-স্মৃতিগুলো বারবার হাতছানি দিয়ে আমাকে পিছু ডেকে নিয়ে যায়।
লেখক : সাংবাদিক। বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।