মহাসড়ক বেচাকেনা করে কোটি কোটি টাকার প্রতারণা
যেনতেন প্রতারণা নয়, মহাসড়কের জমি কেনাবেচা করতেন তিনি। সেই জমি বন্ধক রেখে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার ব্যাংক লোন। লোন পরিশোধ করতে না পারায় জমি ওঠে নিলামে। এরপর বেড়িয়ে পড়ে থলের বিড়াল। জানা যায়, মহাসড়কের সরকারি জমি জালিয়াতি করে লিখে নেওয়া হয়েছে নিজের নামে। এমন সব প্রতারণা, জালিয়াতি, হত্যাচেষ্টার আসামি র্যাবের জালে পড়েছেন ধরা। তাঁরা নাম মো. গোলাম ফারুক। একই সঙ্গে তাঁর প্রধান সহযোগী ফিরোজ আল মামুনও আটক হয়েছেন। রাজধানীর উত্তরা থেকে তাঁদেরকে আটক করা হয়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আজ শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য দেন।
খন্দকার আল মঈন জানান, র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রতারণামূলকভাবে মহাসড়কের জমি ক্রয়-বিক্রয়সহ ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন গোলাম ফারুক। গ্রেপ্তার গোলাম ফারুক হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি বলেও জানিয়েছে র্যাব।
সংবাদ সম্মেলনে মঈন জানান, সম্প্রতি রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় জাল দলিল ও এ সংক্রান্ত বিরোধের জেরে একটি হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। যেখানে ভুক্তভোগীকে নিজ জমি থেকে জোরপূর্বক উৎখাত করার উদ্দেশে গোলাম ফারুক ও তাঁর প্রধান সহযোগী ফিরোজ আল মামুনসহ অন্যান্যরা গত ২৬ মার্চ ও ৬ এপ্রিল বাদীদের ওপর হত্যার উদ্দেশে হামলা চালান বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী আদালতে অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে আদালত রাজধানীর বাড্ডা থানাকে এফআইআরের আদেশ দেন। পরে বাড্ডা থানায় মামলা হয়।
ঘটনাটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে র্যাব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে র্যাব-১-এর অভিযানে রাজধানীর উত্তরা থেকে ওই মামলার প্রধান আসামী মো. গোলাম ফারুক (৫০) ও তাঁর সহযোগী ফিরোজ আল মামুনকে (৩৫) গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাবের দাবি, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফারুক ও ফিরোজ রাজধানীর বাড্ডায় হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছেন।
এ ছাড়া মহাসড়কের জমি ক্রয়-বিক্রয় করে প্রতারণামূলকভাবে ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে প্রতারিত করার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কেও দোষ স্বীকার করেছেন।
খন্দকার মঈন জানান, ২০২১ সালের এপ্রিলে একটি বেসরকারি ইলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে মহাসড়কের জমি ব্যক্তি নামে নিবন্ধন, বিক্রয়, ব্যাংকে বন্ধক ও ব্যাংক কর্তৃক নিলামে বিক্রি চেষ্টার ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। এই ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয় হতে তদন্ত টিম গঠিত হয়।
সে সময় তদন্তে উঠে আসে—একটি প্রতারকচক্র মহাসড়ক শ্রেণিভুক্ত সরকারি জমি ব্যক্তি মালিকানায় নিবন্ধন করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ চক্রে কিছু সরকারি কর্মকর্তাও জড়িত আছেন। যদিও পরে এসব জমি সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তর পুনরায় অধিগ্রহণ করে।
র্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত গোলাম ফারুক জানায়—২০০০ সাল থেকে গাড়ি আমদানিকারক হিসেবে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কোনো বন্ধকি সম্পত্তি ব্যতিত এলসি আবেদন করে গাড়ি আমদানি করেন। বিদেশি ব্যাংকের টাকা পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকায় বর্ণিত বেসরকারি ব্যাংকটি আমদানিকৃত গাড়ি বিক্রি করে ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করার শর্তে ৭ কোটি টাকা ডিম্যান্ড লোন দেয়। কিন্তু, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক ফারুককে সম্পত্তি বন্ধক দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এ সময় তিনি সরকারি জমিকে ব্যক্তি নামে নিবন্ধন করার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ফারুক ১৯৪৮ সালে সরকারের অধিগ্রহণ করা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের জন্য উত্তরার আজমপুর অংশের অধিগ্রহণ হওয়ার আগের মালিকের ছেলেকে খুঁজে বের করেন। ২০০৬ সালে জালিয়াতি করে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভূয়া দলিল তৈরি করেন। পরে সেই দলিল দিয়ে ২০১০ সালে তৎকালীন মালিকের ছেলের কাছ থেকে নিজের স্ত্রীর নামে নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করে আরেকটি দলিল তৈরি করেন। একই বছরে তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ওই জমি নিজের নামে দলিল করে নেন।
পরবর্তীতে উক্ত জমি ওই বেসরকারি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে আরও ১৫ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেন ফারুক। সেই ঋণ পরিশোধ না করায় ২০১৩ ব্যাংক অর্থ আদায়ের উদ্দেশে বন্ধকি জমি নিলামে বিক্রয় করার নোটিশ জারি করে। পরে ব্যাংক সরেজমিনে গিয়ে দেখতে পায় ওই জমিটি সরকারি সম্পত্তি।
র্যাব আরও জানায়, গ্রেপ্তার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে জমি জমা সংক্রান্ত, প্রতারণা, হত্যাচেষ্টা, এনআই অ্যাক্ট, জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অপরাধে রাজউকের একটি, বেসরকারি একটি ব্যাংকের ৪টিসহ মোট ৮টি মামলা রয়েছে।
ফিরোজ আল মামুনের বিরুদ্ধে উত্তরায় বিভিন্ন অপরাধ বিস্তারে কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তিনি গোলাম ফারুকের সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী।