দুর্ঘটনা
ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষেরা
ঈদে ‘বাড়ি ফেরা’ প্রতিবছর এক মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেয়, অন্তহীন দুর্ভোগের সঙ্গে অকালে কিছু প্রাণের হারিয়ে যাওয়ার সংবাদ নৈমত্তিক ঘটনা।
কিন্তু বাড়ি কোনটি? কোনখানে ফেরা?
সাবেকী বাংলা সাহিত্য ফিরে যাওয়ার কাহিনীতে ভরপুর। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা সামন্ত সমাজ ভেঙে পড়ার কাহিনী, পাশের নগরে চটকলের আগমনের কাহিনী, গ্রাম আর নিজের সন্তানদের ধরে রাখতে পারবে না তার ভবিষ্যদ্বাণী, সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর বনওয়ারীর পরাজয় আর সময়ের টানে ভেসে শ্রমিকঘিঞ্জীর মাঝে ঠাঁই নেওয়া বেপরোয়া করালীর জয়েরই কাহিনী। তারপরও তারাশঙ্কর মিছে মায়ার অনুভূতি জাগান, কাহারপাড়ায় করালীর ফিরে যাওয়ার কথা বলেন।
সত্যি, ফেরা, ফিরে চলো, গ্রামে চলো, মাটির টানে, বাংলা সাহিত্য ভরা ছিল এইসব আকুতি। কেননা, গ্রামটাই তখনো বাড়ি, শহর একটা বাধ্যবাধকতা হিসেবে দেখা হতো।
সংকটটুকু কাটিয়ে উঠলেই, একটু ঘুরে দাঁড়ালেই, ঠিক দেখে নিও, আমরা গ্রামের বাড়িতেই ফিরব! তাই ঢাকাবাসী মধ্যবিত্তের বড় অংশেরও থাকত স্থায়ী ঠিকানা আর বর্তমান ঠিকানা, সরকারি চিঠি স্থায়ী ঠিকানাতেই যায়, যদিও মধ্যবিত্ত প্রাপক হয়তো নগরবাসীই অধিকাংশ সময়। এমনকি তদন্ত কি অনুসন্ধান, চরিত্র সনদ—স্থায়ী ঠিকানার জনপ্রতিনিধিদেরই দ্বারস্থ হতে হতো। মধ্যবিত্তের অনুভূতিতে যা ছিল, তা সাহিত্যে ছিল, সংগতকারণেই। মধ্যবিত্ত আর ততটা গ্রামমুখী নয়, বাস্তবতায় কিছুটা মতি এসেছে তার। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না থাকলে একালে কেউ তেমনটা ভাবেন না। সাহিত্যের জিম্মাদারও এই মধ্যবিত্ত চেতনা বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই বাসা ছেড়ে বাড়ির পানে ছুটলেও সাহিত্যে গ্রামে ফেরা নিয়ে আলাপ সামান্য। প্রতিবেদনেরই বিষয় তা, আর উৎসের হাজারটা ডামাডোলে নিমেষে চাপা পড়ে যাওয়া বিষয়ও তা।
কিন্তু সারা বছর যেখানে থাকেন, শ্রম দেন, সেটা কেন বাড়ি নয়! ঈদে বাড়ি যাওয়া সকলের জন্যই ভোগান্তির, কিন্তু বিশেষ করে তো শ্রমিকের জন্যই তো তা এক দুঃস্বপ্নযাত্রা। রেলগাড়ির ছাদে, মালবাহী গাড়ির মাল হয়ে কিংবা ডুবুডুবু নৌযানের যাত্রী হয়ে হাতের মুঠোয় পরিজনদের প্রাণ জিম্মা রেখে যে যাত্রায় সে পাড়ি দেয়, তার তুলনা আদিম পশুপালের সাংবাৎসরিক দীর্ঘ যাত্রার মতো—পথে পথে শ্বাপদ, প্রতিটি জলাশয়ে সরীসৃপ। নিরীহ এই তৃণভোজীরা প্রজাতি রক্ষার তাগিদে অনাহার, ক্ষুধা আর মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ঘাস আর পানির সন্ধানে মহাদেশের এ মাথা-ও মাথা পাড়ি দেয়, প্রবৃত্তির বশেই।
এই শ্রমিকের দেহ এবং প্রজাতি কিন্তু শহরেই বাঁচে। তাহলে কিসের টানে সে এই ফেরে? এটা বরং আমাদের নগরের গঠনের একটা অমানবিক দিক স্মরণ করিয়ে দেয়।
দেহটা বাঁচাবার তাগিদে শহরে যারা আসে, শহরটা তাদের মনটাকে বাঁচাবার কোনো দায় নেয়নি। কাজেই এই বেতনে তার পরিজন বাঁচে না, বাবা-মা বাঁচে না, স্বজন বাঁচে না। কাজেই তার স্মৃতির কাছে, নিকটজনদের কাছে, সংসারের টানে চতুর্দিকে ছিটকে পড়া প্রিয়মুখগুলোর কাছে, বিগতদের হারাবার বেদনার কাছে, এমনকি বহুক্ষেত্রে গ্রামে বেড়ে ওঠা সন্তানের কাছেও ফিরতে হলে ঈদের মতো আয়োজনের কোনো বিকল্প নেই। নগর তার জন্য যেটুকু বিনোদনের বন্দোবস্ত করে রেখেছে, তা লোভনীয় হলেও অত্যন্ত, অত্যন্ত দুর্মূল্য। আর তার চেয়ে বড়, এগুলোর বড় অংশের সঙ্গে সে একাত্মতাও বোধ করে না সংগতকারণেই।
বরং আরো সহজভাবে বললে, ঈদে-পূজায়-পার্বণে মানুষ যে ‘বাড়ি’ যান, সেটা তিনি এখনো মানুষ আছে বলেই যায়, পুরোটা যন্ত্র হয়ে উঠতে পারেনি বলেই যায়। কেননা মানুষ তো কেবল রুটি নিয়ে বাঁচে না, তার আত্মার খোরাক চাই, বিনোদন চাই, মুক্ত পরিসরে হাত-পা মেলা চাই। এতে তার সবটুকু সঞ্চয়ের বড় অংশ হয়তো ফুরোয় যেতে-আসতেই, বাকিটা নানান উদযাপনে। তাই সে পরোয়া করে না, প্রাণের ঝুঁকির মতই মতই তাকেও তুচ্ছজ্ঞান করে। মধ্যবিত্তের মাঝে গ্রামে ফিরতে দেখা যায় প্রধানত নগরে ঘরসংসার করে এখনো থিতু হননি, এমন তরুণদেরই।
খ.
মানুষ ‘বাড়ি ফিরবে’, আপাতত এটা ধরে নিয়েই তাই পরিকল্পনা হওয়ার কথা ছিল। এর দূরবর্তী সমাধান কেবল নগরের মানবিক হয়ে ওঠার মাঝেই আছে, আছে এমন পারিশ্রমিকের মাঝে যাতে শ্রমিক সত্যিকারের নগরবাসী হয়ে উঠতে পারেন। নগরে সন্তান, পিতা-মাতাকে নিয়ে থাকবার সামর্থ্য অর্জন করতে পারলেই কেবল নগরে তিনি বাড়ির অনুভূতি পাবেন, পার্বণের সময়গুলোতে বিনোদনের পেছনে খরচ করবার সামর্থ্য অর্জন করলেই নগরে এই শ্রমজীবীরও উপযুক্ত যথেষ্ট পরিমাণ বিনোদনের ক্ষেত্র গড়ে উঠবে।
কিন্তু পার্বণে তো মানুষ বাইরেও যায়, ছুটি কাটায়। সব দেশেই। পরিবহনে বাড়তি চাপ তাই আমাদের কোনো একক বৈশিষ্ট্য না। আমাদের কর্তারা কথা যত বলেন, বড় বড় প্রকল্পে তাঁদের যত আগ্রহ, ‘বাড়ি ফেরার’ এই ঢলগুলোর সময়ে নির্লজ্জ মিথ্যা আশ্বাস আর দাম্ভিক দোষারোপ এবং অর্থহীন উপদেশবাণী ছাড়া আর কিছু তাঁদের দিক থেকে দেখা যায় না।
যেমন এক কর্তা কিংবা বলা চলে সব কর্তার পক্ষ থেকেই একজন কী বলেছেন, দেখুন। কটা টাকা বাঁচাবার জন্য রেলগাড়ির ছাদে কিংবা নৌযানে অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে অথবা মালবাহী গাড়িতে না যাওয়ার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।
কটা টাকা বাঁচাবার জন্য! যে সতেরোটা প্রাণ ঝরে গেল ২৪ জুন সাতসকালে, তাদের বিশ জন সিমেন্টের বস্তাবোঝাই ট্রাকে বাড়ি ফেরার জন্য দিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা, একাধিক পত্রিকায় এসেছে এ খবর। মাথাপিছু ছিল এক হাজার ২৫০ টাকা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সমান কিংবা বেশি খরচ করে এই শ্রমিকরা বাধ্য হয়েছেন সিমেন্টবোঝাই বস্তার ওপর বসে ‘ঘরে ফিরতে’। এর বাইরেও আরো প্রায় ৩০ জন যাত্রী তোলা হয়েছিল ট্রাকটিতে।
সারা বছর যাঁরা মুনাফা করেন, সেই পরিবহন মালিকরা পার্বণগুলোর জন্যও লোভী কুমিরের মতোই অপেক্ষা করেন। হাতিয়ে নেওয়ার হাত থেকে রক্ত জল করা সহায়টুকু রক্ষা করার বিশেষ দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের, তাঁরা বরং এই তৎপরতায় সহায়ক ভূমিকাতেই ব্যস্ত।
শ্রমিকের বাড়ি যাওয়ার এই প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদের নিয়ে আলাপের কিছু নেই। কিছু বিষয় বোঝার অক্ষমতা দিয়েই সৃষ্টিকর্তা তাঁদের বানিয়েছেন। কিন্তু যাঁরা ‘বাড়ি ফেরার’ বিপক্ষে না হলেও নিরাপদে দেখেশুনে ফিরতেই কেবল উপদেশ দেন, অথবা দুর্ঘটনার দায়টা এসব মানুষের ওপর চাপিয়ে দেন, তাঁদের বরং হিসাব করে দেখানো উচিত, সব পরিবহনের বন্দোবস্ত মিলে কত দিনে এই পরিমাণ মানুষ নিরাপদে ঢাকা ছাড়তে পারবে। রেলপথ-নৌপথের মতো গণপরিবহনগুলোর দৃশ্যমান প্রায় কোনো উন্নতি না করেই এই বাগাড়ম্বর করা যাচ্ছে, কারণ এই দেশে লুটেরাসমাজ লজ্জা পাওয়ার প্রয়োজনটুকুও হারিয়েছে।
সালেহা শফিক আর মফিজের দল প্রতিবছরই যখন বাড়ি যান, প্রতিবছরই যেতে থাকবেন, আপাতত এটা ধরে নিতে হবে। যত দিন না নগর তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠার যোগ্যতা ও সামর্থ্য অর্জন করতে পারে কিংবা গৃহগামী এই মানুষগুলো শহরের অধিকার দখল করার মতো, বুঝে নেওয়ার মতো রাজনীতি গড়ে তুলতে না পারে। মানুষ যত দিন যাবেন, কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ততকাল তাদের যাওয়ার বন্দোবস্ত করা, নিরাপদ করা। এমনকি তাঁরা যদি ট্রাকেও যান, ট্রাক বন্ধ করা নয়, ট্রাকে যেন বাড়তি চালক থাকে, ট্রাক যেন মালবোঝাই না হয়, অর্থাৎ মালপরিবাহী বাহনও যদি উপায়ন্তরহীন গৃহগামীর সম্বল হয়, উৎসবের মতো জরুরি সময়ে সেটাও নিরাপদ করাই একমাত্র কাজ হতে পারে। উপদেশ দান এমন ক্ষেত্রগুলোতে দায়িত্ব এড়াবারই নামান্তর।
গ.
কৃষি দিয়ে পরিবার টেকে না বলেই কৃষকের সন্তান শহরে আসেন। গ্রাম থেকে শহরে কিন্তু শুধু খাদ্যই আসে না, আসে সার-কীটনাশক-বীজ-বিদ্যুৎ-জ্বালানি-পোশাক-বই খাতা ইত্যাদির মূল্য, এনজিও ঋণ এবং কর বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থও। তো এত এত দিয়ে গ্রাম টিকে আছে কী করে?
গ্রামের অর্থনীতির রক্তসঞ্চালন ঘটে ঢাকায় ‘বাসা’ কিন্তু গ্রামে ‘বাড়ি’ যাঁদের, সেই মানুষদের মাধ্যমেই, যাঁদের অধিকাংশই দরিদ্র। নব্বই দশকেও প্রধান যে বর্গটি গ্রামে টাকা পাঠাতেন, তাঁরা ছিলেন রিকশাচালক। তাঁদের দশজনকে শোধালে আটজনই গড়ে হয় বলতেন, কিস্তি শোধ করতে, নাহলে বলতেন কৃষির লোকসানটা পোষাতে ঢাকায় এসে রিকশা চালান। এখনো তাঁরা বেশ বড় অঙ্কের টাকা বাড়িতে পাঠান। ঈদের সময় পনেরো দিন থেকে এক মাস রিকশা চালিয়ে উৎসবের খরচা জোগানো থেকে শুরু করে বছরের ঘাটতির কিছুটা মেটাবার লক্ষ্য থাকে বহু মানুষের। কিন্তু বহু বছর আগেই রিকশাচালকদের বহুগুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে আর একটি খাত : সেটি পোশাক শ্রমিকরা।
চল্লিশ লাখেরও বেশি শ্রমিক, প্রতি মাসেই যাঁদের প্রায় সবাই গ্রামে টাকা পাঠান। এর বাইরে প্রবাসী আয়ও একটা বড় খাত হিসেবে আছে। নিজেরা যতই অপুষ্ট হোন না কেন, নারী পোশাক শ্রমিকরা আজ বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান পুষ্টিদাতা।
যে সামান্য মজুরিতে তাঁরা বাঁচেন, গ্রামে থেকে যাওয়া মা-বাবাকে এবং সন্তানকে বাঁচান, তা অবিশ্বাস্য। বোনাস পেলে ভালোই লাগে, এটা মেনে নিয়েই একজন বললেন বোনাসের তুচ্ছ পরিমাণটার কথা : ‘য্যার লাখ ট্যাকা বেতন, হেও পুরা মাসের বেতন, য্যার সাত হাজার হ্যারও পুরা মাসের বেতন!’ ঢাকার ঘর ভাড়া-বিদ্যুৎ-মাস খরচা শোধ করে, বাড়ি যাওয়া আসার পথ খরচা পনেরোশ টাকা প্রায় বাদ দিয়ে, মা-ছেলে আর ছোট বোনের জন্য একটা কাপড় কিনে, ঈদের সেমাই আর পোলাও-গোশতের একটু আয়োজন করে নিজের জন্য কী কিনতে পারবেন, তার একটা হিসাব কষছিলেন, বারবার অগ্রাধিকার বদলে যাচ্ছিল সরলে দোলকের মতো। কিন্তু তিনি তো ভাগ্যবান, আগেই বোনাস পেয়েছেন বলে এত হিসাব করতে পারছেন। ঈদের মাত্র দুদিন আগ পর্যন্ত যাঁরা উৎকণ্ঠায় থেকে বোনাসটা পেলেন না, সে শতকরা পঞ্চাশজন শ্রমিকের বেতনই ভরসা।
পথে পথে শুধু মৃত্যুফাঁদই অপেক্ষা করে নেই, খালি হাতে ‘বাড়ি ফিরে’ কোন উৎসবের অংশ তাঁরা হবেন, তারও অনেক কাহিনী অনেক গল্প আছে। অনেকেরই কথা শুনেছি, যাঁরা নিজের পুষ্টিবঞ্চনার বিনিময়ে উৎসবের জন্য কিছু জমিয়ে রাখেন।
ঘ.
কুড়িগ্রামের উলিপুর নামের একটি উপজেলায় দিন দুয়েক থাকা হয়েছিল দুই বছর আগে। কথায় কথায় স্থানীয় একজন ইজিবাইক আর মাহিন্দ্রা নিয়ে বললেন, এর আর কী এমন যানজট, ঈদের দুই দিন পর আসবেন, ট্রাকের জট দেখবেন।
ট্রাকের যানজট!
হ্যাঁ। ঈদের সময়ে চড়া পরিবহনের ভাড়া বাঁচিয়ে কয়েকশ বেশি টাকার আনন্দ যদি ‘বাড়ি’ নিয়ে যাওয়া যায়, সেই আশায় এই লোভাতুর মেয়েগুলো গাজীপুর-সাভার-কালিয়াকৈর থেকে গাদাগাদি ট্রাকে চেপে উলিপুরের মতো প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী জনপদে ‘নিজের বাড়ি ফেরে’। শরীরের ক্ষয় যতটুকুই হোক, মনের কিছুটা খোরাক নিয়ে আবারও কারখানারূপী কারাগারগুলোতে স্বেচ্ছায় হাজির হয় শ্রমবিক্রি করতে। সংসারবন্দি নারীদের পিতৃগৃহে ফেরার নাইওর একদা জনপ্রিয় উদযাপন ছিল, সাহিত্যজুড়ে নাইওরের আকুতি। নাইওর নেওয়ার জন্য ভাইয়ের প্রতি অন্তত স্বপ্নে দেখা দেওয়ার আকুতি আছে, এমনকি পরমের সঙ্গে মহামিলনকেও নাইওর হিসেবে দেখার চল বাংলা গানে অনেক মিলবে। সাহিত্যের আর সব শাখায় সামান্য হলেও সংগীতে একটা-দুটো করে তাদের কথা আসা শুরু হয়েছে; তারপরও দুই ঈদে ‘বাড়ি ফেরা’ এই আধুনিক নাইওরিদের বর্ণনায়ও জীবনান্দীয় সেই অগ দাশের অগণনের বিবরণই এখনো মনে ভাসে :
“জীবনের ইতর শ্রেণীর
মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
এই সব প্রাণকণা জেগেছিল—বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
সহসা সুন্দর ব’লে মনে হয়েছিল কোনো উজ্জ্বল চোখের
মনীষী লোকের কাছে এই সব অনুর মতন
উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।”
ঙ.
‘ঘরে ফিরতে গিয়ে’ যে সতেরোটি প্রাণ ঝরে গেল, সেই শোক এত সহজে যে আমরা জাতি হিসেবে হজম করছি. তা আমাদের সমাজের বিকারহীনতারই ইঙ্গিতবাহী। যেমন পাহাড়গুলোর ধসে পড়াও আমরা নির্বিকারপ্রায় দেখেই গেলাম। নিহত মানুষগুলোর রাষ্ট্রের এবং পরিবহন মালিকদের অবহেলাতেই প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের প্রাণের ক্ষতিপূরণ দাবি ন্যূনতম দাবি। কিন্তু এগুলো বড় সংবাদ, তাই প্রতিবেদন হিসেবে, শোকবার্তা হিসেবে গণমাধ্যমে ঠাঁই পেলেও উৎসবের ডামাডোলেই চাপা পড়ে যাবে। কিন্তু রাজনীতির দিকে যদি তাকাই, সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই, এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখের প্রকাশ যৎসামান্য, সেইখানে শক্তি নিয়ে না দাঁড়াতে পারলে তো পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।