ক্রেতার অপেক্ষায় সেজেছে কামারপট্টি
রাজেশ কর্মকার হাপরের গনগনে আগুন থেকে লোহার পাত বের করে সামনে রাখছিলেন; আর সেই তপ্ত লোহাতে একের পর এক হাতুড়ি চালাচ্ছিলেন গৌতম কুমার ও রাসেল। এক সময় সেটি একটি ছুরির আকার নেয়। তারপর সেটি পাঠানো হয় পাশের সুজয় কর্মকারের কাছে।
রাজেশ কর্মকারসহ আরও দুজন মেশিনে ধার দিয়ে তৈরি করেন চকচকে ছুরি। পরে সেটি বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখেন দোকানের সামনের সারিতে। পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে তাঁরা সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত এভাবেই কাজ করেন। কখনো-কখনো অবশ্য এরও বেশি সময় টানা কাজ করতে হয়। যখন বিক্রি বেড়ে যায়। যেমন এখন বেড়ে গেছে।
এই দৃশ্যটি আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কামারপট্টির। তখন বিকেল সাড়ে ৪টা। রাজেশ কর্মকার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখনো বিক্রি সেই অর্থে শুরু হয়নি। আশা করি আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে বেড়ে যাবে। তবে আমাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। সামনের দিনের চিন্তায় বেশি বেশি অস্ত্র বানাচ্ছি। আমরা অপেক্ষায় রয়েছি ক্রেতা বাড়ার।’
আসন্ন ঈদুল আজহায় পশু কোরবানিকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কামারপট্টিতে। দিনরাত পরিশ্রম করে কর্মকারেরা চাপাতি, দা ও ছুরিসহ নানা সামগ্রী তৈরি করে দোকানে সাজাচ্ছেন। কিন্তু বিক্রি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বিক্রেতারা। এদিকে বেশি দামে অখুশি ক্রেতা। তবে ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে বলে ধারণা দোকানিদের।
কারওয়ান বাজারের কামারপট্টিতে এসব জিনিস প্রস্তুতকারী মোট ১২টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কেউ পাইকারি বিক্রি করেন; আবার কেউ কেউ নিজেদের দোকানে সাজিয়ে রেখে খুচরা বিক্রি করেন। কারো ব্যবসাই ভালো যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বিক্রেতারা। তবে ক্রেতাদের দাবি, অস্ত্রের দাম অনেক বেশি বলছেন বিক্রেতারা।
রাজেশ কর্মকার এরশাদের আমল থেকে কারওয়ান বাজারে এই কাজ করেন। এখন তিনি দিনপ্রতি বেতন পান ৮০০ টাকা। গৌতম পান ৬৫০ টাকা আর রাসেল ৬০০ টাকা। হাপরের গরমের মধ্যে বসেই তাঁরা মূলত দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। লোহাতে আঘাত করতে করতে তাঁদের হাতের তালু শক্ত হয়ে গেছে।
কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রাজেশ বলেন, ‘দিনে তিনজনে মিলে ৪৫টার মতো চাপাতি, ৯০টার মতো ছুরি ও ৪০টার মতো জবাই করার বড় ছুরি তৈরি করা যায়। এখন কাজের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত এই ব্যস্ততা থাকবে। কারণ, এখন আমরা যা তৈরি করছি সবই ঈদকে সামনে রেখেই।’
কামারপট্টির ‘মা-বাবার দোয়া’ নামের একটি দোকানের মালিক মো. বজলুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আজ বিকেল পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। রাত পর্যন্ত হয়তো আরও পাঁচ হাজার টাকা হবে। তবে, এ বিক্রি বেশি না। ঈদের তিন দিন আগে থেকে মূলত বেশি বিক্রি শুরু হয়। আমরা ওই সময়ের অপেক্ষায় আছি।’
দীপক চন্দ্র কর্মকার নামের এক দোকানি বলেন, ‘আমরা মূলত সারা ঢাকার কসাইদের জন্য অস্ত্র বানাই। বেশি বিক্রি করি পাইকারি। কিন্তু, ঈদের বাজারের জন্য আমরা অস্ত্র বানাচ্ছি এখন বেশি। সবাই মিলে কাজ করছি। ঈদের জন্য অনেক মাল তৈরি করা হয়ে গেছে। এখন শুধু হাতল লাগাব, আর বিক্রি করব। এ ছাড়া আরও বেশি দরকার পড়লে আরও অস্ত্র বানাব। এখনও অস্ত্র বানানো চলছে। বিক্রি বাড়তে শুরু হয়েছে।’
শহীদুল্লাহ আমিন নামের এক ক্রেতা কোরবানির জন্য রামদা, চাপাতি কিনতে এসেছেন। তিনি বলেন, এরা অনেক বেশি দাম রাখছে। ইস্পাতের রামদার কেজি খুব বেশি হলে ৫০০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু এরা রাখছে ৬০০ টাকা। একটা চাপাতির দাম বেশি হলে ৬০০ টাকা হওয়ার কথা কিন্তু রাখছে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা। ভাবছিলাম, এবার কম দামে কেনার চেষ্টা করব।’
দাম বেশি রাখার কথা বলেছেন শরিফুল নামের আরও এক ক্রেতাও। তিনি বলেন, ঈদের এখনও অনেক বাকি থাকায় বেশি দাম চাচ্ছে। ঈদ যত কাছে আসবে তত দাম কমবে। আজ ঘুরে দেখে গেলাম, দুদিন পরে আসব।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই ধরনের লোহার চাপাতি তৈরি করছেন তারা। কাঁচা লোহার চাপাতির দাম কম। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। স্প্রিংয়ের বা পাকা লোহার লোহার দাম বেশি; ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি। পশু জবাই করার ছুরি বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। এই ছুরি ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। এ ছাড়া চামড়া কাটার ছুরি ৫০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। বটি বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি। এ ছাড়া ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন দামে কুড়াল বিক্রি হচ্ছে।