বেলাল চৌধুরী : অভিভাবকতুল্য সাহিত্য ব্যক্তিত্ব
একে একে খসে পড়ছে নক্ষত্র, ফলে দেশের সাহিত্যাঙ্গন নিষ্প্রভ হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়ের যেন অবসান ঘটে চলেছে। মহীরুহ অনুপস্থিত হয়ে গেলে শূন্যতার বোধের পাশাপাশি অসহায়ত্বের অনুভূতিও জেগে ওঠে। বেলাল চৌধুরীর মতো অভিভাবকতুল্য সাহিত্য-ব্যক্তিত্বের চলে যাওয়ার অর্থ কী, সেটি অনুধাবনের জন্য সমকাল থেকে দূরবর্তী হওয়ার দরকার পড়বে না। ঢাকা-কলকাতার লেখকসমাজে অদৃশ্য সেতুবন্ধস্বরূপ ছিলেন তিনি বহু যুগ। এ ক্ষেত্রে তিনি একক ও বিশিষ্ট। তাঁর বিকল্প তৈরি হয়নি, হওয়ার কথাও নয়। পাঠক হিসেবে ছিলেন সর্বভূক ও নিবিষ্ট।
ইন্টারনেট প্রচলনের আগে তিনি ছিলেন দেশের গুটিকতক সহিত্যিকের অন্যতম, যাঁর কাছে পাওয়া যেত বিশ্বসাহিত্যের হালফিল খবর ও বিশ্লেষণ। ভবঘুরে ও আড্ডাবাজ দিলখোলা মানুষ হিসেবে তাঁর একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল। কাছের লেখকরাই শুধু জানতেন, তাঁর বিশ্বসাহিত্যজ্ঞান ছিল কতটা বিস্তৃত। নোবেল বিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস একবার এসেছিলেন ঢাকায়। পুরান ঢাকা সফর তাঁর জন্য জরুরি। উপন্যাসে ব্যবহার করবেন তিনি সেই অভিজ্ঞতা। সে সময় একমাত্র বেলাল চৌধুরী ছাড়া আর কে-ই বা ছিলেন, যিনি ওই খ্যাতিমান জার্মান লেখককে সঙ্গ দেবেন? তাঁর দেশের গ্যেটে বা টমাস মানের প্রসঙ্গ যদি উঠেই যায় আড্ডায়, তাহলে কথার পিঠে কথা চালানোয় সম-অবস্থান বজায় থাকতে হবে না!
সাহিত্যনির্ভর সাময়িকী সম্পাদনার ক্ষেত্রেও বেলাল চৌধুরীর আসন ছিল উঁচুতে। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী, ভারতবিচিত্রা সম্পাদনা তাঁর গুরুত্বপূর্ণ পেশাদার কাজ। তিনি পাঠকপ্রিয় কবি হয়তো ছিলেন না, যদিও তাঁর কবিতায় একটা অন্য রকম স্বাদ বরাবরই ছিল, যা দিব্যি প্রতিদিনের বাস্তব জীবনের সঙ্গে মানিয়ে যায়। আবার তা একই সঙ্গে বৈদেশিক কবিতারও মিত্রবন্ধুসুলভ। স্বভাবগত রঙ্গরস, বিদ্রুপ এবং ভিন্নতর অভিব্যক্তি পাওয়া যেত তাঁর কবিতায়। লেখক-সম্পাদক-বান্ধব-অভিভাবক—সব ভূমিকা মিলিয়ে সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তাই। যে কেউ তাঁর সঙ্গে নিঃসংকোচে কথা বলতে পারত, বন্ধু হয়ে উঠতে পারত।
দীর্ঘ জীবনই তিনি পেলেন, কিন্তু কে না জানে তাঁর মতো প্রাণবন্ত এক সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য আশি বছরও কত কম। খেদের সঙ্গে বলতে হয়, ধীরে ধীরে আমাদের সাহিত্যভুবন এমন একটি অবয়ব ধারণ করেছে যে সত্যিকারের ভালো মানুষ রীতিমতো দুর্লভ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। বেলাল চৌধুরী ছিলেন একজন পরোপকারী ভালো মানুষ। কে পায়নি তাঁর উপকার? নব্বই দশকের শুরুর দিকে সাহিত্য মাসিক মাটি সম্পাদনার কাজে যুক্ত হয়েছিলাম। তখন তাঁর কাকরাইলের বাসায় যাওয়া পড়ত। মাটির প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিশিষ্টজনদের মন্তব্য সংগ্রহ করেছিলাম আমরা। একদিন তিনি আমার চাকরিস্থল দৈনিক বাংলার বাণীতে এসে উপস্থিত। আমি তখন পেস্টিং রুমে। সেখানে এসেই বললেন, তোমাকে রুমে না পেয়ে এখানে এসেছি। কাগজ-কলম দাও, আমার মন্তব্য লিখে দিচ্ছি। লিখলেন : ‘সাদাসিধে মাটি নামের সর্বাঙ্গসুন্দর মাসিক পত্রিকাটি বাংলাদেশে একটি নির্ভেজাল খাঁটি সাহিত্য পত্রিকার একান্ত অভাবকে পূর্ণ করে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে। সদাহাস্যময় তরুণ কবি মারুফ রায়হান অবিচল নিষ্ঠা ও একান্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে অসাধ্য সাধন করেছেন...।’ কতটা উদার না হলে একজন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক ও সম্পাদক নবীন একজনের কাজ নিয়ে এমনভাবে লিখতে পারেন।
আমরা জানি, কী রসিকই না তিনি ছিলেন। বছর কয়েক আগে হঠাৎ তাঁর ফোন পেলাম। কণ্ঠস্বর চিনে উঠতে পারিনি। বললেন, স্যার, আমি আপনার একজন সামান্য ভক্ত। কবি মান্নান সৈয়দের চমৎকার একটি ইন্টারভিউ আপনি নিয়েছেন, ওটার কপি আমার খুব প্রয়োজন। তাই আপনাকে বিরক্ত করা। ততক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি ফোনের অপর প্রান্তে কে আছেন। ওই সাক্ষাৎকারে মান্নান সৈয়দ তাঁর টিভি নাটকে অভিনয় প্রসঙ্গে বেলাল চৌধুরীর কথা বলেছিলেন। বেলাল চৌধুরী বাস্তব চরিত্রেই ওই নাটকে অভিনয় করেন।
মানুষকে ভালোবাসার, তার কোনো উপকারে আসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন আমাদের প্রিয় বেলাল ভাই। তাঁর প্রস্থানে আজ সর্বস্তরের মানুষের মন কাঁদছে। কারো বিদায়বেলায় গভীর বেদনাবোধের মতো অমূল্য সম্পদ অর্জন করা যায় কেবল সত্যিকারের ভালোবেসেই।