অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার
'নারীদের যোগ্যতার সুবিচার করতে হবে'
এ দেশের নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত নূরজাহান বেগম। একই সঙ্গে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক। ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের মেয়ে। মা ফাতেমা বেগম ছিলেন গৃহিণী। ১৯২৫ সালের ৪ জুন চাঁদপুরের চালিতাতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ‘বেগম’ পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে এর সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত। তাঁর হাত ধরে উঠে এসেছে বহু লেখক। এই পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবেই মূলত তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেছেন বহু সম্মাননা। আজ ২৩ মে, ৯১ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহীয়সী নারী। মৃত্যুর আগে কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ ছিলেন তিনি। চোখেও ঠিকমতো দেখতে পেতেন না। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর শৈশব-কৈশোর, কলকাতার নানা স্মৃতি, খ্যাতিমান মানুষদের সান্নিধ্য, ‘বেগম’ পত্রিকার শুরুর কথা, জীবনের নানা প্রসঙ্গ, বর্তমান প্রজন্ম, নারী উন্নয়ন, সমাজ ও রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে। ২০১১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান।
স্বকৃত নোমান : আপনার জন্মগ্রাম চালিতাতলী সম্পর্কে জানতে চাই। আপনার বাবা নাসিরউদ্দীন কি ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা? পূর্বপুরুষরা আগে কোথায় ছিলেন?
নূরজাহান বেগম : আমার বাবার আদিনিবাস ছিল তৎকালীন ত্রিপুরার চাঁদপুর মহকুমার অন্তর্গত পাইকারদী গ্রামে। এই গ্রামটি অনেক বছর আগে মেঘনার গর্ভে হারিয়ে গেছে। আমার দাদা আবদুর রহমান ছিলেন সাধারণ গৃহস্থ। তিনি বাংলা ভাষার খুব অনুরাগী ছিলেন। কুমিল্লার আঞ্চলিক ভাষায় তিনি কবিতা রচনা করে আসরে পুঁথির সুরে তা পড়তেন। এ ছাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষের হিসাবপত্র, জায়গা-জমির মাপ ঠিকঠাক করে দিতেন। শুভংকরের অঙ্কও তিনি ভালো জানতেন। প্রতি সন্ধ্যায় গ্রামের বিচারের মজলিসে অংশ নিতেন। তাঁর চার সন্তানের মধ্যে আমার আব্বা ছিলেন প্রথম।
স্বকৃত নোমান : শুনেছি ছোটবেলায় আপনার অনেক ডাকনাম ছিল। পরবর্তীকালে নূরজাহান বেগম নামটি কে রেখেছিলেন?
নূরজাহান বেগম : ছোটবেলায় আমার বাবা-মা, ভাইবোনরা আমাকে নূরী নামে ডাকত। বাল্যবন্ধুরা ডাকত মালেকা। চাচিরা ডাকতেন নুরুননেছা বলে। আর স্কুলে ভর্তি করানোর সময় বাবা আমার নাম রাখলেন নুরুন্নাহার। একবার আমার নানি কলকাতায় বেড়াতে এসে আমাকে দেখে খুব মুগ্ধ হলেন। তিনিই আমার নাম রাখলেন নূরজাহান বেগম।
স্বকৃত নোমান : ছোটবেলায় কেমন প্রকৃতির ছিলেন? শৈশবের দিনগুলো কোথায় কেটেছে?
নূরজাহান বেগম : ছোটবেলায় আমি খানিকটা চঞ্চল প্রকৃতির ছিলাম। আমাকে সামাল দিতে আমার মা, চাচা, চাচি, মামা, দাদি, নানা, নানিকে খুব হিমশিম খেতে হতো। শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে চালিতাতলীতে, আর বেশির ভাগ সময় কেটেছে কলকাতায়। চালিতাতলীতে থাকাবস্থায় আমি ছুটে বেড়াতাম গ্রামের মাঠে-ঘাটে, পুকুর-নদী আর খালের পাড়ে। একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটল। দৌড়াতে গিয়ে পুকুরে পড়ে গেলাম। আশপাশের লোকজন দ্রুত আমাকে পানি থেকে তুলে আনল। আরেকদিন খালপাড় দিয়ে দৌড়ে যেতে গিয়ে খালে পড়ে গেলাম। এবারও সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে পানি থেকে টেনে তুলল আমাকে। এভাবে দু-বার বিপদের হাত থেকে বেঁচে যাই। তখন আমি খুব ছোট, তিন বছর বয়স হবে বুঝি। এ দুটি ঘটনায় বাবা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। এ কারণে মাও আমাকে কলকাতায় নিয়ে যান তিনি। যতদূর মনে পড়ে, ১৯২৯ সালের দিকে আমার মামা ইয়াকুব আলী শেখ আমাদের কলকাতায় বাবার বাসায় নিয়ে যান। গ্রামের বাড়ি থেকে ওখানে যাওয়ার পর বাবা আমাকে কলকাতার সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার জন্য তৈরি করতে লাগলেন। স্যাকরার দোকানে নিয়ে গিয়ে আমার নাকের ফুল কাটালেন। এরপর একদিন আমাকে কোলে করে সেলুনে নিয়ে গিয়ে লম্বা চুল কাটিয়ে চায়না ববকাট করালেন।
স্বকৃত নোমান : বাসা কলকাতার কোথায় ছিল? আপনার আব্বা কী করতেন সেখানে?
নূরজাহান বেগম : আমাদের বাসা ছিল ১১ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। ওখানকার একটি দোতলা বাড়িই ছিল আব্বার সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিস। ‘সওগাত’ পত্রিকা প্রকাশের আগে বাবা সেখানে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
স্বকৃত নোমান : আপনার বেড়ে ওঠার পেছনে কার ভূমিকা বেশি ছিল, বাবা নাকি মায়ের?
নূরজাহান বেগম : দুজনেরই ভূমিকা ছিল। আমার পারিবারিক জীবন ছিল খুবই সুখের এবং আনন্দময়। প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত বাবার স্নেহ-ছায়ায় বেড়ে ওঠেছি আমি। তাঁর স্নেহের ছায়ায় বেড়ে ওঠায় আমার চিন্তাভাবনায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। মা ফাতেমা খাতুনের সার্বক্ষণিক সাহচর্য, চিন্তাচেতনা, জীবনবোধ আমার ওপর খুব প্রভাব ফেলে। আমি তাঁদের একমাত্র সন্তান হওয়ার কারণে দুজনের আদর-সোহাগে বেড়ে উঠেছি।
স্বকৃত নোমান : আমার জানামতে, আপনার আব্বার সুবাদে অনেক খ্যাতিমান মানুষদের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আপনার। তাঁদের সম্পর্কে যদি বলেন...।
নূরজাহান বেগম : কলকাতায় আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়ির নিচতলায় থাকত এক ইংরেজ পরিবার। ওই দম্পতির দুটি সন্তান ছিল। একজনের নাম লডেন অন্যজনের নাম টিটু। ওদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠল। কিন্তু ওদের কথাবার্তা আমি ঠিক বুঝতাম না। পরে তাদের কাছ থেকেই আমি ইংরেজিতে কথা বলাটা শিখতে শুরু করি। একই বাড়িতে থাকতেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর সঙ্গে এ বাড়িতেই প্রথম দেখা হয়েছিল আমার। তিনি যখন লেখায় গভীর মগ্ন, তখন অনেক সময় আমার মা আমাকে দিয়ে তাঁর জন্য চা পাঠিয়ে দিতেন। একদিনের ঘটনা মনে আছে। আমি জানালায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিলাম। এমন সময় আমাদের বাড়ির সামনে গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়ি এসে থামল। সেই গাড়িতে চড়ে বসলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেদিন এলবার্ট হলে তাঁর সংবর্ধনা ছিল। আমার আব্বাই সেই সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। সংবর্ধনা শেষে নজরুল বাড়ি ফিরলেন সোনার দোয়াত কলম, ভেলভেটের থলেতে মোহর ও আরো কিছু উপহার নিয়ে। ওগুলো তিনি আমাকেই উপহার দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বাসায় প্রায়ই বিকেলে ও রাতে সাহিত্যের আড্ডা বসত। আড্ডায় আসতেন কবি খান মঈনুদ্দীন, আবুল ফজল, ওয়াজেদ আলী, ইব্রাহিম খাঁ, আবুল মনসুর আহমেদ, এম ওয়াজেদ আলী বার এট ল ও তাঁর মেয়ে মিরর পত্রিকার সম্পাদক। নামটা মনে নেই। এ ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার কলকাতায় এলেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। তিনি আমাকে নূরী বলে ডাকতেন। কাছে ডেকে মজা করে বলতেন, ‘দেখ নূরী আমার দাঁত পাখি নিয়ে গেছে।’ আমি তখন ছোট ছিলাম বলে তিনি যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতাম। তা ছাড়া আব্বার অফিসে প্রতিদিনই বহু গুণী-জ্ঞানীরা আসতেন। নিয়মিত সাহিত্য মজলিস বসত সেখানে। সেই মজলিসে যোগ দিতে দিতেই আমার জানা-শোনার পরিধি বাড়তে থাকে।
স্বকৃত নোমান : শৈশবে কলকাতার উল্লেখযোগ্য কোনো স্মৃতি কি মনে আছে?
নূরজাহান বেগম : কিছু কিছু মনে আছে। ছোটবেলায় মা আমাকে কাপড় দিয়ে সুন্দর সুন্দর পুতুল বানিয়ে দিতেন। আমি পুতুলগুলো নিয়ে খেলতাম। তখন আমার প্রিয় খাবার ছিল চকলেট। সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ব্রিটেনের তৈরি টাকা চকলেট। এই চকলেট খাবার জন্য বাবার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যাওয়ার বায়না ধরতাম। মাঝে মাঝে বাবা আমাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতেন, আবার কখনো বিরক্তও হতেন। মনে আছে, আমাদের বাড়ির বিপরীত দিকের এক জমিদারবাড়িতে একটা হনুমান থাকত। দিনের বেলায় সে এবাড়ি-ওবাড়ি লাফিয়ে বেড়াত, আর রাতের বেলায় আমাদের ছাদের ওপর এসে ধুপধাপ আওয়াজ করত। ভয়ে আমার ঘুম আসত না। ওর জন্য কোথাও কোনো খাবার রাখার উপায় ছিল না। কোন ফাঁকে যে হনুমানটা এসে সব নিয়ে যেত বা নষ্ট করে ফেলত, কেউ টের পেত না। এক ঈদের দিন আমার মা অনেক মজার মজার খাবার তৈরি করেছিলেন, অথচ হনুমান এসে সব নষ্ট করে দিল। একদিন জমিদারবাড়িতে এ ব্যাপারে নালিশ করা হলো। তাঁরা হনুমানটাকে পাঠিয়ে দিলেন চিড়িয়াখানায়। ওটা চলে যাওয়ায় আমার সাহস বেড়ে গেল। একদিন বাবা যখন অফিসে আর মা রান্নাঘরে, তখন আমি লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছিলাম, হঠাৎ দেখতে পাই সিঁড়ির অন্ধকার কোণায় দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে চেয়ে আছে। ভয়ে আমি চিৎকার করতে করতে সিঁড়িতে পড়ে যাই। পরে দেখলাম ওটা একটি কালো বেড়াল। এ রকম বহু স্মৃতি আছে আমার। বয়স হয়েছে এখন, অনেক কিছু ভুলে গেছি।
স্বকৃত নোমান : আপনার লেখাপড়ার হাতেখাড়ি কার কাছে হয়েছিল?
নূরজাহান বেগম : লেখাপড়ার প্রথম হাতেখড়ি হয় মায়ের হাতে। একদিন মা আমার হাত ধরে নতুন স্লেটের ওপর পেনসিল দিয়ে লিখলেন অ-আ-ই-ঈ। মায়ের হাত ধরে এভাবেই আমি আদর্শলিপি লিখতে শুরু করি। একই দিনে বাবাও আমাকে আরবি পড়ার হাতেখড়ি দিলেন। শেখালেন আলিফ-বে-তে-সে। সেই সঙ্গে ইংরেজি এ-বি-সি-ডি। অবসর সময়ে মা আমাকে কবিতা, ছড়া, আরবি সুরা শেখাতেন। আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে শিখতাম। বাবা আমার জন্য নিয়ে আসতেন অনেক পত্রপত্রিকা। যদিও আমি তখনো তেমন পড়তে শিখিনি। কিন্তু তবুও আগ্রহভরে পত্রপত্রিকাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতাম। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনটি ছিল আমার খুবই প্রিয়। এখানে আমি মজার মজার ছবি, প্রজাপতি, ফুল আর নানা ধরনের জীবজন্তুর ছবির সঙ্গে পরিচিত হই। এভাবে ছবি দেখতে দেখতে পত্রপত্রিকা ফাইলিং করা শিখে ফেললাম আমি। চকের গুঁড়ো ঘষে ঘষে ব্লক থেকে ছবি বের করে বাবার চাহিদামতো তাঁর হাতে তুলে দিতাম।
স্বকৃত নোমান : প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা কোন স্কুল থেকে শুরু হয়েছিল?
নূরজাহান বেগম : বাবা আমাকে প্রথমে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রতিষ্ঠিত ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাই স্কুলে’ শিশু শ্রেণিতে ভর্তি করালেন। প্রার্থনা সংগীত ও দোয়া পড়ে আমার বিদ্যালয়ের পাঠ শুরু। এরপর সকাল ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত চলত একটানা ক্লাস। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে টিফিন খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার ক্লাস করতাম। হাসি, আনন্দ, খেলার মধ্যদিয়েই বিদ্যালয়ে সব কিছু শিখি আমি। পড়ালেখা ছাড়াও ছিল ছবি আঁকার জন্য আলাদা ক্লাস। আর ছবির ওপর বিভিন্ন রং বা পুঁতি বসানোর কাজ, কখনো নানা ছবির টুকরো একসঙ্গে জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করা শেখানো হতো। বেলা ৪টায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাসে চড়ে বাড়ি ফিরতাম।
স্বকৃত নোমান : এই স্কুলে কত বছর পড়েছিলেন? ছাত্রী হিসেবে কেমন ছিলেন তখন?
নূরজাহান বেগম : শিশু শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করি। ছাত্রী হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম বলা যাবে না। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আরবি, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু এই চার ভাষায় পড়ানো হতো। তবে এই স্কুলে পড়ালেখার খুব চাপ ছিল। তাই বাবা আমাকে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে এনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন বেলতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখানে আমি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ি। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিতে আবার আগের স্কুলেই ভর্তি করানো হলো। স্কুলটি তখন খুব ভালো স্কুল ছিল। ১৭ নম্বর লর্ড সিনহা রোডের তিনতলা একটি ভবনে অবস্থিত ছিল স্কুলটি।
স্বকৃত নোমান : স্কুলে পড়ার সময়ও কি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতেন?
নূরজাহান বেগম : হ্যাঁ, তখন থেকেই আমার ভেতরে এসব ব্যাপারে আগ্রহ জন্মায়। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর আমি স্কুলের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি। ক্লাসে নাইটিংগেল, মাদামকুরি ইত্যাদি নামের দল ছিল। এদের কাজ ছিল শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যারা অংশগ্রহণ করবে, তাদের তদারকি করা। এখানে আমি অংশগ্রহণ করতাম। পড়ালেখার পাশাপাশি গানবাজনা, নাটক, রান্না, সেলাই, ছবি আঁকা, খেলাধুলা সবকিছুতেই অংশ নিতাম।
স্বকৃত নোমান : এ স্কুল থেকেই তো ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন?
নূরজাহান বেগম : ক্লাস এইট থেকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করি। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। এরপর আইএ ভর্তি হলাম কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। আইএতে পড়ার বিষয় ছিল দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল।
স্বকৃত নোমান : কলেজে আপনার সহপাঠীদের কথা কি মনে আছে? তাদের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক ছিল আপনার?
নূরজাহান বেগম : হ্যাঁ, আছে। আমার সহপাঠীদের মধ্যে ছিল সাবেরা আহসান ডলি, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোৎস্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ, জাহানারা ইমাম প্রমুখ। তাদের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল আমার। সবাই মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল গঠন করেছিলাম। কলেজে কবিতা আবৃত্তি, নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা এবং অভিনয় করে বেশ সুনাম অর্জন করেছিলাম। ‘মেঘদূত’ নাটকে নাচের মাধ্যমে মেঘের গতিবিধি তুলে অভিনয় দেখে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা প্রশংসা করেছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি কলেজে খেলাধুলার ব্যবস্থাও ছিল। আমার পছন্দের খেলা ছিল ব্যান্ডমিন্টন। সময় পেলেই ব্যান্ডমিন্টন খেলতাম। লেডি ব্রেবোর্ন থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ পাস করে বিএ-তে ভর্তি হই। এই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে আমি বিএ পাস করি।
স্বকৃত নোমান : আপনার বাবা কর্তৃক সম্পাদিত ‘সওগাত’-পত্রিকাটির মাধ্যমে তো তখন নারীদেরও লেখালেখির ব্যাপারে উৎসাহ জুগিয়েছিল?
নূরজাহান বেগম : হ্যাঁ। বাবা ১৯২৭ সালে মাসিক সওগাতে ‘জানানা মহল’ নামে প্রথম মহিলাদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। কিন্তু বাঙালি মুসলমান মেয়েরা বিভাগটি টিকিয়ে রাখতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। মেয়েদের এগিয়ে না আসার কারণে বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মেয়েদের লেখা দিয়ে বছরে একবার ‘সওগাত’-এর একটি সংখ্যা বের করবেন। এরই প্রেক্ষাপটে তিনি মেয়েদের ছবি দিয়ে ১৯২৯ সালে মহিলা সংখ্যা ‘সওগাত’ প্রকাশ করেন। এই সংখ্যাটি বের করতে আব্বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের কাছ থেকে লেখা ও ছবি সংগ্রহ করতেন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ‘সওগাত’ মহিলা সংখ্যা বছরে মাত্র একটা করে প্রকাশ করা হয়। এসব প্রকাশনার সঙ্গে আমি সব সময়ই বাবার পাশে থেকেছি। কবি সুফিয়া কামালও সওগাত-এর মহিলা সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
স্বকৃত নোমান : কত সালে ‘বেগম’ পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল? কখন থেকে আপনি এর সঙ্গে যুক্ত হলেন?
নূরজাহান বেগম : বাবার উদ্যোগেই ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই প্রথম ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এর কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িতে। আমি যখন বিএ পড়ি, তখন আমার বন্ধু-বান্ধবরা মিলে ‘বেগম’ পত্রিকায় কাজ করতাম। বিএ পরীক্ষা শেষ হলে ‘সওগাত’ পত্রিকার সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করলাম। কবি সুফিয়া কামাল প্রথম চার মাস এটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুরু থেকেই আমি পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলাম।
স্বকৃত নোমান : সেই সময় ‘বেগম’ পত্রিকায় কোন বিষয়গুলো স্থান পেত?
নূরজাহান বেগম : নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামে-গঞ্জের নির্যাতিত মহিলাদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং মনীষীদের জ্ঞানগর্ভ বাণী ইত্যাদি বিষয় থাকত পত্রিকাটিতে।
স্বকৃত নোমান : দীর্ঘদিন ‘বেগম’ সম্পাদনা করলেন। পত্রিকাটি চালাতে গিয়ে শুরুর দিকে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
নূরজাহান বেগম : সমস্যা অনেক ছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না থাকায় লেখা সংগ্রহ করাও ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ঘরে বসেই ফোনের মাধ্যমে লেখা সংগ্রহ করতে হতো। সুফিয়া কামাল মাঝেমধ্যে এসে দু-চারটি লেখা সংগ্রহ করে দিতেন। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন হিন্দু-মুসলমান লেখিকাদের মিলিত চেষ্টায় পত্রিকাটি চালাবেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হিন্দু লেখিকাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে পত্রিকায় প্রতি সংখ্যায় বিভাগ অনুযায়ী একাধিক নিবন্ধ, প্রবন্ধ, প্রতিবেদন দরকার। বাবা আমাকে বিভিন্ন ইংরেজি পত্রপত্রিকা থেকে প্রতিবেদনগুলো অনুবাদ করে ছাপানোর পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আমি ইংরেজি পত্রিকার প্রতিবেদনগুলো আমাদের প্রয়োজনমতো সহজ-সরল ভাষায় অনুবাদ করে ‘বেগম’ পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলাম। এতে লেখা সংগ্রহের সমস্যা কিছুটা হলেও নিরসন হলো। এ ছাড়া পত্রিকাটি বের করতে গিয়ে অর্থনৈতিক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তবে ‘বেগম’-এর উদ্দেশ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
স্বকৃত নোমান : উদ্দেশ্যের কথা বললেন। ‘বেগম’ পত্রিকাটি বের করার পেছনে কি নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল? নাকি বাবার প্রভাবেই এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া?
নূরজাহান বেগম : বাবার প্রভাব তো ছিলই। তিনিই তো এর প্রতিষ্ঠাতা। পাশাপাশি আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও ছিল। যেমন নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীকে উৎসাহী করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য।
স্বকৃত নোমান : শুরুর দিকে কি আপনি একাই কাজ করতেন, নাকি আপনার সহযোগী ছিলেন কেউ?
নূরজাহান বেগম : ওই যে বললাম, আমার কলেজের বান্ধবীরা মিলে কাজ করতাম। আমি সম্পাদনার পুরোপুরি দায়িত্ব নেওয়ার পর লেখিকা মোতাহেরা বানুর দুই মেয়ে তাহমিনা বানু ও নাসিমা বানুকে ‘বেগম’ পত্রিকায় কাজ করার জন্য ডাকলাম। তখন তারা পড়াশোনা শেষ করে ঘরে বেকার বসে আছে। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে দুই বোন ‘বেগম’ পত্রিকায় যোগ দিল। পত্রিকার বিভাগগুলো আমরা তিনজনে মিলে ভাগ করে নিলাম। তবে শুরুর দিকে আমি পত্রিকাটির দায়িত্ব পেলেও বাবার তত্ত্বাবধানেই কিন্তু এটি পরিচালিত হতো।
স্বকৃত নোমান : কত সালে ঢাকায় এলেন?
নূরজাহান বেগম : ১৯৫০ সালে।
স্বকৃত নোমান : রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের সঙ্গে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল?
নূরজাহান বেগম : ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। ১৯৫২ সালে তাঁর সঙ্গে বিয়ে হলো। বিয়ের পর আমি বাবার কাছেই ছিলাম। তোমাদের দাদা ভাইয়ের উৎসাহেই আমার কাজের গতি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি ধাপে সব সময় তাঁর সহযোগিতা পেয়েছি আমি। তিনি সত্যিকারার্থে একজন উদারচেতা মানুষ ছিলেন। সাহিত্য-সংস্কৃতি ভালোবাসতেন মনেপ্রাণে।
স্বকৃত নোমান : বেগম ক্লাব কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
নূরজাহান বেগম : ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বেগম ক্লাব’ যাত্রা শুরু করে। এর প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, আর আমি সাধারণ সম্পাদক। সুফিয়া কামাল ছিলেন ক্লাবের উপদেষ্টা।
স্বকৃত নোমান : ক্লাবটি প্রতিষ্ঠার পেছনে কী লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল?
নূরজাহান বেগম : বাংলার মহিলা সমাজের উন্নয়নের জন্য এ পর্যন্ত ‘বেগম’ যা কিছু করেছে, তা প্রায় সবারই জানা। ‘বেগম’-এর সেবাব্রতকে আরো সুদূরপ্রসারী করার জন্য, পত্রিকাটির লেখিকা, পৃষ্ঠপোষক ও অন্যান্য সাহিত্যিকদের সমন্বয়ে একটি সমিতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি আমরা। নারীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের কাজ চালানোর জন্য একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। এই সমিতির মাধ্যমে আমরা একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ও উৎসবগুলো উদযাপন করতে পারব, অপরদিকে সংঘবদ্ধভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের কথাও চিন্তা করতে পারব। আমাদের সম্মিলিত চেষ্টার মাধ্যমে শক্তিশালী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হবে- এমন পরিকল্পনা থেকেই এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা।
স্বকৃত নোমান : ক্লাব চালাতে গিয়ে কি কোনো বাধার মুখে পড়েছিলেন?
নূরজাহান বেগম : বাধা তো ছিলই। সমাজ তো তখন আজকের মতো এতটা আধুনিক ছিল না। প্রথমে একটি টিনশেডের ঘরে ‘বেগম ক্লাবে’র কাজ শুরু হয়। তখন এর আসনসংখ্যা ছিল পঁচাত্তর থেকে আশিজনের। প্রথম অবস্থায় শুধুমাত্র সাহিত্য বা অন্য নানা বিষয় আলোচনা চললেও পরে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। আমি নিজে সংগীত শিল্পী হুসনা বানু ও লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সঙ্গে দেখা করি। তাঁদের দুজনকে সাংস্কৃতিক বিভাগের দায়িত্ব দিলাম। তাঁদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অন্য নারী শিল্পীদের অভিভাবকরাও বেগম ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেয়েদের আসতে বাধা দিতেন না। দেশের বরেণ্য সমাজকর্মী ও শিল্পীরাও নিজ উৎসাহে বেগম ক্লাবে যোগ দিলেন। সেই সঙ্গে যোগ দেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য রাজিয়া বানু, আশালতা সেন, দৌলতুন নেসাসহ আরো অনেকে।
স্বকৃত নোমান : আপনি যখন তরুণী ছিলেন তখন তো ভারতীয় উপমহাদেশে নারীদের অতটা স্বাধীনতা ছিল না। বর্তমানের নারীদের অনেক উন্নতি হয়েছে। এই পরিবর্তন কি আপনাকে আনন্দ দেয়?
নূরজাহান বেগম : নিঃসন্দেহে আনন্দ দেয়। দেশে এখন প্রচুর মেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। মেয়েরা এখন প্রায়ই পড়ালেখার জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তারা দেশে ফিরছে। তারপরও আমার মনে হয় নারীকে আরো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক যে মনোভাব সেটা পরিহার করতে হবে। তাহলে সামাজিক উন্নয়ন দ্রুত ঘটবে। নারীদের যোগ্যতার সুবিচার করতে হবে।
স্বকৃত নোমান : স্বাধীনতার ৪০ বছর হয়ে গেল। বাঙালি যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তা কি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন? না হলে কেন হলো না?
নূরজাহান বেগম : বাস্তবায়ন তো হয়েছে। সবচেয়ে বড় বাস্তবায়ন বা পরিবর্তন হলো- আমরা একটি দেশ পেয়েছি। এর চেয়ে বড় পরিবর্তন তো আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, যেমন একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, সকল মানুষের সম-অধিকার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা- এসব জায়গাগুলোতে দুর্বলতা রয়ে গেছে। এই সমস্যাগুলো দূর করতে যে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একটি জাতি তার নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিল, সেই যাত্রা বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বারবার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শূন্যতা তৈরি করা হয়েছে। তাতে রাজনৈতিক মেধাশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রটি পিছিয়ে গেছে। যেখানে যাওয়ার কথা সেখানেই যেতে পারেনি। তারপরও আমি মনে করি, বর্তমানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ৭২-এর সংবিধানকে পুনর্বহাল করার লক্ষ্যে কিছুটা পরিমার্জনা করা হলেও সরকার কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের একটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে এই ৪০ বছর পরে।
স্বকৃত নোমান : সাংস্কৃতিক জগতের নেতৃত্বশীল একজন মানুষ হিসেবে বর্তমান নাগরিক সমাজকে আপনি কীভাবে দেখেন? আসলে এই নাগরিকদের শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চার প্রকৃত অবস্থা কী?
নূরজাহান বেগম : নাগরিক সমাজের প্রকৃত অবস্থাটা এক কথায় বলা যাবে না। বিষয়টা আসলে জটিল। যদি নাগরিক সমাজের সংস্কৃতিচর্চার অবস্থাটা বলি, তাহলে বলা যায় যে, এই চর্চা তো দীর্ঘদিন ধরে হচ্ছে, ভালোভাবেই হচ্ছে। শিক্ষায়ও তারা এগিয়েছে অনেক। আগে তো একধরনের আন্দোলন-প্রতিরোধের কারণে সংস্কৃতির একধরনের চরিত্র ছিল। এখন আবার ভিন্ন। আবার যখন মৌলবাদীদের উত্থান হয়, তখন এককরম হয়। সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক স্থিতিশীল। যদিও মৌলবাদীরা, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আমার মনে হয় জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাঁরা দিচ্ছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তাঁদের সফল হতে হবে। নির্বাচনের আগের ওয়াদা তাঁদের বাস্তবায়ন করতে হবে। আর সংস্কৃতিটা তো আসলে পরিবর্তনশীল একটা ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বলতে এক কথায় আসলে বলা যায় না। সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বলে তো আসলে কোনো শব্দে আমি বিশ্বাস করি না। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষেরই তার নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। আমার পরিবারের একটা সংস্কৃতি আছে, গোষ্ঠীর একটা সংস্কৃতি আছে, জাতির, সমাজের একটা সংস্কৃতি আছে। জাতীয় সংস্কৃতি বলতে কোনো কিছু থাকা উচিত বলে মনে করি না।
স্বকৃত নোমান : নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে আপনার কী দৃষ্টিভঙ্গি?
নূরজাহান বেগম : এই প্রজন্ম সম্পর্কে আমি খুব আশাবাদী। তোমাদের মতো ছেলেমেয়েরা, যাদের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা আমি দেখতে পাই। নারীরা এখন সাহিত্য-সাংবাদিকতায় এগিয়ে এসেছে। বেশ কজন নারী সাংবাদিককে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি, যারা এরই মধ্যে বেশ সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করেছে। এখনকার প্রজন্ম দেশের কথা খুব ভাবছে। এগুলো তো আশাজাগানিয়া। এই প্রজন্মই তো দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের তো সময় ফুরিয়ে এসেছে। এ দেশ পরিচালনার ভার এই প্রজন্মের হাতেই। আমি তাদের নিয়ে খুব আশাবাদী।
স্বকৃত নোমান : আপনি তো বহু বৈচিত্র্যপূর্ণ দীর্ঘ জীবন-যাপন করেছেন। এই সময় এসে আপনার কী মনে হয়, আপনি সফল না ব্যর্থ? আপনার প্রাপ্তি এবং অপ্রাপ্তি সম্পর্কে যদি বলেন...
নূরজাহান বেগম : জীবন হচ্ছে বহমান। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সব নিয়েই তো জীবন। আমি মনে করে সবদিক থেকে ভাগ্যবান। ভালো বাবা-মা পেয়েছি, একজন ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছি। এত বছর বেঁচে আছি, ভালো বন্ধুবান্ধব পেয়েছি। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। জীবন সম্পর্কে আমার কোনো হতাশাবোধ নেই। আমি যা পেয়েছি তাতেই আমি খুশী, সুখী।
স্বকৃত নোমান : জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে এসে আপনাকে মৃত্যুভয় তাড়িত করে কি?
নূরজাহান বেগম : মৃত্যুভয় তাড়িত করে না। এই মুহূর্তে মরতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি কাউকে কষ্ট দিয়ে মরতে চাই না। মৃত্যুটা যেন স্বাভাবিকভাবেই হয় সেটাই কামনা করি।