জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সব দেশের চাহিদার স্বীকৃতি দাবি প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বিশেষ করে দরিদ্রতম যে ৪৮টি দেশ সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত, অথচ বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে যাদের অবদান মাত্র শতকরা পাঁচ ভাগ, তাদের অর্থায়ন চাহিদার আশু স্বীকৃতি দাবি করেছেন ধনী দেশগুলোর কাছে। তিনি প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ দেশগুলোর যৌথ পদক্ষেপের পাশাপাশি বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয়ভাবে প্রধান্য দিয়ে সমাধান খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন ‘জলবায়ু পরিবর্তন এখন একটি বৈশ্বিক এবং আন্তসীমান্ত সমস্যা এবং এর মারাত্মক পরিণতি থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সোমবার স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে কোপ২৬ সম্মেলনস্থলের কমনওয়েলথ প্যাভিলিয়নে ‘সিভিএফ-কমনওয়েলথ হাই-লেভেল ডিসকাসন অন ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ শীর্ষক আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণদানকালে এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু দুর্যোগের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং এই সবের প্রভাব নাজুক দেশগুলোকে অপূরণীয় ক্ষতির অগ্রভাগে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে। এ প্রসঙ্গে, তিনি সাম্প্রতিক আন্তসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) রিপোর্টের উল্লেখ করেন যা একটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে, এই গ্রহ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে সবাইকে জরুরি এবং সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিভিএফ সদস্য দেশ কমনওয়েলথের সদস্য এবং এসব দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এবং অবদানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যৌথ প্রচেষ্টা সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ সদস্য দেশগুলো প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।’
সিভিএফের চেয়ার শেখ হাসিনা সিভিএফ ও কমনওয়েলথের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন।
প্রস্তাবের প্রথম দফায় শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ এবং প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধান অর্জনে আমাদের মধ্যে জ্ঞান ভাগ করে নেওয়া, গবেষণা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয় দফায় বলেন, ‘আমাদের অভিন্ন অবস্থান প্যারিস চুক্তিতে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের লক্ষে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সুরক্ষিত করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। জলবায়ু অর্থায়ন হতে হবে বিদ্যমান এবং ভবিষ্যৎ ওডিএ’র অতিরিক্ত। এই পরিমাণটি অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে ৫০:৫০ অনুপাতের সঙ্গে বরাদ্দ করা উচিত।’
তৃতীয়ত, শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু অভিবাসীদের সমস্যা-জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে মানুষ তাদের পৈতৃক ভিটা এবং ঐতিহ্যবাহী পেশা থেকে চ্যুত হয়েছে, যা আলোচনা করা দরকার এবং এইসব মানুষের পুনর্বাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়িত্ব নিতে হবে।
চতুর্থ দফায়, প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রিতে রাখতে তাদের উচ্চাভিলাষী এবং আগ্রাসী এনডিসি ঘোষণা করতে প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোর ওপর চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে।’
এ ছাড়াও, জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোসহ সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি হন্তান্তর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ হাসিনা তাঁর পঞ্চম দফায় বলেন, একই সঙ্গে, সিভিএফ ও কমনওয়েলথ সদস্যদের উন্নয়ন চাহিদা বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সর্বোপরি একসঙ্গে আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাস্তবসম্মত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত সমাধানগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিভিএফের ৪৮ সদস্য দেশগুলো মোট বৈশ্বিক নির্গমনের মাত্র পাঁচ শতাংশের জন্য দায়ী, অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমাদের জীবন ও জীবিকার জন্য মৌলিক হুমকি সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের শক্তিশালী, সাহসী এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপের জন্য কার্যকর সহযোগিতা ও সহযোগিতার তাৎপর্য প্রমাণ করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য আমাদের দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে।
এই প্রসঙ্গে, শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান নির্গমনকারী দেশগুলোকে ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের প্রচেষ্টায় আমাদের সমর্থন করার জন্য তাদের বাধ্যবাধকতা’ পূরণ করতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্য বাংলাদেশকে প্রায়ই গ্রাউন্ড জিরো বলা হয়। ‘আমাদের দুর্বলতা এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অনুকরণীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। তিনি একটি উচ্চাভিলাষী এবং হালনাগাদ এনডিসি’রও উল্লেখ করেন, যা সম্প্রতি বাংলাদেশ ইউএনএফসিসিসিতে জমা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ উন্নয়নে স্বল্প-কার্বন পথ অনুসরণ করে জলবায়ুর দুর্বলতাকে জলবায়ু সমৃদ্ধিতে রূপান্তরিত করতে ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ চালু করেছে।