জাপান থেকে আসা দুই শিশুসহ ঘুরতে যেতে পারবেন মা-বাবা, রাতে থাকার ক্ষেত্রে সময় নির্ধারণ
জাপানি নাগরিক চিকিৎসক নাকানো এরিকোকে নিয়ে অপপ্রচার-সংক্রান্ত সব কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ ছাড়া এসব ভিডিও কনটেন্ট তৈরির সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ও সাইবার টিমকে এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া সন্তানদের নিয়ে বাইরে মা-বাবা উভয়েই বাইরে ঘুরতে যেতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন আদালত। একইভাবে সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবাকে রাতে থাকার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন আদালত। এবং আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার এ আদেশ দেন।
এর আগে গত সোমবার জাপানি মা চিকিৎসক নাকানো এরিকোকে নিয়ে অপপ্রচার সংক্রান্ত সব কনটেন্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরানোর নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়।
এ ছাড়া দুই শিশুকে নিয়ে বেড়ানোর উদ্দেশে বাইরে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চেয়েও আবেদন করা হয়েছে।
দুই শিশুর জাপানি মায়ের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির এ আবেদন করেন।
আইনজীবী জানান, আদালতের নির্দেশে বর্তমানে মা-বাবাসহ রাজধানীর গুলশানের চার কক্ষবিশিষ্ট একটি বাসায় রয়েছে জাপানি দুই শিশু। মা এরিকো শিশুদের নিয়ে বাইরে যেতে চাইলেও, বাবা রাজি না হওয়ায় বাইরে যেতে পারছেন না। এ কারণে মার্কেটে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়।
এর আগে গত ৩১ আগস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন মা-বাবাসহ রাজধানীর গুলশানের চার কক্ষবিশিষ্ট একটি বাসায় থাকবে জাপানি দুই শিশু। সেখানে তারা আপাতত ১৫ দিন থাকবে। ফ্লাটের ভাড়া উভয় পক্ষ বহন করবে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ঢাকার ডেপুটি ডিরেক্টর তাদের তত্ত্বাবধান করবেন। প্রয়োজনে এ কর্মকর্তা ওই ফ্ল্যাটে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। গুলশানের বাসায় থাকাকালীন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বলা হয়েছে। আগামী ১৬ সেপ্টেম্বর এই মামলার পরবর্তী আদেশ দেবেন আদালত। তবে এ সময়ে হাইকোর্ট পুরো বিষয়টি নজরে রাখবেন।
দুই শিশু ও তাদের মা-বাবার মতামত নেওয়ার পর আদালত এই আদেশ দিয়েছেন। যদিও একই বাসায় শিশুদের বাবার রাত যাপনে আপত্তি জানিয়েছিলেন শিশুদের মায়ের পক্ষের আইনজীবী। আদালত বলেছেন, ‘আমরা চাই শিশুরা পারিবারিক পরিবেশে থাকুক।’
আদালতে শিশুদের জাপানি মায়ের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। শিশুদের বাংলাদেশি বাবার পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তাঁকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার মারুফুল আলম ও ব্যারিস্টার ফাইজা মেহরিন।
এর আগে দুই জাপানি শিশু বাবার কাছে নাকি মায়ের কাছে থাকতে চায়, এ বিষয়ে শিশুদের সঙ্গে একান্তে কথা বলেন হাইকোর্ট। বিচারপতিদের খাস কামরায় প্রায় আধঘণ্টা শিশুদের সঙ্গে কথা বলেন আদালত।
দুই মেয়েকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে গত ১৯ আগস্ট সকালে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রিট করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো (৪৬)। রিটে মেয়েদের নিজের জিম্মায় নেওয়ার নির্দেশনা চান ওই নারী।
ওই দিন জাপানি দুই শিশু এবং তাদের বাবা শরীফ ইমরানকে এক মাসের জন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন। সঙ্গে তাদের বাবা ও ফুফুকে নিয়ে আসতে বলা হয়। রাজধানীর গুলশান ও আদাবর থানার ওসিকে এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
কিন্তু, এর মধ্যেই ২২ আগস্ট ১০ ও ১১ বছর বয়সী মেয়ে দুটিকে হেফাজতে নেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ বিষয়টি ২৩ আগস্ট সকালে হাইকোর্টের নজরে আনেন তাদের বাবার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম।
আদালত দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দেন। এ সময়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জাপানি মা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশি বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন বলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
একই সঙ্গে আদালত ওইদিন উভয় পক্ষের আইনজীবীদের ৩১ আগস্টের মধ্যে বিষয়টি সমাধান করতে ভূমিকা রাখতে বলেছিলেন। তবে, সোমবার (৩০ আগস্ট) রাত পর্যন্ত আইনজীবীদের উপস্থিতিতে কয়েক দফা বৈঠক করেও দুই পক্ষ কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি।
২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে সেরে টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের ১২ বছরের সংসারে তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। তারা তিন জনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান-এরিকোর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু, এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর এক দিন জেসমিন মালিকা এবং আরকে মেয়ে লাইলা লিনা স্কুল বাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
গত ২৫ জানুয়ারি শরীফ ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু, এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন।
কিন্তু, ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তাঁর মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ok ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে ইমরান দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।