থামার কোনো সুযোগ নেই : আলেহান্দ্রো গনজালভেজ ইনারিতু
পরপর দুইবার অস্কারে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন মেক্সিকান পরিচালক আলেহান্দ্রো গনজালভেজ ইনারিতু। গত বছর ‘বার্ডম্যান’ ছবির জন্য আর এ বছর জিতেছেন বহুল প্রশংসিত ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবির জন্য।
‘বার্ডম্যান’ ছবির অসাধারণ নির্মাণ ইনারিতুকে সিনেমার দরবারে সবার কাছে পরিচিত করে তোলে। তবে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে তিনি আগে থেকেই আলোচিত ছিলেন তাঁর অন্যান্য ছবির জন্য।
আলেহান্দ্রো গনজালভেজ ইনারিতু জন্মেছিলেন ১৯৬৩ সালের ১৫ আগস্ট মেক্সিকো সিটিতে। একই সঙ্গে তিনি একজন পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার এবং সঙ্গীত পরিচালক।
২০০৭ সালে ‘বাবেল’ ছবির জন্য প্রথম মেক্সিকান পরিচালক হিসেবে অস্কারে সেরা পরিচালকের মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরস্কার পাওয়া প্রথম মেক্সিকান পরিচালকও তিনি।
ইনারিতু পরিচালিত ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আমরোস পারোস’ (২০০০), ‘টুয়েন্টি ওয়ান গ্রামস’ (২০০৩), বাবেল (২০০৬)। এই তিনটি ছবিকে একসাথে বলা হয় ‘ডেথ ট্রিলোজি’। এ ছাড়া রয়েছে বিউটিফুল (২০১০), বার্ডম্যান (২০১৪), দ্য রেভেন্যান্ট (২০১৫) তাঁর উল্লেখযোগ্য ছবি।
‘বার্ডম্যান’ ছবির জন্য ২০১৫ সালে অস্কারে সেরা পরিচালক, সেরা ছবি ও সেরা মৌলিক চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন ইনারিতু।
‘দ্য টকস’ এর পক্ষ থেকে ২০১৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি ইনারিতুর এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল ।
প্রশ্ন : মিস্টার ইনারিতু, একজন পরিচালককে কি নিজের ছবি নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়?
ইনারিতু : আমি মনে করি, প্রতিটা চলচ্চিত্রই আপনার বিস্তৃত রূপ। কীভাবে?- সেটা বিষয় না। আমার সবগুলো চলচ্চিত্রই আমার নিজের সম্প্রসারিত রূপ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় চলচ্চিত্র, বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। হঠ্যাৎ করেই দেখবেন চলচ্চিত্র আর বাস্তব জীবনের মধ্যে যে সূক্ষ রেখাটা আছে সেটা উধাও হয়ে যাবে। তখন মনে হবে ছবিতে যা ঘটেছে, সেটা আসলে আপনার জীবনেই ঘটছে। আমার ক্ষেত্রে এ রকম অনেকবার হয়েছে।
প্রশ্ন : নির্দিষ্ট করে বলবেন, কোনো ছবির ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে?
ইনারিতু : এখন ঘটছে ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ নিয়ে। ছবিটার ভেতর মানুষের অদম্য শারীরিক ও মানসিক শক্তির যে বিষয়টা তুলে ধরা হয়েছে, সেটা এখন আমার প্রতিদিনকার জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমরা যখন শুটিং করেছি, আমরাও ওই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। খুবই ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যে আমাদের কাজ করতে হয়েছে। একদিন তো মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে শুটিং করতে হয়েছিল। ছবিতে চরিত্রগুলোর যে শারিরীক বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, শুটিং করার সময় আমরাও সেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিলাম। চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতা আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলে গেছে।
প্রশ্ন : এই ধরনের পরিবেশে শুটিং করার জন্য আপনি বদ্ধপরিকর ছিলেন কেন?
ইনারিতু : আমি এভাবে কাজ করতেই পছন্দ করি। ছবির গল্পটাই এর লোকেশন ঠিক করে দিয়েছে। তাই আমরা গভীর জঙ্গলে চলে গিয়েছি। সত্যিকারের লোকেশনেই আমরা শুটিং করেছি। এতে সেই সময়ের পরিবেশ, ঐতিহ্য এবং আদিভাবের সঙ্গে মিশে গিয়ে আমরা কাজ করতে পেরেছি। আর এ কারণেই আমরা কোনো স্টুডিও ভাড়া করে কৃত্রিম সেট বানিয়ে ছবি বানাইনি। তাহলে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতাম আমরা। ছবির কাজ করতে গিয়ে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করার যে মানবিক প্রবণতা সেটা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। আমরা কৃত্রিম কোনো আলো ব্যবহার করিনি। প্রকৃতির আলোতেই ছবি তুলেছি। আমার কাছে বিষয়টা খুব স্পষ্ট, কম্পিউটারে যতই নিখুঁত কাজ করি বা যত নিখুঁত সেটই বানানো হোক না কেন বাস্তব্তার সঙ্গে সেটা কখনোই পুরোপুরি মিলবে না।
প্রশ্ন : কেন মিলবে না?
ইনারিতু : শুধু বাস্তবের সৌন্দর্য বা জটিলতার জন্যই নয়, মন থেকে কখনো আমি কৃত্রিম উপায়ে শুটিং করার বিষয়টা মেনে নিতে পারি না। কারণ এটা পুরো ছবির প্রতিবিম্ব হিসেবে কাজ করে, তাই নয় কি? আমি সত্যিই এ ধরনের অভিজ্ঞতা নিতে পছন্দ করি। ছবিটা বানানোর প্রথম কারণ হয়ে দাঁড়ায়, ছবিটা নিজেই। আর আমরা তখন শিকারিদের মতো ছবিটাকে ধরার চেষ্টা করি। বুঝতে পারছেন বিষয়টা? এটা দারুণ একটা অভিজ্ঞতা ছিল একই সঙ্গে আবেগময় এবং শারীরিক দিক থেকেও চ্যালেঞ্জিং।
প্রশ্ন : ওয়ার্নার হারজগের ‘অ্যাগুইরে, দ্য ওয়ার্থ অব গড’ (১৯৭২) ছবিটির কথা মনে পড়ে গেল। পরিচালক হারজগের বিশ্বাস ছিল পেরুভিয়ান রেইনফরেস্টের দুর্গম পরিবেশে শুটিং করলে সেটা পুরো ছবিতেই ফুটে উঠবে।
ইনারিতু : হ্যাঁ। হারজগের ‘অ্যাগুইরে’ অথবা ‘ফিৎজকারালদো’ (১৯৮২) আমাকে প্রভাবিত করেছে। আকিরা কুরোসাওয়া একটা ছবি করেছিলেন ‘দেরসু উজালা’ (১৯৭৫) নামে। অথবা ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’ (১৯৭৯)-এর কথা বলতে পারি। এই সবগুলো ছবিতেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম উঠে এসেছে। আর সেই সংগ্রামের দৃশ্যগুলো ফুটিয়ে তোলার জন্য সত্যিকারের লোকেশনেই ছবিগুলোর শুটিং করা হয়েছিল। না হলে চরিত্রগুলোর মানসিক অবস্থা তুলে ধরা সম্ভব ছিল না। আমি এই ধরনের ছবি ভালোবাসি।
প্রশ্ন : কিন্তু এ ধরনের ছবি করা তো সহজ কথা নয়। ‘অ্যাগুইরে’ ছবির শুটিংয়ের সময় হারজগ এবং ক্লস কিনস্কি এতটাই চাপে ছিলেন যে দুজনের মধ্যে মারামারি লেগে গিয়েছিল। একজন আরেকজনকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন।
ইনারিতু : হ্যাঁ, যখন আপনি সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে যতটা ভেবেছিলেন পরিস্থিতি তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি কঠিন। আমি এই ছবি বানানোর সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম একদম সরল চিন্তা করে। আমি একদমই অন্ধের মতো সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম। প্রতিদিন আরামে থাকার বদলে ঝগড়া করার সুযোগ নিশ্চয়ই আপনি বেছে নেবেন না। এটাই হচ্ছে এই কাজের ধরন। অনেকটা পাহাড়ে চড়ার মতো। আপনি যখন দড়ি ছাড়াই পাহাড়ের মাঝামাঝি চলে যাবেন, তখন আপনাকে ওপরের দিকেই যেতে হবে। কারণ একটা সামান্য ভুলের কারণেও আপনি নিচে পড়ে মারা যেতে পারেন। এভাবেই আমরা প্রতিদিন ছবিটার শুটিং করেছি।
প্রশ্ন : শুনতেই তো ভয়ংকর লাগছে!
ইনারিতু : আমি যে রকম ক্ষ্যাপাটে ধরনের লোক, আসলেই মাঝে মাঝে ভয়ংকর মনে হয়। তবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারত। সবকিছুই খুব সহজে বিগড়ে যেতে পারত। প্রতিদিনই অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু সৃষ্টির আনন্দ তুলনাহীন। আর আপনি এখানে নিজের সৃষ্টিকে বাঁচাতেই কাজ করছেন। আর্থিক দিক থেকেও তো আপনি দায়বদ্ধ। কারণ এ ধরনের উচ্চাভিলাষী কাজ করার ক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগ থাকে। তার মানে আপনি যখন কাজটা করা শুরু করলেন, আপনি নিজের পাতা ফাঁদেই পা দিলেন। কাজটা আপনাকে শেষ করতেই হবে। পিছিয়ে যেতে পারবেন না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই আমি যদি কাজটা শেষ না করি এবং যেভাবে ভেবেছি সেভাবে না করি তাহলে পুরো জিনিসটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এটা অনেকটা ম্যারাথন দৌড়ের মতো, আপনি থামতে পারবেন না। আপনি বুঝতে পারছেন আপনি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন কিন্তু আপনাকে দৌড়টা শেষ করতেই হবে!
প্রশ্ন : আপনার ক্যারিয়ার নিশ্চয়ই আপনার সংসারের জন্য হুমকি?
ইনারিতু : আশা করি নিকট ভবিষ্যতে বিচ্ছেদ হচ্ছে না আমার! (হাসি)। এটা কঠিন ছিল। চলচ্চিত্র আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু দাবি করবে, আপনার জীবন থেকে অনেক কিছু নিয়ে যাবে। যাঁদের আপনাকে দরকার, সেই মানুষগুলোর কাছ থেকে আপনাকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখবে সিনেমা। এটাই এর অন্যতম কঠিন অংশ।
প্রশ্ন : এবং গত বছর ‘বার্ডম্যান’-এর জন্য অস্কার জেতার পরও এ বছর আপনি ‘দ্য রেভেন্যান্ট’-এর শুটিং করেছেন। আপনার কি মনে হয় না, একটা বিরতি নেওয়া দরকার?
ইনারিতু : আমি দুটি ম্যারাথনে দৌঁড়িয়েছি। এখন আমার থামা উচিত। সত্যি বললে, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি ‘বার্ডম্যান’ এর সঙ্গে কী ঘটেছে! এটা খুবই অদ্ভুত একটা পরিস্থিতি এবং আমার মনে হয় কয়েক মাসের জন্য বিশ্রামে যাওয়া উচিত। নিরিবিলিতে ভাবার সুযোগ পেলে আসলে বুঝতে পারব গত দু-আড়াই বছরে আমার জীবনে কী কী ঘটেছে! সাধারণত প্রতিটা ছবি শুরুর আগে আমি মাঝখানে দু-তিন বছরের একটা বিরতি নিই। কারণ আমি যেন এই সময়টায় শুধু নতুন ছবিটা নিয়েই চিন্তাভাবনা করতে পারি। তাই এখন আমি ভাবছি আগামী তিন বছর শুধু বিশ্রাম নেব। আমার আসলেই বিশ্রাম দরকার।
প্রশ্ন : আরনোন মিলশানের মতো বিনিয়োগকারী ছাড়া কি ‘বার্ডম্যান’ বা ‘দ্য রেভেন্যান্ট’-এর মতো উচ্চাবিলাষী ছবি বানানো সম্ভব? এর আগে ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’ এবং ‘ব্রাজিল’-এর মতো ছবিতেও তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন।
ইনারিতু : অবশ্যই। এ রকম ছবি বানাতে হলে তাঁর মতো ইচ্ছাশক্তির মানুষ প্রয়োজন। একই সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট রুচির, শিল্প প্রিয় এবং পাগল। পাগল অবশ্য ভালো কাজের জন্য, ইতিবাচকভাবে। এই গুণগুলো একসঙ্গে না থাকলে এই ধরনের সিনেমা বানানো সম্ভব না।
প্রশ্ন : আর বাকিরা সবাই কি শুধু টাকা নিয়েই চিন্তা করে?
ইনারিতু : এই কারণেই এ ধরনের ছবি কিন্তু বেশি হয় না। কারণ যাঁরা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করেন, তাঁরা বেশির ভাগই চান মুনাফা। আর যখন সবকিছুই মুনাফাকেন্দ্রিক হয়ে যায়, তখন চলচ্চিত্র একটা পণ্য হয়ে ওঠে। আর এ ধরনের মুনাফাকেন্দ্রিক ছবি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কারণ এর প্রচুর দর্শক রয়েছে। আমরা এখন সেই ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেই আছি। শুধুই মুনাফার চিন্তা। তবে আমি বলছি না যে আগে এরকম ছিল না। পরিস্থিতি সব সময়ই এ রকম ছিল তবে এখন আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে।
প্রশ্ন : এ রকম পরিস্থিতিতে কি আপনি ‘দ্য রেভেন্যান্ট’ এর মতো ছবি আবার তৈরি করতে চান?
ইনারিতু : ছবিটি করে আমার কোনো আফসোস নেই। আমার মনে হয়, আমি যার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি, সেই অভিজ্ঞতা মূল্যবান। এর জন্য আমি গর্ববোধ করি। তবে এই কাজ আমি দ্বিতীয়বার করব না (হাসি)। এটা খুব কঠিন ছিল। প্রচণ্ড কঠিন এবং প্রচণ্ড চাহিদাসম্পন্ন কাজ। সত্যি বলতে, এটা টিকে থাকার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছিল। একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে ওই সময়গুলো ছিল প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জিং।
প্রশ্ন : এ রকম কঠিন মুহূর্তে আপনি আশা খুঁজে পেয়েছেন কীভাবে?
ইনারিতু : এ রকম সময়ে আপনি সব বিশ্বাস এবং আশা হারিয়ে ফেলবেন এবং আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনি যেভাবে কাজটা করার স্বপ্ন দেখেছিলেন তা হবে না। কিন্তু তারপরও আপনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন এবং হঠ্যাৎ দেখবেন কোথাও একটা হালকা টোকার মতো পড়বে এবং সব ঝামেলা ধীরে ধীরে মিটে যাবে। এমনকি যে জিনিসগুলো অনেকদিন ধরে আটকে ছিল, সেগুলোও ঠিকভাবে চলা শুরু করবে। যখন কোনো একটা দিনে এমন কঠিন মুহূর্ত আসে যে আপনি হতাশায় ডুবে যাচ্ছেন, আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, কিছুই আপনার মন মতো হচ্ছে না- এ রকম মুহূর্তেও কখনোই হাল ছেড়ে দেবেন না- এরপরই দেখবেন হঠাৎ আবার আপনার মতো করে কাজগুলো হওয়া শুরু করবে। এটা প্রায় একটা অলৌকিক ব্যাপার।