‘র্যাব সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন’
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলায় যে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালত রায় দিয়েছেন, তার মধ্যে ২৫ জনই সন্ত্রাস দমনে গঠিত পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্য। এর মধ্যে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পেয়েছেন ২৬ জন, যার মধ্যে র্যাব সদস্য ১৭ জন। র্যাবের বাকি আট সদস্য বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন।
নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের দুই বছর নয় মাসের মাথায় আজ সোমবার নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন মামলার রায় ঘোষণা করেন। একসঙ্গে এত র্যাব সদস্যের আদালতের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। দণ্ডিত র্যাব সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের সময় নারায়ণগঞ্জে বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদসহ নানাভাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। রায়ে আদালত উল্লেখ করেছেন, র্যাব সদস্যরা বাহিনীর নাম ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
আদালত থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) এস এম ওয়াজেদ আলী খোকন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে রায়ের বরাত দিয়ে সাজাপ্রাপ্ত র্যাব সদস্যদের বিচারের পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ করে এসব কথা বলেন।
মামলার রায়ে যে ২৬ জন ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন তাঁরা হলেন- নূর হোসেন, মো. মিজানুর রহমান দীপু, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, চাকরিচ্যুত মেজর মো. আরিফ হোসেন, চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা, মো. মোখলেছুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন মুন্সী, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান, জামাল উদ্দিন, আসাদুজ্জামান নূর, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, আরওজি আরিফ হোসেন, সৈনিক আল আমিন, তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবির, বেলাল হোসেন, শিহাব উদ্দিন, মোর্তুজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, রহম আলী ও এমদাদুল হক।
বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত নয়জন হলেন মো. আল-আমিন, মো. রুহুল আমিন, সৈনিক মোহাম্মদ নুরুজ্জামান, এসআই আবুল কালাম আজাদ, বাবুল হাসান, এএসআই বজলুর রহমান, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান হাবিব, মো. নাছির উদ্দিন।
আদালতের আইনজীবী এস এম ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, ‘দেশের সংবিধান বা আইনের ঊর্ধ্বে কোনো ব্যক্তি নয়। যত বড় প্রভাবশালী বা চেয়ারের মালিক হোক তাঁকে সাজা পেতেই হবে। সংবিধান ফ্রেম করে দিয়েছে সবার দায়িত্ব-কর্তব্যকে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এলিট ফোর্স (র্যাব) তাঁরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন এবং তাঁরা দায়িত্বে থেকে সরকারি পোশাক পরে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আদালত যে কোনো অপরাধীর বিচার করতে পারেন এবং আদালত যে কোনো ব্যক্তিকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারেন। এটা আজকের রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো।’
আইনজীবী আরো বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, সবাইকেই যে কোনো অপরাধ করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আজ তারই দৃষ্টান্ত দেখানো হলো, যে এলিট ফোর্সের বাহিনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়েও তাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ নিয়ে এখান থেকে যেতে হয়েছে।’
মামলার নথি থেকে জানা যায়, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আটক ২৩ আসামির মধ্যে ২১ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ মামলায় মোট ১০৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
তবে তদন্ত শেষ হওয়ার পর প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনায় তাঁর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়ার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে, তাঁর গাড়িচালক মিজানুর রহমান দীপু জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোডের খানসাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের পাশ থেকে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তাঁর সহযোগী সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করে র্যাব-১১।
পরে ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ছয়জনের এবং ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল আলাদা দুটি মামলা করেন।
হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আদালতে ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশিদ মণ্ডল।
এরপর বিভিন্ন সময়ে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পলাতক থাকেন ১৩ জন। এর মধ্যে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর ১৩ নভেম্বর সাত খুনের দুটি মামলাসহ ১১ মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। ফলে গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩-এ। সাত খুনের মামলায় হত্যার দায় স্বীকার করে র্যাবের ১৭ জনসহ ২২ জন এবং ঘটনার সাক্ষী হিসেবে র্যাব সদস্যসহ ১৭ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে অভিযোগপত্র থেকে পাঁচ আসামিকে বাদ দেওয়ায় এবং প্রধান আসামি নূর হোসেনের জবানবন্দি ছাড়া আদালত অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ায় ‘নারাজি’ আবেদন করেন সেলিনা ইসলাম বিউটি। আবেদনটি নারায়ণগঞ্জ বিচারিক হাকিম ও জজকোর্টে খারিজ হয়ে গেলে বিউটি উচ্চ আদালতে যান।
হাইকোর্টের আদেশে বলা হয়, পুলিশ চাইলে মামলাটির ‘অধিকতর তদন্ত’ করতে পারে এবং ‘হত্যার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার’ ধারা যুক্ত করে নতুন করে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে। তবে তদন্তকারী সংস্থা জানায়, তাদের অভিযোগপত্র ‘নির্ভুল ও চমৎকার’।