নতুন ঠিকানায় নতুন স্বপ্ন
চারদিকে জলে ভাসা ছোট ছোট গ্রাম, দেশের ভূপ্রাকৃতিতে যোগ করে অপার সৌন্দর্য। বর্ষাকালে হাওর অনেকটা সাগরে পরিণত হয়। কবির ভাষায় হাওরকে বলা হয়েছে ‘সমুদ্রের ছোট মেয়ে’। এমন একটি হাওর এলাকা নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলা। যেখানের বেশিরভাগ গ্রামই বছরের প্রায় অর্ধেক সময় থাকে পানিবন্দি। হাওর দ্বীপ হিসেবে পরিচিত খালিয়াজুরীর বেশিরভাগ মানুষই দরিদ্র। সেই প্রান্তিক খালিয়াজুরী জনপদেও পৌঁছেছে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের ঘর। নতুন ঠিকানার নতুন সেসব ঘরে সুন্দর একটি জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখছে উপকারভোগীরা।
নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে খালিয়াজুরীর যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ‘বর্ষায় নাও (নৌকা) শুকনায় পাও (পা)’ ছাড়া চলাচল করা যেত না। তবে এখন শুকনো মৌসুমে মোটরসাইকেল, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করে।
কথায় বলে, ‘নাম আছে-গ্রাম নেই’। এমন অবস্থার বাস্তব প্রমাণ মিলবে খালিয়াজুরীসহ হাওরের একাধিক উপজেলায়। আফালের (ঢেউ) তান্ডবে ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে অনেকের বাড়িঘর ও স্থাপনা। গৃহহীন হয়েছে অগণিত মানুষ।
অবহেলিত এসব গৃহহীন মানুষের কথা ভেবে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসন। এখানের নির্মিত প্রত্যেকটি ঘরই যেন গৃহহীন মানুষের স্বপ্নের ঠিকানা, নির্ভরতার স্থান। নতুন ঠিকানায় উঠে এই সমস্ত ঘরের বাসিন্দারা নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ মনে করছেন তাদের জীবন। জীবন চলার পথে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।
উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে এখন শোভা পাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের নানা রঙের সেমিপাকা ঘর। আশ্রয়হীনদের এসব নতুন আবাসস্থল দেখলে মনে হবে, এ যেন হাওরপাড়ের লাল সবুজের সমারোহ।
খালিয়াজুরী উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীনে উপজেলায় দুই ধাপে ৮৪৩টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়নে ১৬টি, চাকুয়ায় ১১টি, খালিয়াজুরী সদরে ১৯৬, নগরে ৪৮টি ও কৃষ্ণপুর ইউনিয়নে ১৭২টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও দ্বিতীয় ধাপে মেন্দিপুরে ১০টি, চাকুয়ায় ৫০টি, খালিয়াজুরী সদরে ৬৬টি, নগরে ৭২টি, কৃষ্ণপুরে ১২টি ও গাজীপুরে ১৯০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। দুই ধাপে জেলার ১০ উপজেলায় এক হাজার ৮৮৫টি ঘর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক ঘরই দেওয়া হয়েছে খালিয়াজুরীতে। ওই সমস্ত ঘরের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের বাসিন্দাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।
খালিয়াজুরী সদর ইউনিয়নের মুজিবনগর এবং মুমিননগর গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, যারা ঘর পেয়েছেন তারা যেন চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই খুশি হয়েছেন। তাদের আনন্দের যেন শেষ নেই। প্রকল্পের বাসিন্দারা নিজের সীমানায় ঘরের আশেপাশে লাগিয়েছেন নানা জাতের ফুল ও ফলের গাছ। কেউ হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন শুরু করেছেন। সেমিপাকা ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা, দোয়া ও দীর্ঘায়ু কামনা করছেন।
মুজিবনগরের হেলাল মিয়া গরু বেচাকেনার ব্যবসা করেন। প্রকল্পের ঘর পেয়ে সেটিকে সুন্দর করে সাজিয়েছেন তিনি। ঘরের দেয়ালে এঁকেছেন আলপনা। তাঁর স্ত্রী কোহিনূর বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, স্বামী গরু বেচাকেনা করে। যা আয় হয়, কোনো রকমে সংসার চলে। ঘর পেয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি।’
প্রকল্পে ঘর পাওয়া একই গ্রামের অপর বাসিন্দা গফুর মিয়া। তিনি বলেন, ‘কদিন আগেও কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটত। টিনের ছাপরা ঘরে থাকতাম, নিজেদের কোনো জায়গা-জমি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের থাকনের (থাকার) ব্যবস্থা করছে, আমরা খুব খুশি হয়েছি।’
ওই প্রকল্পের অনেক বাসিন্দাই এমন করে কৃতজ্ঞতা জানান।
খালিয়াজুরী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান সানোয়ারুজ্জামান সিদ্দিকী জোসেফ বলেন, ‘মুজিবনগর গ্রামটি ছিল একটি অবহেলিত গ্রাম। এখানে বসবাসরত প্রতিটি পরিবার অসহায়, ছিন্নমূল, গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষ। এই মুজিবনগরে ৭৩টি পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের জমি ও নতুন ঘর দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। নতুন ঘর পেয়ে তাঁরা সুন্দর জীবন যাপন করছে।’
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ এইচ এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপহার ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। উপজেলার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৩টি ঘরের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ। প্রথম ধাপের ঘর নির্মাণে দুই-চারটি ঘরে সামান্য ত্রুটি ছিল। তা পরে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। জমিসহ ঘরের কাগজপত্র উপকারভোগীদের মধ্যে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘরে তাঁরা বসবাস শুরু করেছেন।’
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার-আর কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। অবহেলিত জনপদ খালিয়াজুরীতে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের বাসিন্দারা যাতে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারে সেই ব্যবস্থা করার জন্য চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। স্বনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে তাদের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্প এলাকায় মসজিদ, উপাসনালয়, খেলার মাঠ, শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা ও সরকারি জমিতে ফসল ও নানা জাতের শাক-সবজির আবাদের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হবে।’