শামসুর রাহমান স্মরণ
কবির জন্ম ও জন্মান্তর
কবির জন্ম কোনো নির্দিষ্ট তারিখের মুখাপেক্ষী নয়; মানবশিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনটিকে সৃষ্টিশীল ব্যক্তির জন্মক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়ার রেওয়াজ সমাজসম্মত। সে হিসেবে কবির সামাজিক জন্মদিবস রয়েছে, যদিও কবিসত্তার জন্মমুহূর্তকে স্বয়ং কবিও যথার্থ শনাক্তিতে সক্ষম নন। তার প্রয়োজনও নেই। দিনক্ষণ বড় নয়, কবিজন্মটাই বড়। বিশেষ করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কূপমণ্ডূক একটি সমাজে। সেখানে কবির আগমন ঘটে আলোকবর্তিকা হিসেবে; যে আলো সুরুচি, সুশিক্ষা ও সুস্থতার দিকনির্দেশকারী।
এটি খুবই মহিমান্বিত বিষয় যে একটি সমাজে একজন কি দুজন বড় কবির জন্ম প্রত্যক্ষ করে একটি গোটা শতাব্দী। আবার তার পূর্ববর্তী শতকেই বড় সৌভাগ্যে মেলে প্রায় ১০ জন কবি-মহীরুহ। কবির মাতৃভাষায় লিখিত কবিতাঙ্গনে শুধু নয়, সমগ্র সমাজে, বলা ভালো, তাঁদের স্বদেশে সেসব কবির স্থান হয় বিশিষ্ট এবং সমীহের সঙ্গে স্মরণীয়। আজ কবি শামসুর রাহমানের জন্মবার্ষিকীতে এ কথাগুলোর তাৎপর্য যেন নতুন করে অনুভব করছি।
কবির প্রয়াণের প্রায় এক দশক পেরিয়ে আজ আমরা স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারি, আমাদের সমাজে তাঁর অভাব। শামসুর রাহমানের সমতুল্য ভাবমূর্তি আর কোনো কবির পক্ষে অর্জন এখন অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হয়। কবি-অভিধাটির ওপর অপরাজনীতি ও কালের অবক্ষয় নেতিবাচক আস্তর ফেলে চললেও আমরা জেনে গেছি, কবিরও এক ধরনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থাকে।
গজদন্তমিনারবাসী বলে অর্বাচীনেরা কবিদের যতই দূরবর্তী করে তোলার কসরত করুক না কেন, একজন সার্থক কবি পান অতিসাধারণ মানুষেরও ভালোবাসা ও সমীহ। কবিতার মর্মার্থ না-বোঝা গড়পড়তা সাধারণ লোকের হৃদয়েও কবির জন্য থাকে পরম আসন। রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি, জীবনযাপনে ভণ্ডামি এবং সংকীর্ণ গোষ্ঠীমনস্কতা কবিকে না দেয় কবিখ্যাতি, না পান তিনি মানুষের সত্যিকারের ভালোবাসা। কবি ধ্যানি অচঞ্চল স্রষ্টার মতো একাগ্র থাকেন নিজস্ব ভুবনে; কাব্যসৃজনই তাঁর আরাধ্য। আজ কবি শামসুর রাহমানের বিদায় নেওয়ার দিনটিতে সার্বিকভাবে ‘কবি’ ধারণাটির চারদিকে আলো ফেলে বুঝে নিতে চাইছি আমাদের সমাজে কবিজীবন বেছে নেওয়া ব্যক্তিটির নীতি ও নিয়তি।
যা হোক, কবি শামসুর রাহমানের কবিজীবনের সূচনাপর্বের দিকে আমাদের ফিরে তাকানো জরুরি। ষাট দশকের প্রত্যূষকারে ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ কাব্য প্রায় নিঃশব্দে অথচ ঋজু ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছিল কথা বা শব্দ দিয়েই গড়া হয় কবিতা, সেই শব্দ জোগান দেয় কবির গহিন সত্তা এবং বাস্তব পারিপার্শ্বিক। উন্মেষপর্বে ‘রূপালী স্নান’ কবিতায় ‘মিছিল’ শব্দটি এসেছে এভাবে ‘উজ্জ্বল কথার মিছিল’। কয়েকটি চরণ আবৃত্তি করা যাক :
‘কোনো একদিন গাঢ় উল্লাসে ছিঁড়ে খাবে টুঁটি
হয়তো হিংস্র নেকড়ের পাল, তবু তুলে দিয়ে দরজায় খিল
সত্তাসূর্যে যেসাসের ক্ষমা মেখে নিয়ে শুধু গড়ি উজ্জ্বল কথার মিছিল’
আমরা এর পর অর্ধশতাব্দীকাল ধরে দেখব শামসুর রাহমান কেবলই গড়ে চলেছেন ‘উজ্জ্বল কথার মিছিল’। সমকাল বৈরী, পরিস্থিতি টালমাটাল, শহর অস্থির, স্বদেশ উত্তাল। কিন্তু কবির কাজ সেই উজ্জ্বল কথার মিছিল গড়ার ব্রতটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন তিনি। ছন্দে গাঁথা সেসব কথা ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সমাজের অগ্রসর, শিক্ষিত, রুচিবান ও শুভবোধসম্পন্ন নাগরিকেরই হৃদয়ের উচ্চারণ। ওই যে ‘রূপালী স্নান’ থেকে আমরা কয়েকটি পঙক্তি আওড়ালাম, সাধারণের চোখে তাতে ধরাই পড়বে না যে কথাগুলো ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে একটানা (বা প্রবহমান) লিখে যাওয়া। সেইসঙ্গে কবিতাটিতে অন্ত্যমিলও রয়েছে। একই ভঙ্গিতে (আঙ্গিকে) লেখা সেই সুবিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটিও। সেটিতে অন্ত্যমিল ব্যবহার করেননি কবি। তবে তাতে প্রতিটি বাক্যবন্ধের শুরুতে ‘স্বাধীনতা তুমি’ কথাটি লেখার ফলে একটা ঘোরলাগা ভাব চলে এসেছে। অনেকটা গানের মুখ যেন, ঘুরেফিরে একটি চরণ বারবার উচ্চারণ। শামসুর রাহমানের প্রায় সব কবিতাই ছন্দে রচিত উজ্জ্বল কথার মিছিল।
কবিতায় শামসুর রাহমানের সামগ্রিক অর্জনের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে যে তিনি এ অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রাচীনত্বগন্ধী রিক্ত কাব্যভাষাকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুমার্জিত, আধুনিক, মুখের ভাষার কাছাকাছি নাগরিক কবিতার ভাষা। এই তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তাঁর আগেও দু-তিনজন কবি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিলেন, তবে সফল পদরেখা প্রোথিত করেন তিনিই প্রথম। পরবর্তীকালে অনুগামী পান অনেক, অনুসারী সুপ্রচুর। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ স্পষ্টতই বদলে দেয় বাংলা কবিতাবিশ্বকে। ভাষা, চেতনা, বোধ, আবেগ, বৈশিষ্ট্য সর্ববিচারে বাংলা কবিতার ঘটে পালাবদল। এখানে যে পাঁচটি উপাদানের কথা বলা হলো, তার প্রতিটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্যে প্রয়োজন পৃথক পাঁচটি প্রবন্ধ-পরিসরের। আধুনিকতা, নান্দনিকতা, বিশ্বনাগরিকতা, মননশীলতা এবং বাস্তব ও কল্পনার সাংগীতিক সমন্বয় প্রতিটি ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের অবদান এককথায় অসাধারণ।
তবে পরবর্তীকালে আমরা বিশাল শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলা নতুন এক শামসুর রাহমানকে আবিষ্কার করি। এই শামসুর রাহমানের বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি এমনই অবিকল্প হয়ে উঠেছিল যে তা স্বচ্ছন্দভাবে কবিতায় ধারণে সক্ষম ছিল বাংলার আধুনিক মানুষের যেকোনো বিষয় বা বক্তব্য। কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল দিনানুদৈনিক ঘটনা, অনুভূতি কিংবা অনুষঙ্গের সহযাত্রী। ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’ কবিতার শিরোনামই বলে দেয় এর ভেতরকার বক্তব্য। সেই যে শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের মুখচ্ছবি ফুটে ওঠার শুরু, তাতে আর ছেদ পড়েনি; বরং বিকশিত হয়েছে সর্ববিধ ও সর্বোচ্চ রূপ নিয়ে। স্বদেশের প্রতিটি বড় কম্পনে, ক্রন্দনে; অর্জনে, বিসর্জনে, আঁধারে ও আলোকছটায় সৃজিত ও স্পন্দিত হয়েছে তাঁর শব্দেরা। দেশ, দেশের মানুষ, চলমান সময়, কবিসত্তা সব বেজে উঠেছে এক তানে, একাকার হয়ে গেছে সব। এভাবেই তো পাওয়া একাত্তরে ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’; পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটে ‘ইলেকট্রার গান’; পুনরায় জলপাই রঙে দেশ ঢেকে গেলে ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ এবং এরশাদের স্বৈরশাসনকালে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘একজন শহীদের মা বলছেন’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’, ২০০০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ‘সুধাংশু যাবে না’সহ অনেকানেক কবিতা।
ব্যক্তির প্রয়াণের পর আমরা ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতায় বুঝে নিতে চাই। কবি-ভাবমূর্তির সঙ্গে সে-অবয়ব সংযুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে বিরাট ব্যাপ্তি দেয়। দেশের প্রধান কবির সম্মান আমরা দিয়েছি শামসুর রাহমানকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, আরো স্পষ্ট করে বললে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে-সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, সেই বাংলাদেশে জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনেছি শামসুর রাহমানের কবিতায়। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনকে অনুসরণ করেছে তাঁর পঙক্তিমালা, জুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের সমান্তরাল উত্থানে বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশে আন্দোলনে-সংগ্রামে শামসুর রাহমান গর্জে ওঠা শব্দে ও শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে এমন একটি পর্যায়ে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হন, যেখানে পৌঁছতে পারেন শতাব্দীতে একজন কি দুজন। তাঁর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ নান্দনিক কবিতায় ও তীক্ষ্ণ প্রতিবাদে নিবিষ্ট পাঠক ছাড়াও ব্যাপক গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আইকন। সমৃদ্ধ শাণিত শৈল্পিক আইকন। বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতের এক অসামান্য প্রতিভূ।
আজ কবি শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকলে তাঁকে ঘিরেই আমরা উদযাপন করতাম তাঁর জন্মদিন। ১০টি বছর হলো সেই সুযোগ আমরা হারিয়েছি। তবে এটাও স্বীকার্য ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে জন্মদিনের যে আয়োজন, তাতে স্বয়ং কবির এক ধরনের অনিবার্য উপস্থিতি থাকে। নতুন দিনের কাব্যানুরাগীরা সেখান থেকে ঠিকই পেতে পারে শিল্পের সুঘ্রাণ ও সৃষ্টির প্রেরণা। কবিতার বরমাল্য কবির জন্য এক অপার্থিব প্রাপ্তি। এই অর্জন অনেক বেশি খাঁটি ও মজবুত। প্রতিটি জন্মদিনে একেকটি জন্মান্তর ঘটে এমন কবিজন্মকে সংবর্ধিত করার মাধ্যমে আত্মিক শান্তিলাভ ঘটে কবিতার বরপুত্রদের। আর মাত্র ১৩ বছর পরই কবি শামসুর রাহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হবে। এ সামান্য স্মরণাঞ্জলির সূচনাতে শতাব্দীর কবিসত্তার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। শামসুর রাহমানের আবির্ভাবের পর থেকে এক শতাব্দীকাল পরে এসে বাঙালি পেছনের দিকে ফিরে সগৌরবে বলবে, বিগত একশ’ বছরে আমরা পেয়েছি শামসুর রাহমানের মতো একজন বড় কবি, যাঁর উচ্চতাকে অতিক্রম করে যাওয়া আর কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই আজ তাঁকে কুর্নিশ করছে বাংলার সকল কবি, কবিতাকর্মী এবং কবিতাপ্রেমী সুন্দর সুমার্জিত সত্ত্বা।