খুলনায় ব্যাংকের টাকা আত্মসাতে তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখার ১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রতারণা করে আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় স্টার সি ফুডের এমডি মো. সালাউদ্দিনসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। আজ বুধবার মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. শহিদুল ইসলাম এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
দুদকের মামলার অন্যতম আসামি ব্যাংকের সিবিএর সাবেক সভাপতি মো. আব্দুর রহিম বাবুসহ দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ব্যাংকের ডিজিএম শেখ শহিদুল ইসলাম।
দুদক খুলনার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মুজিবর রহমান জানান, দুদকের উপপরিচালক মো. শাওন মিয়া বাদী হয়ে স্টার সি ফুডের এমডি মো. সালাউদ্দিন ব্যাংকের গোডাউন কিপার মো. আব্দুল মান্নান হাওলাদার ও গোডাউন চৌকিদার সিবিএর সাবেক সভাপতি আব্দুর রহিম বাবুর বিরুদ্ধে এই মামলা করেছিলেন। আজ মামলাটি আদালতে উপস্থাপন হলে দুদক আইনজীবীর শুনানির পর আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
সোনালী ব্যাংক খুলনা করপোরেট শাখার ডিজিএম শেখ শহিদুল ইসলাম জানান, দুদকের মামলায় আসামি সিবিএর সাবেক সভাপতি ও গোডাউন কিপার আব্দুর রহিম বাবু ও গোডাউন কিপার আব্দুল মান্নান হাওলাদারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এর আগে গোডাউন চৌকিদার সাবেক সিবিএনেতা আব্দুর রহিম বাবু সাতক্ষীরা জেলার প্রতারণার মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদক উপপরিচালক মো. শাওন মিয়া জানান, তারা আদালতের কাছে আসামিদের স্থাবর সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করার আবেদন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মামলা তদন্তকালে সিবিএর সাবেক সভাপতি মো. আব্দুর রহিম বাবু নিজেকে দলের নেতা পরিচয় দিয়ে হম্বিতম্বি করেছিলেন। কিন্তু সরকার দুর্নীতিবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল থাকায় তাকে আসামি করতে দুদককে কোনো পেতে হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই মামলায় ব্যাংকের আরও কিছু কর্মকর্তা ও সিবিএনেতার নাম যুক্ত হতে পারে যথাযথ সাক্ষী-প্রমাণ পাওয়া গেলে। আব্দুর রহিম প্রভাবশালী সিবিএনেতা হওয়ায় বড় কর্মকর্তারাও মুখ খুলতে চান না। অনেক ঋণ বা বদলি নানা বিষয়ে আব্দুর রহিম বাবু প্রভাব বিস্তার করতেন।’
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ব্যাংকের ঋণ ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশে গোপনে মাছ বিক্রির পরিকল্পনা করেন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. সালাউদ্দিন। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত গোডাউন কিপার মো. আ. মান্নান হাওলাদার এবং গোডাউন চৌকিদার মো. আব্দুর রহিম বাবুর সঙ্গে মিলে গোপনে মাছ বিক্রির যড়যন্ত্র করেন। স্টক রেজিস্টার অনুযায়ী স্টার সি ফুডের গোডাউনে ২৭ হাজার ৫০৫ মাস্টার কার্টন চিংড়ি মাছ থাকার কথা। এ বিপুল পরিমাণ মাছ এক দিনে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না বিধায় নিয়মিত রাতের অন্ধকারে গোডাউন কিপার আ. মান্নান হাওলাদার ও গোডাউন চৌকিদার আব্দুর রহিম বাবু গোডাউন হতে বের করে বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু শেখ আশরাফুর রহমান ১৫ জুলাই ২০১৭ স্টার সি ফুডের গোডাউন চৌকিদার হিসেবে যোগদান করেন এবং তাদের পরিকল্পনায় বাঁধ সাধেন। ১০ আগস্ট ২০১৭, শেখ আশরাফুর রহমান স্টার সি ফুডে পাহারার সময় রাত ১০টা দিকে দেখেন যে, কোম্পানির কর্মকর্তা সুমন কোম্পানির তিনজনসহ বহিরাগত ১০ থেকে ১২ জন লেবার নিয়ে কোম্পানির গেট খুলছেন। তাদের কাছেই গোডাউনের চাবি ছিল। মাছ চুরির ঘটনা তৎকালীন ডিজিএম (বর্তমানে অবসরে) মো. আবু হোসেন শেখ সকালে পুলিশ নিয়ে ঘটনার প্রমাণ পান এবং কোম্পানির কর্মচারীদের নামে মামলা করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে গোডাউন কিপার মো. আ. মান্নান হাওলাদার এবং গোডাউন চৌকিদার আব্দুর রহিম বাবু অসত্য সাক্ষ্য দিয়ে এবং দলীয় প্রভাব বিস্তার করে মামলাটিতে ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করেন। এ সময় সিবিএ সভাপতি হিসেবে আব্দুর রহিম বাবু ডিজিএম আবু হোসেন শেখকে এ সংক্রান্ত কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার নির্দেশ এবং নাজেহাল করেন। ডিজিএম মো. আবু হোসেন শেখ সিবিএ নেতাদের দাপটে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেননি বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে। সার্বিকভাবে এ ঘটনার জন্য স্টার সি ফুডের এমডি মো. সালাউদ্দিন, গোডাউন কিপার মো. আ. মান্নান হাওলাদার এবং গোডাউন চৌকিদার মো. আব্দুর রহিম বাবু দায়ী বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এ কর্মকর্তারা নিরাপত্তার কারণে নাম না প্রকাশ করে জানান, এই সাবেক সিবিএ নেতা এবং গোডাউন চৌকিদার আব্দুর রহিম বাবুর যোগসাজশে এর আগে বাংলাদেশ সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এক রাতে তিন কোটি টাকার মাছ চুরিসহ মোট ২৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়। ব্যাংকের পক্ষ থেকে তখন থানায় চুরির এজাহার দায়ের হয়, যা পরে ফাইনাল দেওয়া হয়। পরে ব্যাংকের পক্ষ হতে শুধু অর্থ ঋণ আদালতে ঋণ খেলাপির মামলা করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। চুরির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়।
প্লেজ ঋণ মানে হচ্ছে গোডাউনে চিংড়ি মাছ বা যেকোনো পণ্য জামানত দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়। খুলনার সোনালী জুট মিলের ১০৪ কোটি টাকা প্লেজ ঋণের টাকা একই প্রক্রিয়ায় আত্মসাৎ করার মামলায় জুট মিলের মালিক এমদাদ হোসেন বুলবুল, সোনালী ব্যাংক খুলনা আঞ্চলিক অফিসের সাবেক জিএম নেপাল চন্দ্র সাহা, করপোরেট শাখার ডিজিএম সমীর কুমার দেবনাথ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জয়নাল আবেদিনসহ একাধিক কর্মকর্তার নামে দুদক মামলা করে। পরবর্তী সময়ে তাদের এই মামলায় জেলে পাঠানো হয় এবং মামলাটি বিচারাধীন।
সোনালী ব্যাংকের গোডাউন চৌকিদার সিবিএর সাবেক সভাপতি আ. রহিম বাবু গত বছর খুলনা আওয়ামী লীগের ২৮নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রার্থী হয়েছিলেন। এই সময় নগরীতে ব্যাপক প্যানা-পোস্টার করেছিলেন। তার ফেসবুক আইডিতে ধনকুবের খ্যাত সমশের বিন মুসাসহ একাধিক নেতার সঙ্গে তার ছবি দিয়ে পোস্ট করা রয়েছে।