জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
কথাশিল্পের অমূল্য মানিক
বাংলা কথাশিল্পের অমূল্য রতন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ( জন্ম ১৯ মে ১৯০৮, মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ১৯৫৬) জীবনও ছিল গল্প-উপন্যাসের মতোই, নাটক কী নয়! পঞ্চাশ পৌঁছুনোর আগেই প্রস্থান। অকালপ্রয়াত গুণী জীবনশিল্পীদের ভেতর তাঁর নামই সর্বাগ্রে উচ্চারিত। নিয়তিনির্দিষ্ট ছিল কি তাঁর জীবন? ‘কলম পেষার পেশা’ বেছে নেবেন এবং দারিদ্র্য হবে তাঁর চিরসঙ্গী এ যেন ছিল অনিবার্য। শুরুটাও তো নাটকীয়তার চূড়ান্ত। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরে গল্প লিখে ফেলা এবং অচিরেই নামি পত্রিকায় সে গল্প প্রকাশের মাধ্যমে বাজিতে জেতা। অর্থাৎ নিজের লেখনিশক্তির বিষয়ে ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। গোটা জীবনে বছর চারেক চাকরির সীমাবদ্ধতায় বাঁধা পড়েছিলেন, বাকিটা ওই কলম পেষার পেশায়। লিখলে টাকা মিলবে, আর সেই টাকাই একমাত্র জীবিকা এমন একটি নিয়মের ভেতর জীবনযাপন এক ধরনের বাধ্যতামূলকই বলা চলে। কাজটা তিনি পারেন, এ-কাজ তাঁর পছন্দনীয়। তাই লগ্ন ও লিপ্ত ছিলেন গল্প-উপন্যাস রচনায়। তবে জীবনের শেষ ধাপে পৌঁছে সুরাসক্তি নির্ভরতার পর্যায়ে গিয়ে গড়ায়। না পান করলে কলমও চলবে না এজাতীয় ভাবনার বশবর্তী হওয়ায় সাংসারিক অশান্তি এড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার ওপর ছিল তাঁর মৃগীব্যাধি। সেটাও ছিল কষ্টকর। তবে লাভ হয়েছে পাঠকদের। জীবন দিয়ে এবং জীবন নিংড়ে যা রচনা করে গেছেন তার সিংহভাগই হয়ে উঠেছে চিরকালীন সম্পদ।
প্রাণান্তকর পরিশ্রম, পরিবারের মানুষের ঔদাসীন্য (লক্ষণীয় মানিকের পিতার অন্তিমকাল কেটেছে মানিকেরই ভাড়া করা বাসায়; অন্য ভাইয়েরা পিতার দায়িত্ব নেননি), বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক ১৯৩৫-৩৬ সালের কোনো এক সময়ে তিনি মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৩৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে লেখা চিঠিতে তিনি দাদাকে জানাচ্ছেন, ‘আমি প্রায় দুই বৎসর হইল মাথার অসুখে ভুগিতেছি, মাঝে মাঝে অজ্ঞান হইয়া যাই।’ কিন্তু এই মৃগীরোগ সাহিত্যিক সত্তার সংকটের কারণ নিশ্চয়ই হয়ে ওঠেনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, এই ব্যাধির আক্রমণ শুরু হওয়ার পরও তিনি জীবনের জটিলতা (১৯৩৬), শহরতলী (১৯৪০-৪১), চিন্তামণি (১৯৪৬), চিহ্ন (১৯৪৭)-এর মতো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস লিখেছেন। এমন কি হতে পারে না এই রোগের কল্যাণে তিনি অর্জন করেছিলেন এক উদ্ভট অন্তর্দৃষ্টি, যা অন্য উপায়ে আয়ত্ত করা ছিল অসম্ভব? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এই মৃগীরোগ সংক্রান্ত নোটে লিখেছেন, এই রোগে আক্রমণের পরিণাম ‘এক্সেসিস অ্যাবিলিটি ফর ফাইন অ্যানালাইসিস অ্যান্ড এক্সট্রাঅর্ডিনারি ইমাজিনেশন’। প্রশ্ন হচ্ছে মানবচরিত্র বিশ্লেষণে বিশেষ সক্ষমতা এবং অসাধারণ কল্পনাশক্তি এটা কি আমরা মানিকের মধ্যে আগে পাইনি? লক্ষণীয় যে স্নাতক পর্যায়ে বিজ্ঞানে অধ্যয়ণকারী মানিক নিজের রোগ নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করেছেন এবং একপর্যায়ে নিজের ওষুধ নিজেই তৈরি করেন।
সে যাক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘজীবন পাননি, কিংবা এভাবেও বলতে পারি শরীরের ওপর অতিরিক্ত চাপ এবং ব্যাধির প্রকোপ তাঁর আয়ুকে নিষ্ঠুরভাবে কর্তন করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় এ কথা ভেবে যে স্বল্পায়ু নিয়ে দীর্ঘজীবন লাভকারী সাহিত্যিকের তুলনায় নিতান্ত কম লিখে যাননি তিনি। বরং বলতে প্রলুব্ধ হচ্ছি, তিনি এত বিপুল লিখেছেন যে তাঁর লেখার শ্রম এবং সৃষ্টিশীলতা সর্বকালের যেকোনো সাহিত্যিকের কাছেই অবাক করা এবং ঈর্ষণীয় ব্যাপার। জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে ঊনচল্লিশটি উপন্যাস, ষোলখানা গল্পগ্রন্থ এবং একটি নাটক। এ ছাড়া বহু সংকলন এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রায় দুই শতাধিক গল্প প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রয়াণের পর প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র প্রবন্ধগ্রন্থ ‘লেখকের কথা’ এবং ছোটদের জন্য দুটি সংকলন। তরুণ বয়সে বেশ কিছু কবিতাও লিখেছিলেন।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয় সে-কবিতার সংগ্রহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা শিরোনামে। তাঁর দুটি উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ এবং ‘পদ্মানদীর মাঝি’ চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য সিনেমা কোম্পানি আগ্রহী হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তিনি। বলাবাহুল্য এ দুটি উপন্যাসই বহুল পঠিত এবং এখনও তাঁর যেসব রচনার প্রতি পাঠকের কৌতূহল রয়েছে তার ভেতর সর্বাগ্রে এ দুটি উপন্যাসের নামই চলে আসে। আমাদের তাত্ত্বিক সাহিত্য সমালোচক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও মানিকের সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বেছে নেন এ দুটি উপন্যাসকেই। তবে তাঁর বিশ্লেষণ একেবারে স্বতন্ত্র, মৌলিক ভাবনার উদ্রেককারী বললেও অত্যুক্তি হবে না। সমাজের শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত শ্রেণীর জীবনচিত্র উঠে আসা এ দুটি উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলোকে সিরাজুল ইসলাম বলছেন ‘কবি’।
‘পুতুলনাচ’ ও ‘পদ্মানদী’ শীর্ষক রচনার একটি গোটা স্তবক উদ্ধৃত করছি। তিনি বলছেন, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রেরা যেমন বন্দি তেমনি চঞ্চল মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। তাঁর সকল প্রধান চরিত্রই কবি। শিশুর উপস্থিতি লক্ষ করবার মতো নয় এই দুই উপন্যাসে। কিন্তু ঔপন্যাসিক লক্ষ করেছেন যে, “সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামিকে লইয়া সময়ে অসময়ে এমনিভাবে লেখালেখি করিতে ভালোবাসে।” এই খোকাকে ভালোবাসেন লেখক, ভালোবেসে তাকে প্রশ্রয় দেন, খেলা করতে দেন সে যতটা পারে। সেই জন্য দেখি মানুষগুলো প্রসারতা চায়, বিস্তৃতি কেবলই খোঁজে মানস-ভ্রমণের সুযোগ। শশী, অসংখ্য অলক্ষ্য বন্ধনে গাওদিয়ার সঙ্গে জড়িত শশী, মনের গঠনে যে স্বভাবতই গ্রাম্য, ধনসম্পদে যাঁর মমতা বংশানুক্রমিক, তার মধ্যেও “কল্পনা ভাবাবেগ ও রসবোধের অভাব নাই।” কিন্তু “তাহার কল্পনার অংশটুকু গোপন, মূক। অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর সঙ্গে না মিশিলে এ কথা কেহ টের পাইবে না যে তারও ভিতরে জীবনের সৌন্দর্য ও শ্রীহীনতার একটি সহানুভূতিসম্পন্ন বিচারপদ্ধতি আছে।” লেখক মিশেছেন ঘনিষ্ঠভাবে, জানিয়েছেন সেই কল্পনার খবর। কিন্তু যে-ভাষায় জানিয়েছেন তা অতিশয়োক্তি বিরহিত। কেননা কল্পনার সে অংশটুকু গোপন ও মূক। শশীর মতো অন্য মানুষগুলোও কবি, গোপনে। পদ্মানদীর মাঝি কুবেরও। কুবেরের স্ত্রী পঙ্গু, কন্যা পঙ্গু, পঙ্গু তার জীবন, কিন্তু তবু তার জীবনে প্রেম আছে, আসক্তি আছে ছলনাময়ী কপিলাতে, যে তার শ্যালিকা, সামাজিক পরিচয়ে এবং যখন জাল এসেছে চতুর্দিক আরো শক্ত হয়ে, পুলিশ এসেছে ধরতে তাকে , যখন পালাতে হচ্ছে ময়নাদ্বীপে, তখন সে সঙ্গে নিচ্ছে কপিলাকে। সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে তার উক্তি অবিস্মরণীয় “হ, কপিলা চলুক সঙ্গে । একা এত দূরে কুবের পাড়ি দিতে পারব না।” সেইখানেই মুক্তি, সেই ভালোবাসায়।’
লক্ষণীয় হলো ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি তাঁর বেঁচে থাকার সময়েই মঞ্চস্থ হয়। আজও এ গল্প নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে। তাঁর আরো একটি গল্প বহুল পঠিত অতসী মামী। যে দুটি উপন্যাস ও দু’টি গল্পের নাম বলা হলোএই চারটি সাহিত্যকর্মও যদি পাঠ করেন আজকের নবীন পাঠক তাহলেও বাংলা ভাষার কালজয়ী সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবদানের উচ্চতা সম্পর্কে যথার্থ ধারণালাভ সম্ভব। ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটি আমাদের জানিয়ে দেয় সভ্যতার জ্যোতির্ময় আলোর সাধনা সত্ত্বেও বর্বর যুগের আদিম অন্ধকার এখনো ধারাবাহিকতায় মানবজীবনকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করছে।
বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনা করতে আসা সমাজসচেতন লেখকমাত্রই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ঋণ স্বীকার করবেন। সেইসঙ্গে এও অনুধাবনে সমর্থ হবেন যে স্থায়ী কোনো সাহিত্যকর্ম সৃজন করতে হলে সমগ্র জীবনই তাতে ব্যয় করতে হয়। আজ তাঁর জন্মবার্ষিকীতে আমরা যেমন তাঁকে প্রণতি জানাই, তেমনি এটাও প্রত্যাশা করি, তাঁর হার না-মানা একাগ্রতার কাছ থেকে শক্তি নিয়ে আগামীতে জন্ম হোক নতুন কোনো কথাশিল্পীর। যাঁর কলম প্রকৃতার্থেই ধারণ করবে বাঙালির অতীতকাল-সমকালের সংগ্রাম ও গৌরবের শাঁসটুকু।