দেশে করোনার টিকাদান : জনগণের অনীহাই বড় বাধা
সরকার আগামীকাল রোববার (৭ ফেব্রুয়ারি) থেকে সারা দেশে ব্যাপকভাবে কোভিড-১৯-এর টিকাদান কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। তবে টিকা নিতে নিবন্ধন করার বিষয়ে জনগণের অনীহা এই কর্মসূচি সফল করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সরকারের লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন গড়ে দুই লাখ ৬০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া। তবে, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯ দিনে মাত্র দেড় লাখ মানুষ অনলাইনে নিবন্ধন করেছেন।
এমন পরিস্থিতিতে প্রথম মাসে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষকে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ৩৫ লাখ লোককে টিকা দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, সরকারকে করোনার টিকা গ্রহণে নিবন্ধন করার জন্য জনগণকে উত্সাহিত করতে একটি গণপ্রচার চালানোর পাশাপাশি নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।
এরই মধ্যে সরকার দেশের সব জেলায় টিকার ডোজ পাঠিয়েছে এবং কর্মসূচি পরিচালনার জন্য সরঞ্জাম ও বুথের ব্যবস্থাসহ সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকার ৭০ লাখ ডোজ রয়েছে এবং করোনার টিকা নিতে চাইলে www.surokkha.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে।
প্রযুক্তিভীতি যখন বড় সমস্যা
হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমএইচ চৌধুরী (লেনিন) বলেন, টিকার জন্য বর্তমান অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি জটিল। দেশের বেশির ভাগ মানুষ নিজে নিজে ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পারবেন না।
এমএইচ চৌধুরী বলেন, অনেক মানুষ বিশেষ করে প্রবীণ এবং গ্রামাঞ্চলে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা তথ্যপ্রযুক্তিতে অতটা অভ্যস্ত নন। তাই টেকনোফোবিয়া বা প্রযুক্তিভীতির কারণে টিকা দেওয়ার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে পারছেন না।
লেনিন মনে করেন, অ্যাপ-ভিত্তিক নিবন্ধন ইউরোপীয় এবং উন্নত দেশের জন্য উপযুক্ত হলেও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে অতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি।
এ ছাড়া জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমএইচ চৌধুরীর মতে, শহুরে অঞ্চলের বস্তিতে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষের নিজে নিজে নিবন্ধন করার মতো স্মার্টফোন নেই। তাই, অনলাইন নিবন্ধন থাকার কারণে অনেকের কাছে টিকা পৌঁছানো নিশ্চিত করা যাবে না।
এমএইচ চৌধুরী আরো বলেন, সরকার প্রতিটি এলাকার স্কুলগুলোকে নিবন্ধনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, যেখানে স্বেচ্ছাসেবীরা কোনো ঝামেলা ছাড়াই টিকা নিতে নিবন্ধনে সহায়তা করবেন। তিনি বলেন, সরকার এরই মধ্যে বলেছে যে, টিকা কেন্দ্রগুলোতেও নিবন্ধকরণ করা যাবে এবং এটি একটি ভালো উদ্যোগ।
প্রয়োজনীয় প্রচার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের টিকা নিতে নিবন্ধন করার বিষয়ে অনীহার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে— প্রয়োজনীয় প্রচারণার অভাব, অ্যাপ সম্পর্কিত সমস্যা এবং মানুষের আগ্রহের অভাব।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘সরকারকে টিকা নেওয়ার গুরুত্ব জনগণকে বোঝাতে এবং তাদের বিভ্রান্তি ও অনীহা দূর করতে ব্যাপক প্রচার চালানো দরকার।’
ডা. বে-নজির বলেন, সরকারকে এটা ভাবলে চলবে না যে, বিনা প্রচারে সবাই টিকার প্রতি আগ্রহ দেখাবে। যাঁরা সংবাদপত্র পড়েন, টিভি দেখেন এবং বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান রাখেন, তাঁরা টিকার গুরুত্ব জানেন। তবে, অন্যদের টিকা নিতে আগ্রহী করতে প্রচারের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
সরকার যদি নিবন্ধন কর্মসূচির সাথে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউএইচএফডব্লিউসি ও এনজিও কর্মীদের কাজে লাগায় তাহলে তারা লোকজনের সাথে কথা বলতে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে এবং এভাবে তাদের টিকা গ্রহণ করতে উত্সাহিত করবে, যোগ করেন ডা. বে-নজির। তিনি আরো বলেন, পাশাপাশি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে সুশীল সমাজের সদস্য, গণমাধ্যম কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসা উচিত।
সমাজের সম্পৃক্ততা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক বলেন, সব দেশের সরকারকে জনসচেতনতা তৈরি ও করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণ এবং টিকাদান কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা আছে।
মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমাদের সরকার সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করেছে, তবে এগুলো যথেষ্ট নয়। প্রথম থেকেই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সমাজকে সম্পৃক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। এ জন্য আমরা এখনো মানুষকে মাস্ক পরতে আগ্রহী করতে পারিনি। আমরা যদি টিকাদান কর্মসূচিতেও সমাজকে সম্পৃক্ত করতে না পারি, তবে আমরা এতেও সফলতা পাব না।’
মোজাহেরুল আরো বলেন, ‘যাঁরা সচেতন ও শিক্ষিত, তাঁরা অনলাইনে বা অ্যাপ-ভিত্তিক নিবন্ধনে আগ্রহ দেখাবেন। আমাদের বেশির ভাগ লোক এ জাতীয় অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার এবং অনলাইন নিবন্ধন করার ব্যাপারে অভ্যস্ত নন। অন্যদিকে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন। তাই, আমরা তাদের জনপ্রতিনিধি, এনজিও কর্মী, শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা এবং রাজনৈতিক পরিচয় নির্বিশেষে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে নিবন্ধনে উত্সাহ দেওয়ার কাজটা করতে পারি।’
মোজাহেরুল হক বলেন, সরকার টিকা কর্মসূচির কৌশলগত পরিকল্পনায় কমিউনিটির অংশগ্রহণকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে এবং একে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ১৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক, সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউএইচএফডব্লিউসি), প্রায় ৫০০ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৬৪ জেলা হাসপাতাল এবং প্রতিটি জেলায় বেশ কয়েকটি প্রসূতি কেন্দ্র এবং বহু এনজিও রয়েছে, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের টিকা সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা এসব কেন্দ্রগুলোকে নিবন্ধন করার এবং টিকা দেওয়ার কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগাতে পারি।’
মানুষের মধ্যে টিকা নিয়ে ভুল ধারণা
ডা. লেনিন বলেন, গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে শহুরে ও প্রভাবশালী মানুষগুলোকে টিকা দেওয়ার পরে তাদের টিকা দেওয়া হবে। এ কারণেই তাঁরা টিকার জন্য নিবন্ধনের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। গ্রামাঞ্চলে ভাইরাসের সংক্রমণ প্রবণতা কম হওয়ায় গ্রামের মানুষ টিকা নিয়ে কম ভাবছে।
পাশাপাশি ডা. লেনিন বলেন, ‘টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও ভয়ও কাজ করছে। আমাদের অবশ্যই কার্যকর যোগাযোগ এবং প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে থাকা বিভ্রান্তি ও ভয় দূর করতে হবে।’
বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের দিয়ে প্রচার
টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে উল্লেখ করে ডা. লেনিন বলেন, মন্ত্রী, অন্যান্য রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, শিল্পী, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকের মতো সব পেশা ও শ্রেণির স্বনামধন্য ব্যক্তিদের ভক্তদের টিকা নিতে অনুপ্রাণিত করতে ক্যামেরার সামনে টিকা নিতে হবে।
ডা. লেনিন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি ক্যামেরার সামনে এই টিকা নেন তবে অন্য শিক্ষকেরাও টিকা নিতে উত্সাহিত হবেন। আমরা যা দেখছি তা হলো, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকেরা শুধু তাঁদের কথা এবং বিবৃতি দিয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছেন যা কার্যকর হবে বলে আমার মনে হয় না। আমাদের এমন উল্লেখযোগ্য কিছু করা উচিত যা মানুষ অনুসরণ করতে চাইবে।’
এদিকে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আ স ম আলমগীর বলেন, মানুষের কম সাড়া পাওয়ায় তাঁরা অনলাইনে নিবন্ধন করার প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ডা. আ স ম আলমগীর বলেন, সরকার ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্রগুলোতে টিকা নিবন্ধন বুথ স্থাপন করেছে।
পাশাপাশি প্রতিটি এলাকায় মাইকের মাধ্যমে মানুষকে টিকার নিবন্ধন করার জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে যেতে আহ্বান জানানো হবে, যোগ করেন ডা. আ স ম আলমগীর।
আলমগীর বলেন, সরকার টিকা নেওয়ায় জনগণকে উত্সাহ দিতে ও অনীহা দূর করতে গণমাধ্যমেও প্রচার চালাবে।
ডা. আ স ম আলমগীর জানান, বর্তমানে শুধু ৫৫ বছরের বেশি বয়সী এবং প্রথম সারির পেশাদারদের কোভিড-১৯ টিকা কর্মসূচির প্রথম পর্বে নিবন্ধন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।