লকডাউনের প্রথম দিন : রাজধানীর সড়কে ব্যস্ততা, জনসমাগম
সারা দেশে লকডাউনের প্রথম দিন রাজধানীর সড়কে হঠাৎ হঠাৎ দু-একটি বাস চলতে দেখা গেছে। সকালের প্রথম দিকে যানবাহন কম দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বেড়েছে। বেড়েছে রিকশা, সিএনজি, প্রাইভেটকারের ও মোটরসাইকেলের সংখ্যা। এ ছাড়া রাস্তাঘাটে জনসমাগমও দেখা গেছে। অনেককেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই। এর ফলে লকডাউনের প্রথম দিন সরকারি নির্দেশনা কঠোরভাবে মানা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
এদিকে, বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত বিভিন্ন জরুরি পণ্য পরিবহণ করতে দেখা গেছে সকাল থেকেই। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থায় কর্মীদের অফিসের উদ্দেশে নিতে দেখা গেছে। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থা না থাকায় রিকশা বা সিএনজিতে করেও কর্মস্থলে যাচ্ছেন কেউ কেউ।
অন্যদিকে, ঢাকার সাভারে লকডাউনের ছিটেফোঁটারও দেখা মেলেনি। সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিনে সোমবার সকালে অন্যান্য স্বাভাবিক দিনের মতোই মানুষের ভিড় দেখা গেছে সাভারের রাস্তাঘাটে।
কলকারখানা খোলা থাকায় শিল্পাঞ্চল সাভার ও আশুলিয়ায় লকডাউনের প্রভাব তেমন একটা পড়েনি বললেই চলে। সোমবার সকাল থেকেই গাদাগাদি করে বাসে উঠেছেন শিল্প কারখানার শ্রমিকেরা। সড়কে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের আধিক্য থাকলেও গণপরিবহণ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিপাকে পড়েছেন কর্মস্থলমুখী অসংখ্য যাত্রী।
পোশাকশ্রমিকদের অনেকে পায়ে হেঁটে, অনেকে রিকশাভ্যান কিংবা অটোরিকশায় গাদাগাদি করে বসে রওনা হয়েছেন কর্মস্থলের উদ্দেশে।
লকডাউন কার্যকরে যেমন প্রশাসনের কোনো বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়েনি, তেমনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখারও বালাই ছিল না কোথাও।
যানবাহন না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পোশাকশ্রমিকদের অনেকেই। সারা দেশ লকডাউন রেখে শ্রমঘন শিল্পাঞ্চলে কল কারখানা খোলা রেখে লকডাউন কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। শ্রমিকেরা বলছেন, সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তাঁরা।
সাভার বাসস্ট্যান্ডে পোশাকশ্রমিক রফিকুল হোসেন বলেন, ‘যানবাহন না পেয়ে আমরা গাদাগাদি করে যাচ্ছি। বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে। লকডাউন আমাদের ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।’
এদিকে, সাভারেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে করোনায় আক্রান্তদের সংখ্যা। স্থানীয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে করোনা ওয়ার্ডে কোনো শয্যা ফাঁকা নেই। এমনকি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) শয্যার জন্য হাহাকার করতে দেখা গেছে রোগীর স্বজনদের।
গত ২৪ ঘণ্টায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের মধ্যে দুজন মারা গেছেন।
এদিকে, লকডাউনকে কেন্দ্র করে ঢাকা ছাড়ার জন্য গতকাল রোববার বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও লঞ্চঘাটে মানুষের হিড়িক পড়ে যায়। ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে বিভিন্ন সড়কে দেখা যায় তীব্র যানজট। কমলাপুর ও এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। মনে হচ্ছিল, অনেকে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছেন। তবে করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
গাবতলী বাস টার্মিনালেও অসংখ্য মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই যাত্রীদের বাসে চড়তে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, বেশি সংখ্যক যাত্রী নেওয়ার পরও বাসের ভাড়া ৬০ শতাংশ বেশি নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অনেকে।
সদরঘাটের লঞ্চঘাটেও দেখা গেছে ভয়াবহ পরিস্থিতি। হাজার হাজার ঘরমুখো মানুষ বাতাস ও বৈরি আবহাওয়া উপেক্ষা করে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে লঞ্চে চেপে বসেন। অনেককে সিট না পেয়ে ফিরে যেতেও দেখা গেছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আজ সোমবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করে গতকাল রোববার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। প্রজ্ঞাপনে লকডাউনের মধ্যে সারা দেশে গণপরিবহণ বন্ধ, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা, কাঁচাবাজার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করে ১১টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখার উপসচিব মো. শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনাগুলো জানানো হয়।
প্রজ্ঞাপনে যা বলা হয়েছে, তা নিচে হুবহু দেওয়া হলো-
(ক) সকল প্রকার গণপরিবহণ (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে, পণ্য পরিবহণ, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবাদানের ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া বিদেশগামী/বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না;
(খ) আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন-ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভূত থাকবে।
(গ) সকল সরকারি/আধাসরকারি/স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও আদালত এবং বেসরকারি অফিস কেবল জরুরি কাজ সম্পাদনের জন্য সীমিত পরিসরে প্রয়োজনীয় জনবলকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় অফিসে আনা-নেওয়া করতে পারবে। শিল্প-কারখানা ও নির্মাণ কার্যাদি চালু থাকবে। শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিজস্ব পরিবহণ ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া করতে হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ কর্তৃক শিল্প-কারখানা এলাকায় নিকটবর্তী সুবিধাজনক স্থানে তাদের শ্রমিকদের জন্য ফিল্ড হাসপাতাল/চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
(ঘ) সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত অতি জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত (ঔষধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না;
(ঙ) খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় কেবল খাদ্য বিক্রয়/সরবরাহ (টেকঅ্যাওয়ে/অনলাইন) করা যাবে। কোনো অবস্থাতেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ করা যাবে না;
(চ) শপিং মলসহ অন্যান্য দোকানসমূহ বন্ধ থাকবে। তবে দোকানসমূহ পাইকারি ও খুচরা পণ্য অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সর্বাবস্থায় কর্মচারীদের মধ্যে আবশ্যিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে এবং কোনো ক্রেতা স্বশরীরে যেতে পারবে না;
(ছ) কাঁচাবাজার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে;
(জ) ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবে;
(ঝ) সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকায় সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে;
(ঞ) সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন উল্লিখিত নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে; এবং
(ট) এই আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রজ্ঞাপনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতাধীন নির্দেশনাগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়।