বিশ্বসেরা ১০০ বই
জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’
ইংলিশ লেখক জর্জ অরওয়েলের (George Orwell) লেখা বিখ্যাত বই ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’। ডিসটোপিয়ান এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ৮ জুন। ২৬৭ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি প্রকাশ করেছিল সেকের অ্যান্ড ওয়ারবার্গ।
মূলত এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। ব্রিটেনের অস্থির রাজনৈতিক সময়ে সরকারের দমননীতি, নজরদারি, গুপ্তহত্যা- এসবই তুলে আনা হয়েছে উপন্যাসটিতে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই উপন্যাসটি লিখেছিলেন অরওয়েল। সেই সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকদের রাজত্ব চলছিল। স্পেন, জার্মানি, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য দেশ তথা পুরো বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে অস্থিরতা সেটি তুলে ধরতেই কলম ধরেছিলেন অরওয়েল।
যেই সময়ে অস্ত্রের ক্ষমতাই ছিল মূল ক্ষমতা। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা ছিল না। দারিদ্র্য আর ক্ষুধা ছিল সাধারণ জনগণের নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে যোগ হতো সরকারি নিপীড়ন, জোরপূর্বক শ্রমিক হিসেবে কাজ করানো এবং গণহত্যা।
যদিও ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’-এর গল্প ও চরিত্র কাল্পনিক কিন্তু চোখে দেখা বাস্তব থেকেই নেওয়া এর প্রেক্ষাপট। সরকারি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তখন দাঁড়ানোর মতো অবস্থা ছিল না। জনগণের প্রতিদিনের জীবনযাপনে ছিল সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ।
২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের তৈরি ১৯২৩ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে রচিত সেরা ১০০ ইংরেজি ভাষার উপন্যাসের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিল ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’। বিবিসির ‘দ্য বিগ রিড’ জরিপে ৮ নম্বরে ছিল উপন্যাসটি।
কাহিনী সংক্ষেপ
শোষণ, বঞ্চনা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এক গল্প ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’। উপন্যাসটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর চরিত্র ‘বিগ ব্রাদার’। ক্ষমতাসীন ‘আউটার পার্টি’র প্রধান ব্যক্তি তিনি। আর এই রাজনৈতিক দলটি সব সময় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যই কাজ করে থাকে। অন্যদের দিকে নজর দেওয়ার সময় তাদের নেই। জনগণকে শোষণ করে ক্ষমতা ধরে রাখাই তাদের লক্ষ্য।
ছবির মূল চরিত্র উইন্সটন স্মিথ। আউটার পার্টির একজন সদস্য তিনি। সত্য মন্ত্রণালয়ের (মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ) হয়ে কাজ করেন স্মিথ। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ হচ্ছে সরকারের পক্ষ বিভিন্ন প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডা চালানো।
আর উইন্সটন স্মিথের কাজ হচ্ছে পুরোনো দিনের পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত সব প্রতিবেদন আবার নতুন করে লেখা। নতুন করে প্রতিবেদনগুলো এমনভাবে লেখা হয়, যাতে তা শাসকদলের পক্ষে যায়। অর্থাৎ ইতিহাসকে নতুনভাবে শাসকদলের মতো করে লেখার কাজটি করেন স্মিথ।
ক্ষমতাসীন সরকারের শোষণ, নিপীড়ন আর সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয় এতে। লেখা হয় সরকারের পক্ষে নতুন ইতিহাস। এ ছাড়া সত্য মন্ত্রণালয় পুরোনো সব তথ্যাদি ধ্বংস করে দিতে থাকে, যাতে সরকারের অত্যাচারের কোনো চিহ্ন বা প্রমাণ না থাকে।
তবে সরকারের পক্ষে এসব কাজ করতে একদম মন সায় দেয় না উইন্সটন স্মিথের। নিজের দলকে মনে মনে ঘৃণা করেন তিনি এবং স্বপ্ন দেখেন একদিন ‘বিগ ব্রাদার’-এর বিরুদ্ধে বিপ্লব করবেন তিনি।
অরওয়েল ‘বিগ ব্রাদার’ চরিত্রে এমন একজন স্বৈরশাসককে তাঁর উপন্যাসে তুলে এনেছেন, যাঁর মধ্যে জার্মানির হিটলার এবং সোভিয়েতের স্টালিন, দুজনেরই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর মাধ্যমে সেই সময়ের রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে তুলে ধরেছেন তিনি। সরাসরি প্রকাশ না করলেও লেখার মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের পরিচয় তিনি তুলে ধরেছেন। কারণ অরওয়েলের কলমে তৈরি স্বৈরশাসকের রয়েছে বক্তৃতা দেওয়ার দারুণ গুণ। কথার মাধ্যমে মানুষকে উজ্জীবিত করতে পারেন তিনি। আর রয়েছে কালো ঘন গোঁফ।
লেখক পরিচিতি
জর্জ অরওয়েল আসলে ছদ্মনাম, লেখকের আসল নাম ছিল এরিক আর্থার ব্লেয়ার। ১৯০৩ সালের ২৫ জুন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মতিহারিতে তাঁর জন্ম। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও সমালোচক। সামাজিক অনাচার, সামগ্রিকতাবাদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন তিনি। গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ সমর্থন।
তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাসিকা (novella) অ্যানিমেল ফার্ম ও ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘নাইনটিন এইট্টি ফোর’ উপন্যাসের জন্য। এ ছাড়া তাঁর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে রয়েছে ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়েল’ (১৯৩৭), ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ (১৯৩৮)।
রাজনীতি সচেতনতাই লেখক হিসেবে অরওয়েলকে সবার থেকে আলাদা করেছে। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি ৪৬ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
** বিশ্বসেরা ১০০ বইয়ের তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত তালিকা অবলম্বনে। এই তালিকাটি তৈরি করেছে ‘নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস’। বিশ্বের ৫৪টি দেশের ১০০ জন লেখকের কাছে তাদের চোখে সেরা ১০টি বই ও লেখকের নাম চেয়েছিল নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস। ১০০ জন লেখকের দেওয়া সেই তালিকার ভিত্তিতেই যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে এই তালিকা।