কোনো বিরোধী দলই চায় না সরকার : মির্জা ফখরুল
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন যে, বিএনপির সঙ্গে একসঙ্গে বাস করা যায় না। তাঁর এই বক্তব্যে তাদের আসল যে চরিত্র, তাদের আসল যে মানসিকতা সেটা বেরিয়ে এসেছে। তারা শক্তিশালী বিরোধী দল তো দূরের কথা, কোনো বিরোধী দলই চায় না। তাঁর এই বক্তব্য থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।
আজ বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বিএনপির স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ‘১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস’ উপলক্ষে এক গোলটেবিল আলোচনায় মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশে চারটি পত্রিকা রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয় সরকার। এদিনটিকে প্রতি বছর বিএনপি ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপি কারো দয়ার দল না, বিএনপি কারো দয়াতে টিকে নাই। বিএনপি সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে জনগণের ভালোবাসা ও জনগণের সমর্থন নিয়ে। এই কথাটা অবশ্যই সরকারকে মনে রাখতে হবে।’
‘আজকে যে অবস্থাটা সরকার তৈরি করেছে। এই যে মানুষের অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে, এই যে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্র, তাকে যে ধ্বংস করেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, গুম করেছে, খুন করেছে, ৩৫ লাখ গণতন্ত্রকামী মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে। এজন্য অবশ্যই একদিন আওয়ামী লীগের বিচার হবে, জনগণই তাদের বিচার করবে।’
সারা দেশে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের জন্য সরকার ও প্রশাসনকে অভিযুক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বয়স্ক সম্পাদক দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবকে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা হয়েছিল, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী সাহেবকে প্রায় আট মাস যাবত আটক করে রাখা হয়েছে, শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের মতো সম্পাদককে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আপনারা হিসাব দিলেন যে, প্রায় ৬০ জনের বেশি সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুধু জীবনের ভয়ে।’
‘আর যারা দেশে আছেন তারা লিখতে পারেন না। লিখতে না পারার জন্য কখনো আমি তাদের দোষারোপ করি না। কারণ যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যে সেলফ সেন্সরশিপ নিজেদের আরোপ করে নিতে হয়েছে তা হচ্ছে একমাত্র জীবনের ভয়ে, জীবিকার ভয়ে, সন্তান হারানোর ভয়ে, মামলার ভয়ে। কারণ ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, কিভাবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ের ভেতরে নির্যাতন করা হলো।’
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমাদের সবাইকে জেগে উঠতে হবে। তরুণ-যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। আজকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংবাদ কর্মীদের নিরাপত্তা, তাদের মুক্তি সব কিছুই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের মুক্তির ওপর। গণতন্ত্র যদি মুক্তি না পায়, তাহলে কখনোই কারো মুক্তি সম্ভব নয়, কারো মুক্তি সম্ভব নয়।’
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘দেশে একটা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলছে, দেশকে একটা নেতৃত্বশূন্য করার প্রক্রিয়া চলছে- এখান থেকে কোনো একটা প্রতিষ্ঠা কিংবা জাতির কোনো একটা অংশ বাদ যাচ্ছে না। যদি বিরাজনীতিকরণ ও নেতৃত্বশূন্য না করা হয়, এদেশের যে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এটাকে যারা বিকিয়ে দিতে চায়, তাদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আজকে পরিকল্পিতভাবে বিরাজনীতিকরণের এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশকে খুব খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। এটাকে রুখতে হলে আমাদের সব বিভক্তি ভুলে এক হতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমি বলতে চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চেয়ে সাংবাদিকের স্বাধীনতা বেশি প্রয়োজন। যেটা সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতা বা লেখার স্বাধীনতা। কারণ মালিকের স্বাধীনতা আছে। মালিক আর সরকার জয়েন্ট ভেঞ্চারে চলে। কখনো মালিক সরকারকে ব্ল্যাক মেইল করে, কখনো সরকার মালিকদের ব্ল্যাক মেইল করে। কারণ তারা নানা রকম ব্যবসা করে। আর সংবাদপত্রে যারা লেখালেখি করে তারা চাকরি করে, যা দেয় তা করে। তাদের স্বাধীনতা নেই, তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে। এটা ভবিষ্যতে আমার মনে হয়, সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আজকে ১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস। আবার আজকে দিনটা হলো আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস। কিভাবে নিয়ে গেল এটি ওই দিনটার কাছে, আমি জানি না। সবার কাছে আমার বিনীত নিবেদন থাকবে যে, সংবাদপত্রের দলনের যে দিনটা, সেদিন সংবাদপত্রের যারা কর্মী ছিল তাদের সরকারের অধীনস্থ করে গৃহশ্রমিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই দিনটাকে একটা কলংকের দিন হিসেবেই আমরা যেন বিবেচনা করি।’
‘সেখানে থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, সেখান থেকে মুক্তি লাভের জন্য এবং সেই অমর্যাদা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সংবাদপত্র-মিডিয়া-সাংবাদিক তাদের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে মিডিয়া কর্মী ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব- এই শপথ আজকে ঘোষণা করছি।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ বলেন, ‘আমি বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, মিডিয়ার স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন হবে, এই আন্দোলন গণতন্ত্রের আন্দোলন থেকে পৃথক কোনো আন্দোলন নয়। একই সমন্বিত আন্দোলন করতে হবে। আমি আশা করব যে, ভবিষ্যতে যখন বিএনপি সরকার গঠন করবে, আমরা একটা প্রেস কমিশন গঠন করতে চাই। যে কমিশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের পুরো পরিস্থিতির একটা বিশ্লেষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যে কারা মিডিয়ার মালিক হয়েছে, কিভাবে মালিক হয়েছে, সাংবাদিকদের অবস্থা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবস্থা, সংবাদপত্র যে কালো আইনগুলো ঘিরে রেখেছে, সেই কালো আইনগুলোর পর্যালোচনা-সব কিছুর রিপোর্ট আমরা চাই এই প্রেস কমিশনের মধ্য দিয়ে। এই দাবি আমি আজকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে রাখছি।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন প্রথমেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন পড়েছে, সেটা কী ‘৭৫, কী ’৯৬, কী ২০০৯। তাদের প্রত্যেকটি শাসনে তাদের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছে গণমাধ্যম।’
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, যখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়, আমরা একটা জিনিস দেখেছি তখনই সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলে, গণতন্ত্রের ওপর আঘাত আসে, ভোটাধিকার হরণ হয়। বাংলাদেশের মানুষ কেউ ভালো নেই। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে, মিডিয়ার যদি স্বাধীনতা চান, গণতন্ত্র যদি চাই তাহলে এই ফ্যাসিবাদী সরকারকে ‘না’ বলতে হবে। আমি সবাইকে আহ্বান জানাব, যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
বিএনপির স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও মিডিয়া উপ-কমিটির সদস্য সচিব শ্যামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় গোলটেবিল আলোচনায় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুল হাই শিকদার, দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এমএ আজিজ ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বক্তব্য দেন।