যেমন কাটল ‘লকডাউনের’ প্রথম দিন
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকার মধ্যে সরকার সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে। আজ সোমবার ছিল প্রথম দিন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, সারা দেশে গণপরিবহণ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর রাস্তাঘাট ছিল রিকশার দখলে। সিএনজিচালিত অটোরিকশাও কম দেখা যায়নি। তার সঙ্গে মোটরসাইকেল আর প্রাইভেটকারকেও দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গেছে শহরজুড়ে। যানবাহন যেহেতু ছিল, মানুষও ছিল চোখে পড়ার মতো। গণপরিবহণ না থাকায় আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে মানুষের ভোগান্তিও ছিল চরমে। মাস্কের ব্যবহার নিয়ে মানুষের উদাসীনতা ঠেকাতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে রাস্তায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এভাবেই চলেছে প্রথম দিনের লকডাউন।
গত ৩ এপ্রিল নিজ বাসা থেকে এক ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘সোমবার থেকে সারা দেশে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন হবে।’ এরপর সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ‘লকডাউন’ মেনে চলতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
যদিও আজ সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, ‘সরকার লকডাউন নয়, কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে।’
‘লকডাউন’ অথবা কঠোর বিধিনিষেধ যাই বলা হোক, এই পরিস্থিতিতেও সারাদিন রাজধানীর মোড়ে যানবাহন ও মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। দিনের শুরুতেই, কর্মস্থলের উদ্দেশে যাওয়ার জন্য এবং কাজের তাগিদে রাস্তায় মানুষের আনাগোনা দেখা গেছে। সকালে গাবতলী বাস টার্মিনালে অসংখ্য মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহণে চড়ে অনেককে অফিসে যেতে হয়েছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, গাবতলী, শাহবাগ, নিউমার্কেট, ঢাকা মেডিকেল, অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ, গুলিস্তান, মতিঝিল, কমলাপুর, রাজারবাগ, হাতিরঝিল ও তেজগাঁও এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
এদিকে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেও দোকান খোলা রাখার দাবিতে আজ সকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। দোকান মালিকদের দাবি, সামনে ঈদ। অল্প সময়ের জন্য হলেও তাদেরকে যেন দোকান খুলতে দেওয়া হয়।
সেখানে দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বইমেলা খোলা থাকলে, তারা কেন দাবি করবে না?’
নিউমার্কেট থেকে ঢাকা মেডিকেলের গেটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অনেক রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক দাঁড়িয়ে আছেন। অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই।
সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা যায়, কিছু মানুষ এলোমেলোভাবে ঘোরাঘুরি করছেন। দোকানিরা অলস সময় পার করছেন। অনেক দোকানেই কোনো ক্রেতা দেখা যায়নি।
নাজমুল হক নামে এক যুবক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে বইমেলা চালু রেখেছে সরকার। তাই দেখতে এলাম কী অবস্থা। যদিও আমি একটি বই কিনেছি। বেশি লোকজন আসেনি আজ।’
সজিব আহমেদ নামের এক বিক্রেতা বলেন, ‘বইমেলা খোলা থাকা উচিত হচ্ছে না। করোনার কথা শুনে আমার আসতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও আসতে হয়েছে। কারণ, আমি চাকরি করি।’
এরপর প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে গুলিস্তান যাওয়ার পথে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষ বাইরে ঘুরছে। কেউ হেঁটে চলেছেন, কেউ আবার রিকশা বা সিএনজিতে চড়ছেন। গুলিস্তান চত্বরের চারপাশে ৬৬টি রিকশা থাকতে দেখা গেছে। ছিল ১১টি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও। কিন্তু সেখানে যাত্রী নেই বললেই চলে। কিন্তু চত্বরের আশপাশ দিয়ে প্রচুর মানুষকে হেঁটে যেতে দেখা গেছে; যাদের অনেকের মুখেই কোনো মাস্ক ছিল না। সেখানে পুলিশ থাকলেও মাস্কের জন্য কাউকে কিছু বলতে দেখা যায়নি।
রিকশাচালক শহিদুল ইসলাম (৪৫) বলেন, ‘অন্যদিন দেড় হাজার টাকার মতো আয় করি। কিন্তু আজ মাত্র ২০০ টাকা কামাই হয়েছে। দেখছেন না, এখানে শুধু রিকশা আর রিকশা। কিন্তু যাত্রী একেবারেই কম।’
একই কথা বললেন আরও তিন চালকও। দেখা গেছে, যাত্রী পেলে চালকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। এর পাশেই একসঙ্গে বসে ছিলেন বেশকিছু দোকান কর্মচারী। তাঁরা জানালেন, দোকান খোলার আশায় তাঁরা এখানে বসে আছেন।
এরপরের গন্তব্য মতিঝিলের শাপলা চত্বর। সেখানকার চিত্র আবার ভিন্ন। নাজির হোসেন (৫০) নামের এক যাত্রী রিকশায় করে কমলাপুর যাবেন। এই পথের সাধারণ ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু রিকশাচালক চাইলেন, ৪০ টাকা। এর কমে কেউ যাবেন না। শেষশেষ নাজির হোসেন ৪০ টাকায় যেতে বাধ্য হলেন। শাপলা চত্বরের চারপাশেও প্রচুর সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা ছিল। সাধারণ মানুষও ছিল পর্যাপ্ত।
রিকশায় উঠার আগে নাজির হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অফিস করতে হলো, আবার টাকাও বেশি যাচ্ছে। বাস থাকলে কি এমন হতো? দুদিন পর হয়তো আবার বেতন কমিয়ে দেওয়ার কথা বলবে। যত জ্বালা সব আমাদের মতো গরিবদের।’
সেখানে আরেকজন কর্মজীবী (৩৫) নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘করোনার শুরুতে গত বছর প্রথম যখন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন মানুষ অনেকটা ভয়েই ঘর থেকে বের হননি। রাস্তাঘাট ছিল সুনসান। কিন্তু এবার মানুষের মধ্যে মনে হয় সেই ভয় নেই। রাস্তায় প্রচুর মানুষ দেখতে পাচ্ছি।’
শাপলা চত্বর থেকে শাহজাহানপুরের এজিবি মসজিদ কলোনির পাশে গিয়ে দেখা যায়, টিসিবির একটি পিকআপ ভ্যানে করে ৫৫ টাকা দরে চাল-ডাল আর ১০০ টাকা দরে তেল বিক্রি করছে। মানুষ হুমড়ি খেয়ে কিনছেন। অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। ছিল না কোনো স্বাস্থ্যবিধির বালাই। সবাই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন বিকেল ৫টা।
পাশে এক বৃদ্ধ (৬০) কলা বিক্রি করছিলেন, তখন কয়েকজন পুলিশ গিয়ে তাঁকে সেখান থেকে উঠিয়ে দেন। শফিকুল ইসলাম নামের ওই বৃদ্ধা তখন অনুনয় করে বলেন, ‘কলা বিক্রি করতে না পারলে সব পঁচে যাবে।’ তারপরও পুলিশ তাঁকে আগামীকাল সকালে বিক্রির পরামর্শ দিয়ে চলে যেতে বলেন।
এরপর রামপুরা, হাতিরঝিল হয়ে তেজগাঁওয়ের ভিতর দিয়ে কারওয়ান বাজারে আসার পথে দেখা যায়, সড়কে প্রচুর মানুষ। হাতিরঝিলে বসেও মানুষ আড্ডা দিচ্ছে। রাস্তায় ছিল যানবাহনও। অনেকের মুখে মাস্ক ছিল। তবে কাউকে কাউকে মাস্ক ছাড়াই এখানে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে।
এদিকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অভিযান চালিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আজ বেলা সোয়া ১১টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত এ অভিযান চলে।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানায় এবং অকারণে ঘোরাঘুরি করায় মোট ২৫ জনকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া নিম্নবিত্তের মানুষকে আমরা দুই হাজার মাস্ক বিতরণ করেছি। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল রিকশাচালক। আজ শহরের সবখানে দেখেছি, প্রচুর রিকশাচালক। যাদের কাছে মাস্ক ছিল না বা পুরানো হয়ে গেছে। দেখা গেছে, মাস্ক রিকশার হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রেখেছে। এমন সব মানুষকে আমরা মাস্ক দিয়েছি। আগামীকালও অভিযান অব্যাহত থাকবে।