সমঝোতা করতে জাপানি দুই শিশুর বাবা-মাকে আবারও সময় দিলেন হাইকোর্ট
দুই মেয়েকে নিয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) ও জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকো (৪৬) দম্পতি। তাই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর এই দম্পতিকে বিকেলে ৩টা পর্যন্ত সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে এরিকো স্বামী-সন্তান নিয়ে টোকিওতে গিয়ে নতুন করে সংসার করতে চান বলে তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছেন। এ বিষয়ে স্বামী শরীফ ইমরান রাজি না হওয়ায় সমঝোতা পৌঁছানো যায়নি।
পরে আজ মঙ্গলবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ভার্চুয়াল বেঞ্চ আদেশ দেন।
আদালতে জাপানি মায়ের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। বাবার পক্ষে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও তাঁর সঙ্গে ছিলেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট শিশির মনির এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এমন একটি প্রস্তাব নাকানো এরিকোর পক্ষ থেকে আইনজীবীর মাধ্যমে স্বামী শরীফ ইমরানের আইনজীবী ও তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবটি আজ আদালতে উপস্থাপন করা হলে তিনি তাতে রাজি হননি। এখন আদালত নতুন করে সময় দিয়েছেন আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।’
এর আগে গত ১৬ সেপ্টেম্বর দেশের উচ্চ আদালত এ দম্পতির দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ ও দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাবা ও জাপানি মায়ের আইনজীবীরা ‘সুন্দর সমাধানের চেষ্টা করবেন’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। হাইকোর্টের নির্দেশনায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে গুলশানের ভাড়া ফ্ল্যাটে দুই শিশুর সঙ্গে দিনে বাবা ও রাতে মা থাকছিলেন।
ওইদিন আদালত শিশুদের জন্য মঙ্গল হয় এবং দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য উভয়পক্ষের আইনজীবীকে একটি সুন্দর সমাধান খুঁজতে বলেছিলেন। ওইদিন ২৮ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ঠিক করেন আদালত।
২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি-যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক শরীফ ইমরান জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ে সেরে টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিন মেয়ে জন্ম নেয়। তারা তিনজনই টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের শিক্ষার্থী ছিলেন।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি শরীফ ইমরান এরিকোর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ২১ জানুয়ারি ইমরান আমেরিকান স্কুল ইন জাপান কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু এতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইমরানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এরপর একদিন জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা স্কুল বাসে বাড়ি ফেরার পথে বাসস্টপ থেকে ইমরান তাদের অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
গত ২৫ জানুয়ারি শরীফ ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছ থেকে মেয়েদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো ওই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে মেয়েদের নিজ জিম্মায় পেতে আদেশ চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি মেয়েদের সঙ্গে এরিকোর সাক্ষাতের অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন। কিন্তু ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়েকে সাক্ষাতের সুযোগ দেন। এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে’ ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিয়ে তিনি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন।
গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে তাদের মা এরিকোর জিম্মায় হস্তান্তরের আদেশ দেন। তবে দুই মেয়ে বাংলাদেশে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের একজন মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। এরপর গত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন।
বাংলাদেশে এসে এরিকো করোনা পরীক্ষা করালে তার রিপোর্ট নেগেটিভ থাকার পরেও ইমরান ওই রিপোর্ট অবিশ্বাস করে সন্তানদের সঙ্গে তাকে সাক্ষাতে অস্বীকৃতি জানান। গত ২৭ জুলাই এরিকোর মোবাইল সংযোগ বন্ধ করে চোখ বাঁধা অবস্থায় মেয়েদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। এ অবস্থায় দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় পেতে হাইকোর্টে রিট করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো।
১৯ আগস্ট সকালে দুই মেয়েকে আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে হেবিয়ার্স রিট করেন জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো। রিটে দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন ওই নারী।
দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা এবং তাদের বাবা শরীফ ইমরানকে এক মাসের জন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। রাজধানীর গুলশান ও আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এই নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
গত ২২ আগস্ট দুই শিশুকে শরীফ ইমরানের বারিধারার বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারপর থেকে তারা উইমেন সাপোর্ট সেন্টারে ছিল। গত ২৩ আগস্ট দুই জাপানি শিশুকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এ সময়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত জাপানি মা ও বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশি বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দেওয়া হয়।