উদীচীর দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব শুরু
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত দুই দিনব্যাপী দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। শুক্রবার (৮ মার্চ) বিকালে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে উৎসবের উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায়।
শনিবার (৯ মার্চ) বিকেল চারটায় উৎসবের দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে। সেখানে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে কার্যক্রম।
প্রথম দিন অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন রথীন্দ্রনাথ রায়। সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমান। এ সময় জাতীয় সঙ্গীত ও সংগঠন সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।
রথীন্দ্রনাথ রায় উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ঢাক-ঢোলের বাদনে নৃত্যের তালে-তালে উল্লাসে মাতেন সারা দেশ থেকে আসা উদীচীর শিল্পী-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ।
উদীচীর সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানের সভাপতিত্বে এ পর্বে বক্তব্য দেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে, শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা এবং উৎসবের উদ্বোধক রথীন্দ্রনাথ রায়। উৎসবে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উদীচীর সহসভাপতি এবং দ্বাদশ সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা প্রস্তুতি পরিষদের আহ্বায়ক মাহমুদ সেলিম।
কণ্ঠ ছেড়ে গান গেয়ে, কণ্ঠরোধের সব কালাকানুন ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হয় উদীচীর এই গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা। উৎসবের প্রথম দিন সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় জাতীয় পর্যায়ের গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতা।
জেলা পর্যায় শেষে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করে বিজয়ী হয়ে সারাদেশ থেকে আসা প্রায় ৩০০ শিল্পী দিনভর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। তিনটি একক এবং একটি দলীয়সহ মোট চারটি বিভাগে বিভক্ত হয়ে প্রতিযোগিরা এতে অংশ নেন। এবার ৫০টি জেলা এবং ৯টি বিভাগে প্রতিযোগিতায় বিজয়ী ৮০ জন একক শিল্পী এবং ১৭টি দল মিলিয়ে প্রায় ৩০০ শিল্পী জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন।
স্বাগত বক্তব্যে মাহমুদ সেলিম বলেন, গণসঙ্গীতের প্রচার, প্রসার এবং সঙ্গীতের একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে গণসংগীতকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা শিল্পী-সংগ্রামী সত্যেন সেনের জন্মদিন ২৮ মার্চকে কেন্দ্র করে সত্যেন সেন গণসংগীত উৎসব ও জাতীয় গণসংগীত প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে উদীচী। সবার সঙ্গে যুথবদ্ধ প্রয়াসে গণসঙ্গীতের যেমন প্রসার ঘটবে, শিল্পীরা উদ্বুদ্ধ হবে এই গান গাইতে, তেমনি গণমানুষের শোষণ বঞ্চনা, পাওয়া না পাওয়া সুখ দুঃখ সুরের ললিত বাণী হয়ে ব্যাপ্ত হবে চারিদিকে।
উদীচীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘রাজনৈতিক অঙ্গীকারসম্পন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গান-নাচ-নাটক-কবিতা-চলচ্চিত্রের মতো সৃজনশীল মাধ্যমকে হাতিয়ার করে সমাজের নানা অসঙ্গতি, শোষণ-বঞ্চনা-অত্যাচার- নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে চলেছে উদীচী। প্রাথমিক অবস্থায় একটি গানের দল হিসেবে যাত্রা শুরু করা উদীচী, চারণ শিল্পীদের মতো কন্ঠে গণসংগীত নিয়ে, মানুষের মুক্তির জন্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সুরের মাধুর্য্যে অসুর নিধনের ব্রত নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনসহ সাধারণ জনগণের যেকোনো অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অন্যতম অনুপ্রেরণা রেখেছে গণসঙ্গীত।’
তিনি আরো বলেন, অদ্ভুত এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি বিরাজ করছে আমাদের দেশে। নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটবাজি ও অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের দাদাগিরির সুযোগ তৈরি করে দেয়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি খাতে অচলাবস্থা, মুক্ত ধারার সংস্কৃতি চর্চার পথ দিনদিন রুদ্ধ হওয়াসহ অসংখ্য বিধি-নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ দেশবাসী। অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হলেও মানুষের মানবিক ঋদ্ধির দিকে কারো নজর নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণকারী সাইবার নিরাপত্তা আইন বা অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের মতো একের পর এক আইন-কানুন প্রণয়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকারটুকুও কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এ অচলাবস্থা নিরসন এবং দেশকে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সামিল হতে গণসংগীতের সুরে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে চায় উদীচী। আর সেজন্যই এবারের উৎসবের শ্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘কণ্ঠরোধের কানুন ভেঙে, কণ্ঠ ছেড়ে গান ধরেছি।’
শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক সায়েম রানা বলেন, গণসঙ্গীত সবসময়ই বর্তমান কালকে সঠিকভাবে উন্মোচন করে। সমাজের নানা অসঙ্গতি, অসাম্য, শোষণ-বঞ্চনার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলাসহ এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে গণসঙ্গীত। তাই, বর্তমান কালকে ধারণ করে জনগণের মুক্তির সার্বিক চেতনাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরাই গণসঙ্গীতের কাজ। উদীচীর গণসঙ্গীত উৎসব ও জাতীয় গণসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু নতুন গান পরিবেশিত হয়েছে যা বর্তমান সময়কে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে।