যেভাবে ধরা হলো ‘সন্দেহভাজন অপরাধী’কে
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর। রাত ১২টা ১০। হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচি। পাঁচজন লোক ধস্তাধস্তি শুরু করেন। সবাই সাদা পোশাক পরা। ঘটনা গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতের।
একজনকে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করেন বাকি চারজন। কিন্তু পারছিলেন না। যাকে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল, তিনি প্রচণ্ড শক্তি প্রদর্শন করছিলেন। শক্তিবলে বারবার ছাড়িয়ে নিচ্ছিলেন নিজেকে। কোনোভাবেই দুই হাত এক করছিলেন না। কিন্তু, বাকি চারজন তাঁকে হাতকড়া পরাবেনই। এ দৃশ্য দেখতে আশপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে যায়।
যাকে হাতকড়া পরানোর চেষ্টা করা হয়, তার নাম শরিফ (২৫)। তিনি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরের আশপাশের ফুটপাতে থাকেন। আশেপাশে তার পরিচিত লোকজনও ছিলেন। শরিফ জোরে জোরে চিৎকার করছিলেন আর মানুষজন ডাকছিলেন।
এভাবে প্রায় মিনিট দশেকের মতো চলতে থাকে ধস্তাধস্তি। এর ফাঁকে শরিফ চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘পলাশ আপনি আমাকে ধরবেন না। আমাকে ছেড়ে দেন।’ এরপরই শরিফ তাঁর পরিচিতদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘শাহবাগ থানায় ফোন দে। এরা এসেছে লালবাগ থানা থেকে।’ পরে পলাশ নামে কোনো পুলিশ সদস্যকে পাওয়া যায়নি।
শরিফের চিৎকার শুনে এক তরুণী ওই পাঁচজনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। তখন মুঠোফোনটি তাকে দিয়ে দেন শরিফ। সে সময় চলে আসেন পোশাক পরা পুলিশের এক উপপরিদর্শক (এসআই)। একপর্যায়ে পাঁচজন শরিফকে হাতকড়া পরাতে সক্ষম হন। রাত তখন ১২টা ২০। হাতকড়া লাগানোর পর জানা যায়, অভিযান চালানো ওই পাঁচজনই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) লালবাগ থানা পুলিশের সদস্য।
যদিও ঘটনাস্থলের আশপাশে শাহবাগ ও লালবাগ থানার আরও কয়েকজন সদস্য ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছিল। ঘটনাস্থলে থেকে দেখা যায়, হাতকড়া পরানোর সঙ্গে সঙ্গে শরিফকে ব্যাটারিচালিত একটি ইজিবাইকে তুলে নেওয়া হয়। অভিযানে থাকা পুলিশের দাবি, ‘গ্রেপ্তারকৃত শরিফের বিরুদ্ধে মারামারি ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে।’
শহীদ মিনার এলাকায় থাকা সাধারণ মানুষজন শরিফের শক্তিপ্রদর্শন দেখছিলেন। সেখানে থাকা মো. শোয়েব নামের একজন বলছিলেন, ‘হেরোইন খেয়েছে মনে হয়। এতজন পুলিশ একজনকে হ্যান্ডকাফ পরাতে হিমশিম খাচ্ছে!’
বিষয়টি নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় লালবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) লুৎফর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘শাকিল ও রানা নামের দুজন রাজধানীর নিউ মার্কেটে কাপড় বিক্রি করেন। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে শেষে পলাশী মোড় হয়ে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় রকি ও মোস্তফা নামের দুজন রানার কাছে মুঠোফোন চান কথা বলার জন্য। কিন্তু রানা ও শাকিল ফোনটি দিতে চাননি। ফোন না পেয়ে রেগে গিয়ে রকি ও মোস্তফা তাঁদের দুজনকে ধারালো ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এতে রানা ও শাকিলের শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়।’
এ ঘটনার রাতে, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার রাতেই থানায় মৌখিক অভিযোগ জানান ভুক্তভোগী শাকিল। পরে পুলিশ রাতভর অভিযান পরিচালনা করে রকি, মোস্তফা ও শরিফকে বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার ভুক্তভোগী শাকিল বাদী হয়ে লালবাগ থানায় দণ্ডবিধির ৩২৪, ৩২৬, ৩৭৯ ও ৫০৫ ধারায় রকি ও মোস্তফাসহ দু-তিনজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই লুৎফর রহমান।
শরিফ, রকি ও মোস্তফাকে গ্রেপ্তারের পর শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা লুৎফর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, মামলার বাদী শাকিল ও বাদীর সঙ্গী রানা দুরকম তথ্য দিয়েছেন। একজন বলেছেন, শরিফ ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন। আরেকজন বলেছেন, শরিফ ছিলেন না। সেজন্য ‘সন্দেহভাজন অপরাধী’ হিসেবে তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়েছিল। এখন তিনি কারাগারে।
যদিও গত শনিবার লুৎফর বলেছিলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, শহীদ মিনার থেকে গ্রেপ্তার হওয়া শরিফ ছিনতাই ও মারামারির ঘটনায় জড়িত ছিলেন না। তাই ঊর্ধ্বতন স্যারদের পরামর্শক্রমে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘মামলার বাদী ও আসামিরা পূর্ব পরিচিত। এরা সবাই ড্যান্ডিখোর। মারামারির ঘটনার পর গ্রেপ্তারকৃত শরিফ ভুক্তভোগী দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলেন’, যোগ করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
মামলার বাদী শাকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রথমে দুজন এসে আমাদের কাছে ফোন চায়। আমরা দিতে না চাইলে ছুরি মারে আমাদেরকে। আমার রানে ও রানার রানে, হাতে ও মাথায় অনেক কেটে যায়। তবে আমাদের ওখানে শরিফ ছিল না। আমি অন্তত তাকে দেখিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যে আসামিদের গ্রেপ্তার করেছি, তারা শরিফের নাম বলেছেন। তাই তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার ভুক্তভোগী ও আসামিরা পূর্ব পরিচিত। এরা তো মামলা করতে চায়নি শেষ পর্যন্ত। আর মামলা করার পরও তাঁরা ঠিকঠাক তথ্য দিচ্ছিলেন না। এরা সবাই নেশাখোর।’